জাতীয় নীতিমালা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা জরুরি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
দুদিনে ৩১ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর চারটি ভূমিকম্পের পর রাজধানীসহ সারা দেশে জনমনে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে গত শুক্রবার সকালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ২০ সেকেন্ড ধরে আকস্মিক বড় ঝাঁকুনি বহুতল ভবনের বাসিন্দা, বিশেষত নারী ও শিশুদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা বা মানসিক ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। এমনকি রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন শহর-গ্রামের নারী-শিশুও এখন আতঙ্কে ভুগছে। ভূমিকম্পের পর থেকে অনেক শিশু গভীর রাতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠছে; নারীরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেক নারী ও শিশু এখন একাকী ঘুমাতে পারছে না। ভূমিকম্প আতঙ্কে তারা মাঝেমধ্যে আঁতকে উঠছে।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঠিক পাশের শহর নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আনোয়ার জানান, তার তিন বছর বয়সি মেয়ে গত শনিবার রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ‘ভূমিকম্প ভূমিকম্প’ বলে চিৎকার করে ওঠে। তার স্ত্রীও একইভাবে আতঙ্কে ভুগছেন। ঢাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী তাসফিয়া জানান, ভূমিকম্পের পর থেকে অফিসে বোতলের পানি নড়লেও মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে। এটি শুধু তারই নয়, পরিবারের সবার একই অবস্থা। বিশেষ করে শিশুরা প্রচণ্ড আতঙ্কে দিন পার করছে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক নারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, ভূমিকম্পের পর থেকে তার স্বাভাবিক জীবনে ব্যত্যয় ঘটছে। সব সময় মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তিনি।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ভূমিকম্প শুরু হতেই দ্রুত বাসা থেকে আমরা নিচে নেমে আসি। এখন রাতে ঘুমাতে গেলেও মনে হয় খাট দুলছে। সব সময় তীব্র মাথাব্যথা হচ্ছে। চোখ খুললেই মনে হচ্ছে ঘর কাঁপছে। ঠিকমতো ঘুম হয় না। সকালে উঠলে মাথা ঘোরে, শরীর দুর্বল লাগে। কাজে মনোযোগ দিতে পারছি না। পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও একই উপসর্গ দেখা গেছে।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সচরাচর ভূমিকম্প কম অনুভূত হওয়ায় মানুষের মধ্যে মানসিক প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। ফলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার মতো মাঝারি কম্পনও মানসিক স্বাস্থ্যে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এই আচমকা ঝাঁকুনি শিশু ও বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্যে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা পরবর্তীতে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে রূপ নিতে পারে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের আকস্মিকতা মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত ভীতি, প্যানিক অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত, বিভ্রান্তি ও ঝাঁকুনির মতো অনুভূতির উপসর্গ তৈরি করে। এ ধরনের দীর্ঘদিনের মানসিক চাপ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি জটিলতার মতো দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা বাড়িয়ে দেয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, ভূমিকম্পের মতো হঠাৎ দুর্যোগ মানুষের চিন্তা ও অনুভূতিকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। এই মানসিক চাপ অনেক সময় এতটাই বেড়ে যায় যে, তা দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) রূপ নিতে পারে। নারী ও শিশুদের মধ্যে এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ওষুধ, সাইকোথেরাপি, গ্রুপথেরাপি ও ইএমডিআর সমন্বিতভাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
জাপান, চীন ও নেপালের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোতে আকস্মিক দুর্যোগের পর জনসাধারণের গুরুতর চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক ধাক্কা সামাল দিতে জাতীয় নীতিমালা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও দুর্যোগে মানসিক অস্থিরতা কমাতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. জিনাত ডে লায়লা জানান, জাপান বা চীনের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলোর আদলে বাংলাদেশেও মানসিক ধাক্কা সামাল দিতে জাতীয় নীতিমালা ও বিশেষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে গেছে। যদিও বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; এরপরও অনেকের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এটা হয়তো অনেকে বেশ কিছুদিন ধরে বহন করতে পারেন; পরে তা বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হতে পারে। তবে এ ধরনের আতঙ্কের বিষয়টি সাধারণত ধীরে ধীরে কেটে যেতে পারে। যদি কেউ অনেক দিন ধরে এ ধরনের আতঙ্কে ভোগেন এবং কোনোমতেই নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে তাকে অবশ্যই একজন মানসিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে কাউন্সেলিং নিতে হবে।