২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির নীলনকশ-১
পুলিশ সদর দপ্তরের নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ‘কপোতাক্ষ’ নামে একটি কক্ষ আছে। এটি সাধারণ অফিসরুম হলেও ২০১৮ সালের অক্টোবরে ব্যবহার করা হয় অস্বাভাবিক কাজে। সেখানে বসে একদল পুলিশ কর্মকর্তা তৈরি করে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও পরিকল্পিত ‘ভোট ডাকাতির’ নীলনকশা।
কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার এবং প্রজেক্টরে সাজানো ওই কক্ষে তারা বিশ্লেষণ করেন ১৯৯১, ’৯৬, ’০১ ও ’০৮ সালের নির্বাচনের সব কেন্দ্রের ভোটের প্যাটার্ন (নমুনা)। ‘রাতের ভোট’খ্যাত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারিগরদের নিয়ে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এএসপি থেকে ডিআইজি পর্যন্ত যারা বিভিন্ন সময় (ওই বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর) পুলিশ সদর দপ্তরের ওই কক্ষে বসে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির ছক আঁকেন, এমন ৫৪ কর্মকর্তার তালিকা আমার দেশ-এর কাছে এসেছে। তাদের সবাই কপোতাক্ষের ওই বৈঠকগুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে নিশ্চিত করেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি ওই প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তবে গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তিনি নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি।
এর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) একটি গোপন প্রতিবেদনে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংস্থাটির তৎকালীন ডিআইজি (পলিটিক্যাল) মাহবুব হোসেন নেতৃত্বাধীন দলের প্রস্তুত করা রিপোর্টে বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলে মাত্র ১৪
আসন পেতে পারে।’ আর ওই প্রতিবেদনই হয়ে ওঠে ভোট ডাকাতির মূল উপলক্ষ।
কী ছিল ওই প্রতিবেদনে
এসবি কর্মকর্তা মাহবুবের ওই রিপোর্টের পর ভোট ডাকাতি করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। ওই টিমে ছিলেনÑঢাকা সিটি এসবির ডিআইজি মোহাম্মাদ আলী মিয়া, এজেডএম নাফিউল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (পলিটিক্যাল), বিশেষ পুলিশ সুপার (পলিটিক্যাল), ঢাকা এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার (গোপনীয়), পলিটিক্যাল শাখার সব অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার এবং সহকারী পুলিশ সুপার।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, সেনাপ্রধান, স্বরাষ্ট্র সচিব, নির্বাচন কমিশনের সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব। বৈঠকে সবাই যার যার বাহিনীর শক্তি ও সক্ষমতা নিয়ে কথা বলেন। সবশেষে তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘আমি নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন করে দিতে পারব। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ২৯০ আসনে বিজয়ী করে আনতে পারব।’
বৈঠকে তিনি আরো বলেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশের সবচেয়ে বেশি ফোর্স মোতায়েন থাকে এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক অনেক দিনের। সব ভোটকেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন থাকায় কাজটি ভালোভাবে (ভোট ডাকাতি) করা যাবে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের তত্ত্বাবধানে পুলিশের একটি অ্যানালাইসিস টিম কাজ করছে। তাদের কাজ প্রায় শেষ। বাংলাদেশের কোন কেন্দ্রে কত ভোট ‘কাস্ট’ করতে হবে, এটা পুলিশের এই টিম ইতোমধ্যে পর্যালোচনা করেছে।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশ না করে আমার দেশকে বলেন, জাবেদ পাটোয়ারী সেখানে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার সঙ্গে এক ধরনের বার্গেইন করে ‘পুরো অপারেশনটি’র (ভোট ডাকাতি) দায়িত্ব নিয়ে নেন।
‘টিম জাবেদ’-এর সদস্য কারা
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, জাবেদ পাটোয়ারীর একটি বিশ্বস্ত টিম ছিল, যে টিমের সদস্যরা সব গোপন কাজ করতেন। ভোট ডাকাতির নীলনকশা তৈরিতেও ভূমিকা ছিল ওই দলের। সেটি পরিচিত ছিল ‘টিম জাবেদ’ নামে।
ওই কোর টিমের সদস্য ছিলেনÑএসবির ডিআইজি (পলিটিক্যাল) মাহবুব, সিটিটিসির (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) মনিরুল ইসলাম, এসবির বিশেষ পুলিশ সুপার (গোপনীয়) মিজানুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (এলআইসি) এএফএম আনজুমান কালাম, এআইজি (অ্যাডমিন) মিলন মাহমুদ, এআইজি (আরঅ্যান্ডসিপি-১) মোহাম্মাদ মাহফুজুর রহমান আল-মামুন, পুলিশ সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসার টু আইজিপি মাসুদ আলম, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুনসুর আলম কাদেরী এবং কাজী মো. সালাহউদ্দিন।
কপোতাক্ষে ছিল গোপন কন্ট্রোলরুম
কক্ষটি সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের পক্ষে নিতে ভোটের তিন মাস আগে প্রলয় কুমার জোয়ার্দারের তত্ত্বাবধানে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়। ওই টিমের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ডিআইজি (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন। ভোট ডাকাতির গোপন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরের নতুন ভবনের দোতলায় ‘আনঅফিসিয়াল কন্ট্রোলরুমটি’ স্থাপন করা হয়। কক্ষটির বর্তমান নাম ‘হল অব গ্র্যান্ড’। আগে নাম ছিল ‘কপোতাক্ষ’। আনোয়ার হোসেন বর্তমানে পলাতক।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কপোতাক্ষে অফিসিয়াল সব কাজ বাদ দিয়ে ভোট ডাকাতির জন্য একদল সংঘবদ্ধ পুলিশ কর্মকর্তা কাজ করেন। সেখানে বসানো হয় অত্যাধুনিক কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার ও প্রজেক্টর। অ্যানালাইসিস টিমের সদস্য ছাড়া অন্য কোনো পুলিশ অফিসার রুমটিতে প্রবেশ করতে পারতেন না। রুমের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ডিআইজি আনোয়ার, এআইজি নাসিয়ান ওয়াজেদ, এসপি খোরশেদ আলম, মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান ও মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান আল মামুন (২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর পুলিশ সুপার পদোন্নতিপ্রাপ্ত)।
ডেটা বিশ্লেষণের নামে ষড়যন্ত্র
ডেটা, অ্যালগরিদম ও স্বয়ংক্রিয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দেওয়া যায়, এটা মাথায় রেখে পুলিশের ওই কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশন থেকে বিভিন্ন ডেটা সংগ্রহ করেন। ১৯৯১, ’৯৬, ’০১ ও ’০৮ সালের নির্বাচনে কোন আসনের কোন কেন্দ্রে বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ কত ভোট পেয়েছে, তার ডেটা অ্যানালাইসিস করা হয়; যাতে কোন কেন্দ্রে কত ভোট আগের রাতে বাক্সে ভরতে হবে তা নির্ধারণ করা যায়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার যারা হন, তাদের আগে থেকে ভেটিং করে যাচাই করার সুপারিশও করেন ওই টিমের সদস্যরা। কোনো প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার যাতে কোনোভাবেই বিএনপি ও জামায়াত মনোভাবাপন্ন না হয়। এমনকি তাদের নিকটাত্মীয়দের মধ্যেও বিএনপি ও জামায়াতপন্থি কেউ থাকলেও তাকে নির্বাচনের দায়িত্বে রাখা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্বাচনের আগেই সব থানার মাধ্যমে এ বিষয়ে ভেটিং করার জন্য বলা হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনের আগেই থানা পুলিশ ও এসবির মাধ্যমে সব প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারের ভেটিং করা হয়।
কপোতাক্ষে যারা কাজ করেছিলেন, তাদের চারটি ভাগে ভাগ করে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। পুরো দেশকে চার বিভাগে ভাগ করেন তারা। এরপর মেট্রোপলিটন ও রেঞ্জ এলাকাকে আবার আলাদা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মূলত ভোট ডাকাতি কীভাবে করা হবে, তার একটি রিহার্সেল এখানে আগেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ডিআইজি আনোয়ার, এআইজি নাসিয়ান, এসপি খোরশেদ আলম ও আল মামুন এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে জমা দেন। এরপর জাবেদ পাটোয়ারী ওই রিপোর্ট প্রেজেন্টেশন আকারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করেন। ২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর সব জেলার এসপি, রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ কমিশনারের কাছে এ তথ্য পাঠানো হয়, যাতে তারা সহজে কোন কেন্দ্রে কত ভোট ডাকাতি করতে হবে তা বুঝতে পারেন।
পুলিশের গোপন সমন্বয় কমিটি
সূত্রটি আরো জানায়, ভোটের আগেই বাক্স ভরার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সচিব, আইন সচিব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার একাধিক গোপন বৈঠক হয়। ভোট ডাকাতি নির্বিঘ্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন সচিব হেলাল উদ্দীন আহমদ, আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক (দুলাল) এবং আল মামুনের মধ্যে একাধিক গোপন বৈঠক হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরে ২০১৮ সালে কাজ করেছেন এবং এখনো কাজ করছেন এমন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই এই তিন কর্মকর্তা একাধিক গোপন বৈঠক করেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত আল মামুন সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেন নির্বাচন কমিশন ও আইন মন্ত্রণালয়ের এই দুই শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে যাতে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা যায়। আল মামুনের কাজ ছিল নির্বাচন কমিশন থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ডেটা সংগ্রহ করা। আর এই তিন কর্মকর্তা তিনটি সংস্থার পক্ষে সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন।
ভোটের আগেই অনেক ডিসি এবং এসপিকেও মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল কোন আসনের ভোট কীভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে আগে থেকেই কাজ করছিল একটি টিম। এসব বিষয়ে কোনো লিখিত নির্দেশনা ছিল না কিন্তু তারা জানত কার জন্য কী করতে হবে। জাবেদ পাটোয়ারীর প্রত্যক্ষ নির্দেশেই আল মামুনকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ফাইনাল রিপোর্ট, রিহার্সেল থেকে বাস্তবায়ন
২০১৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ভোটের মাত্র দুদিন আগে গোপন কন্ট্রোলরুম থেকে তৈরি করা ফাইনাল রিপোর্ট এবং নির্দেশিকা পাঠানো হয় দেশের ৬৪ জেলার সব এসপি, আট রেঞ্জের ডিআইজি এবং সব মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে। রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় কোন কেন্দ্রে কত ভোট ‘প্রয়োজন’।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ওই গোপন টিম রিহার্সেল করে। তারা বিভিন্ন কেন্দ্রে কীভাবে ভোট ডাকাতি করা হবে, কীভাবে ব্যালট বাক্স ভরা হবে এবং কীভাবে বিরোধী দলের এজেন্টদের বিতাড়িত করা হবেÑতার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। জাবেদ পাটোয়ারী ব্যক্তিগতভাবে ওই রিপোর্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করেন এবং ‘অপারেশন সফল’ করার চূড়ান্ত গ্যারান্টি দেন।
ভোট ডাকাতির তথ্য গোপনে বিশেষ সতর্কতা
প্রক্রিয়াটি কাছ থেকে দেখেছেন এমন এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে আমার দেশকে বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান ও তার সহযোগী কিছু অফিসার, মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনার, অ্যাডিশনাল কমিশনার, জয়েন্ট কমিশনার, ডিবি (ইনচার্জ ও এসি তদূর্ধ্ব সব অফিসার) ডিসি (ক্রাইম), এডিসি (ক্রাইম), এসি (ক্রাইম), জেলা পুলিশ পর্যায়ে রেঞ্জ ডিআইজি, অ্যাডিশনাল ডিআইজি, সব জেলার পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সার্কেল, সহকারী পুলিশ সুপার সার্কেল ও সব থানার ওসি, পরিদর্শক (তদন্ত ও অপারেশনস) এবং ডিবির সব কর্মকর্তা ভোট ডাকাতির কথা নির্বাচনের আগে থেকেই জানতেন।
বিভিন্ন ইউনিট থেকে যেসব ফোর্স নির্বাচনের ডিউটি করার জন্য জেলায় মোতায়েন করা হয়, তাদের ভোটের আগের দিন সন্ধ্যায় বাক্স ভরার কথা জানানো হয়। ভোটের আগের রাত অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর রাত ১১টার পর জেলার এসপি ও মেট্রোপলিটন এলাকায় ডিসি (ক্রাইম)-এর মাধ্যমে সব কেন্দ্রে মোতায়েন করা পুলিশ সদস্যদের জানানো হয় কোন কেন্দ্রে কত ভোট ডাকাতি করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী অ্যানালাইসিস টিমের নির্দেশনায় ডিসি ও ইউএনওর প্রতিনিধি এবং গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সম্মতিতে স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা ব্যালট বাক্স ভরে রাখেন।
২৯ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জাবেদ পাটোয়ারী, ডিসি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ডিআইজি আনোয়ার, ডিআইজি হাবিব, এআইজি নাসিয়ান, খোরশেদ আলম বিষয়টি মনিটরিং করেন। এরপরও কেউ কেউ অতিউৎসাহী হয়ে অনেক কেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট (১০০ শতাংশ বা তার বেশি) কাস্ট করেন। পরে ডিসি অফিসে বসে ফলাফল ‘সংশোধন’ করে ১০০ শতাংশ ভোট কাস্ট দেখানো হয়।
কী ঘটেছিল সে রাতে
ওই সময় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। ভিডিওটিতে দেখা যায়, কিছু নাগরিক ভোট দিতে না পেরে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের শরণাপন্ন হন। ওই গাড়িটি সেখান থেকে সটকে পড়ে। এভাবেই রাতের আঁধার থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে ভোট ডাকাতি করা হয়।
সেদিন বিটিআরসি মোবাইল কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়, যেন ফোনে ৪জি/৩জি ‘দেখায়’ কিন্তু ইন্টারনেট কার্যত বন্ধ থাকে। দুপুরের পর সব টিভি ও সংবাদমাধ্যমকে চাপ দেওয়া হয় যেন কোনো বিরূপ খবর না প্রকাশ করে। শুধু যমুনা টিভি শুরুতে কিছু অনিয়মের চিত্র প্রচার করে কিন্তু বিকালে তারাও অবস্থান পরিবর্তন করে।
শেখ হাসিনার পতনের পর ২০২৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি জেলার এসপিসহ কিছু অফিসারকে ওএসডি করা হয়। এছাড়া অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পলাতক আছেন এবং কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
পুলিশ সদরদপ্তরে কপোতাক্ষ কক্ষে তৈরি করা ভোট চুরির নীলনকশা নিয়ে এসবি কোনো তদন্ত করছে কিনা জানতে চাইলে সংস্থাটির ডিআইজি মাহমুদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কথা বলার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নই। পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্রকে জিজ্ঞেস করেন।’
তবে পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেনকে এ বিষয়ে গত ১৪ নভেম্বর বার্তা পাঠালেও তিনি রহস্যজনক কারণে এর জবাব দেননি।