ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে, এ দেশে যেকোনো সময় বড়-মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। রিখটার স্কেলে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের পরিণতি হতে পারে ভয়ংকর। যদি এমন পরিস্থিতি কখনো হয়, তাহলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অপরিকল্পিত এ নগরে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় ঘটলে সে সময় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা কি এ সংস্থার আছে? সংস্থাটির জনবল, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং লজিস্টিক সাপোর্টের সক্ষমতা আসলে কতটুকু?
অনুসন্ধান বলছে, প্রস্তুতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনো অপ্রতুল। এছাড়া আমলাতান্ত্রিক ও কাঠামোগত জটিলতাও রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বিগত কয়েক বছরে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। অগ্নিনির্বাপণের পুরোনো পদ্ধতির পাশাপাশি ‘সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ’ বা অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজে আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা সাধারণ অগ্নিকাণ্ডের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভূমিকম্পে ভবন বা স্থাপনা ধসে পড়ার কারণে সাধারণ পাম্প বা বড় গাড়ি খুব একটা কাজে আসে না। সেখানে প্রয়োজন হয় সূক্ষ্ম ও বহনযোগ্য যন্ত্রপাতির।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার আমার দেশকে বলেন, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবন ও ভেঙে যাওয়া অবকাঠামোতে দ্রুত উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য তাদের হাতে বেশকিছু অত্যাধুনিক ‘লাইট সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ’ ইকুইপমেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ‘অ্যাকুস্টিক লিসেনিং ডিভাইস’ অন্যতম, যা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকেপড়া মানুষের গোঙানি বা সামান্য নড়াচড়ার শব্দও শনাক্ত করতে পারে। এছাড়াও রয়েছে ‘স্নেক আই ক্যামেরা’, যা সরু ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে গভীরে থাকা ভুক্তভোগীর অবস্থান ও অবস্থা দেখা যায়। রড ও কংক্রিট কাটার জন্য ‘রোটারি রেসকিউ স’, হাইড্রোলিক স্প্রেডার ও কাটার এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ড্রোন প্রযুক্তিও যুক্ত হয়েছে তাদের বহরে। তুরস্ক ও মিয়ানমারের ভূমিকম্পে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তাদের এ সক্ষমতার প্রমাণও দিয়েছে।
পরিকল্পনা বনাম মাঠের বাস্তবতা
উপরের চিত্রটি আশাব্যঞ্জক মনে হলেও, মুদ্রার উল্টো পিঠ বেশ হতাশাজনক। দুর্যোগ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির একটি বড় অংশজুড়েই রয়েছে সরঞ্জামের ঘাটতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ১৯ বছরে কেনা উদ্ধার সরঞ্জামের একটি বিশাল অংশই এখন অচল বা মেয়াদোত্তীর্ণ। সশস্ত্র বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করা এসব সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণেও রয়েছে বড় ধরনের দুর্বলতা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনের বরাতে জানা যাচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীকে দেওয়া ২০ শ্রেণির ৮০৭টি সরঞ্জাম পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে। এছাড়া ৩৩ শ্রেণির ১৯১টি সরঞ্জাম জরুরি মেরামতের অপেক্ষায়। এর মধ্যে ভূমিকম্পের পর উদ্ধার কার্যক্রমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র—যেমন স্প্রেডার, র্যাম জ্যাক, ব্রিদিং অ্যাপারেটাস, কংক্রিট কাটার, ‘পাওয়ার চেইন স’ এবং ম্যানুয়াল ড্রিল মেশিন অন্যতম। জমে থাকা কংক্রিটের স্তূপ সরিয়ে প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষা করতে কিংবা অক্সিজেনের সংকট মেটাতে এসব যন্ত্র অপরিহার্য। অথচ প্রয়োজনের মুহূর্তে এসব যন্ত্র কাজ করবে কি না, তা নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে।
অন্যদিকে নতুন সরঞ্জাম সংগ্রহের গতিও অত্যন্ত মন্থর। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে এক হাজার ৮৫১ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প হাতে নেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। লক্ষ্য ছিল আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ। কিন্তু গত চার বছরে এ লক্ষ্যের মাত্র ২০ শতাংশ পূরণ হয়েছে। এর আগে দুই ধাপে ২০০৬ সাল থেকে কেনা হয়েছে ২১২ কোটি টাকার সরঞ্জাম।
জনবল সংকট ও প্রশিক্ষণের অভাব
দেশে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন রয়েছে ৫০০টির মতো। জনবল ১৫ হাজারেরও কম। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী এই সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। ঢাকায় যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, তবে হাজার হাজার ভবন ধসেপড়ার আশঙ্কা রয়েছে। লাখো মানুষ তখন ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়বে, তখন এ মুষ্টিমেয় জনবল কতটুকু পর্যাপ্ত?
যদিও ফায়ার সার্ভিস দাবি করছে, তাদের কর্মীরা তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে কাজ করে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশে এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ একাডেমি গড়ে ওঠেনি। বড় দুর্যোগে বিদেশ থেকে আসা উদ্ধারকারী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন অ্যান্ড রেসকিউ ট্রেনিং’ থাকা জরুরি, যা অধিকাংশ কর্মীরই নেই।
শাহজাহান শিকদার দাবি করেছেন, তাদের অভিজ্ঞ জনবল রয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি স্টেশনে বিশেষায়িত উদ্ধারকর্মীর সংখ্যা এবং জনবল কাঠামো বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি।
স্বেচ্ছাসেবক তৈরির উদ্যোগ
জনবলের এ বিশাল ঘাটতি মেটাতে এবং দুর্যোগের পর ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বা প্রথম এক ঘণ্টায় উদ্ধারকাজ শুরু করতে ফায়ার সার্ভিস স্বেচ্ছাসেবক তৈরির ওপর জোর দিয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী উদ্যোগ। অধিদপ্তরের লক্ষ্য হলো, ৬২ হাজার ‘আরবান কমিউনিটি ভলান্টিয়ার’ তৈরি করা, যার মধ্যে ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব স্বেচ্ছাসেবক স্থানীয় পর্যায়ে বসবাস করেন। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি জ্যাম ঠেলে পৌঁছানোর আগেই তারা হালকা যন্ত্রপাতি নিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করতে পারবেন। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মহড়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকেও প্রস্তুত করার চেষ্টা চলছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ভারী যন্ত্রপাতির চ্যালেঞ্জ
যন্ত্রপাতি ও জনবলের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানো। অপরিকল্পিত পুরান ঢাকা, মিরপুর কিংবা চট্টগ্রামের অনেক এলাকার রাস্তা এতটাই সরু যে, ভূমিকম্পে ভবন ধসে পড়লে সেই রাস্তাগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বা উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছবে কীভাবে? বড় ভূমিকম্পে ঢাকার ফ্লাইওভারগুলো ধসে পড়লে প্রধান সড়কগুলোও অচল হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আকাশপথে উদ্ধার তৎপরতা বা হেলি-রেসকিউই একমাত্র ভরসা। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব কোনো হেলিকপ্টার বা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নেই। এক্ষেত্রে পুরোপুরি সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হবে।
শাহজাহান শিকদার স্বীকার করেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের অনেক এলাকায় রাস্তা সংকীর্ণতার কারণে বড় দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষে একা উদ্ধারকাজ চালানো প্রায় অসম্ভব। তখন সিটি করপোরেশন, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ—সব সংস্থার সমন্বয় প্রয়োজন হবে।
তাছাড়া লাইট ইকুইপমেন্টের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস কিছুটা এগিয়ে থাকলেও ভারী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। বিশাল ওজনের স্ল্যাব সরানোর জন্য শক্তিশালী ক্রেন, এক্সকাভেটর এবং বুলডোজার প্রয়োজন। ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব কিছু ক্রেন থাকলেও পুরো ঢাকা শহরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। সিটি করপোরেশন এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভারী যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভর করা ছাড়া তখন উপায় থাকবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব যন্ত্র শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বা কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত থাকে। দুর্যোগ মোকাবিলার সরঞ্জাম শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে বিকেন্দ্রীকরণ না করে এক জায়গায় স্তূপ করে রাখলে প্রয়োজনের মুহূর্তে তা কোনো কাজেই আসবে না।
ঘাটতি মোকাবিলায় চলমান প্রচেষ্টা
এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আশার কথা হলো, সরকার ও ফায়ার সার্ভিস কিছু গঠনমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। ঢাকার মিরপুরে গঠন করা হয়েছে একটি ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার, যা বড় দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশকেন্দ্র বা ‘কমান্ড সেন্টার’ হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া ঢাকার পূর্বাচল ও বিভাগীয় পর্যায়ে ‘স্পেশাল রেসকিউ টিম’ গঠন করা হয়েছে। ঢাকা শহরে ৬০ সদস্যের একটি দ্রুত প্রতিক্রিয়া ইউনিট (কুইক রেসপন্স ইউনিট) প্রস্তুত রয়েছে এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে আরো ২০ জন করে এমন টিম তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের ‘সুইফট ওয়াটার রেসকিউ’ বা দ্রুত স্রোতে উদ্ধারের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে, যা ভূমিকম্প-পরবর্তী বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা জানালেন, তারা কেবল নিজস্ব সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছেন না, বরং দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করছেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, দুর্যোগ পরিকল্পনায় কর্মী ও পুনরায় প্রশিক্ষণসহ বেশকিছু বিষয়ে এখনো ঘাটতি রয়েছে।
প্রয়োজন সমন্বিত ও ত্বরিত পদক্ষেপ
সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড় ভূমিকম্প মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বর্তমানে ‘মাঝারি থেকে উচ্চ’ পর্যায়ের প্রস্তুতির পথে হাঁটছে। তাদের হাতে আধুনিক লাইট সার্চ ইকুইপমেন্ট রয়েছে, তুরস্কের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং স্বেচ্ছাসেবকের একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ও বড় আকারের ভূমিকম্প পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ সক্ষমতা অর্জনে এখনো বিশাল ঘাটতি বিদ্যমান।
জনবলের তীব্র সংকট, ভারী যন্ত্রপাতির অভাব, পুরোনো সরঞ্জামের অকেজো হয়ে পড়া এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নতুন সরঞ্জাম ক্রয়ে ধীরগতি—এ বিষয়গুলো বড় ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়। ভূমিকম্প বলে-কয়ে আসে না। তাই কেবল পরিকল্পনার ফাইলে আটকে না থেকে, মাঠপর্যায়ের প্রস্তুতিতে গতি আনা জরুরি। ফায়ার সার্ভিসের একার পক্ষে এ মহাদুর্যোগ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশন, রাজউক, সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সাধারণ জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবক তৈরি এবং তাদের হাতে উদ্ধারের সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া, অকেজো যন্ত্রপাতি দ্রুত মেরামত বা পরিবর্তন করা এবং ভারী যন্ত্রপাতি বিকেন্দ্রীকরণ করা এখন সময়ের দাবি।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার বলছেন, আমাদের প্রস্তুতি আছে, সাহস আছে, কিন্তু প্রকৃতির বৈরিতার সামনে টিকে থাকার মতো পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা অর্জনে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।