দুদকের অনুসন্ধান শুরু
জুলাই বিপ্লবের পর তৎকালীন আওয়ামী সরকারের রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ তালিকায় নাম আসে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে শাফি মোদ্দাছির খান জ্যোতির। তিনি পেশিশক্তি ও পুলিশের হয়রানির ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিতেন কোটি কোটি টাকার টেন্ডার। তার নামে এখন পর্যন্ত দুদকে তিনটি মামলা হয়েছে।
জানা গেছে, জ্যোতিকে মেসার্স তিতাস নামে একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়ে রাখেন তার বাবা কামাল। প্রতিষ্ঠানটির নামেই চলত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রতিষ্ঠানের নামে টেকনাফের মিঠাপানির ছড়া ১ নম্বর প্লটে পাঁচ একর জমি কেনা হয়। লেঙ্গুরবিল মৌজায় একই কোম্পানির নামে কেনা জমির দাম প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের অমোচনীয় কালি কেনার দুর্নীতির সঙ্গেও জ্যোতির নাম উঠে আসে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শুধু অমোচনীয় কালি কিনতেই এক কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয় করে জ্যোতি সিন্ডিকেট। এছাড়া আরো ছয় কোটি টাকার অমোচনীয় কালি কেনে নির্বাচন কমিশন, যার টেন্ডার বাগিয়ে নেন জ্যোতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যেসব নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য হতো, তা থেকে মোটা অঙ্কের ভাগ পেতেন জ্যোতি। এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন জ্যোতির টেন্ডারম্যান সেলিম। এছাড়া পণ্য ক্রয় ও গাড়ি সরবরাহের টেন্ডারও নিয়ন্ত্রণ করতেন সেলিম।
সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কামালের ছেলে জ্যোতিকে আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জ্যোতির দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জ্যোতি ও তার বাবা কামাল ১৯ কোটি ৮৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক নিজ ভোগদখলে রাখা এবং তার নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে নিজ এবং ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহৃত ব্যাংক হিসাবে মোট ৮৪ কোটি ৭৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭২ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর, স্থানান্তরের মাধ্যমে সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেন করেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। দুজনের নামে দুদক একটি মামলাও করেছে। ওই মামলায় জ্যোতিকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দিয়েছে আদালত।
দুদক জানায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল ঘুস হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন, যা নিয়ন্ত্রণ করতেন জ্যোতির টেন্ডারম্যান সেলিম। পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে এ টাকা আদায় করা হতো। টেন্ডারম্যান সেলিম ছাড়াও এ সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন। আর পুরো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন জ্যোতি। টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন সেলিম। এছাড়া একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে সেলিম তদবির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। দুদকের ধারণা, জ্যোতির টাকার বড় একটি অংশ রয়েছে সেলিম মোল্লার কাছে।
এ বিষয়ে জানতে সেলিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জ্যোতির বিরুদ্ধে আরো যত অভিযোগ
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের জন্য বিখ্যাত। ওই এলাকায় ছিল জ্যোতির একচ্ছত্র আধিপত্য। জানা গেছে, ওই এলাকায় রেস্টুরেন্ট চালু করতে হলে জ্যোতিকে দিতে হতো প্রায় দেড় কোটি টাকা। টাকা দিলে কোনো থরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই মিলত লাইসেন্স। শুধু তাই নয়, ওই সব রেস্টুরেন্ট থেকে যেসব চাঁদা নেওয়া হতো, তাও এক হাতে সামলাতেন জ্যোতি।
আরো জানা গেছে, কামালের নামে শুধু রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকেই প্রতিদিন দেড় কোটি টাকার চাঁদা তোলা হতো। ফুটপাতে ব্যবসা, বাজার, মাদক ব্যবসায়ী ও আবাসিক হোটেল থেকে ওঠানো হতো এসব চাঁদা। এ টাকা মন্ত্রীর হয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন জ্যোতি। টাকার ভাগবাঁটোয়ারার দায়িত্বে ছিলেন সেলিম।
দুদকের জালে সেলিম
দুদকের মাঠপর্যায়ের তদন্তে জ্যোতির একাধিক টেন্ডারম্যান ও পুলিশি তদবিরে মোটা অঙ্কের ঘুস লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের তথ্য আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সেলিমের নাম উঠে আসে। সেলিম পুলিশের পণ্য ক্রয়ের টেন্ডারে জ্যোতির পছন্দের ঠিকাদারদের টেন্ডার ড্রপ করাতেন। মেট্রোরেলের একাধিক পণ্য ক্রয়ের টেন্ডারে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। মেগা প্রজেক্ট মেট্রোরেলের (ঢাকা মাস ট্রানজিড কোম্পানি লিমিটেড) লাইন-৫, নর্দান রুট প্রকল্পের গাড়ি সরবরাহকারী হিসেবে ছয়জন ঠিকাদার অংশগ্রহণ করেন।
ওই প্রকল্পে সেলিম রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে জ্যোতির আশকারায় তৎকালীন প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে এক কোটি টাকার ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করেন। পরে অন্য অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ছাড়াই গাড়ি সরবরাহের আদেশ দেওয়া হয় বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। ওই টেন্ডারের আইডি নম্বর ৮০৯৮৬৭, তারিখ ১৬/০৪/২০২৩।
অভিযোগ রয়েছে, টেন্ডারের চাহিদা অনুযায়ী গাড়ি সরবরাহ না করে অনিয়মের মাধ্যমে পুরোনো মডেলের গাড়ি সরাবরাহের মাধ্যমে গাড়ির ভাড়া ও জ্বালানি তেলের কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়, যার পুরোটা গেছে জ্যোতি সিন্ডিকেটের হাতে। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় টাকার অপচয় হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক টেন্ডারে সেলিম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সেখানেও তিনি জ্যোতির প্রভাব খাটাতেন। সেখান থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। বরগুনার বেতাগীর সড়কে তিন কোটি টাকার টেন্ডার হাতিয়ে নিয়েছিলেন সেলিম। ওই টেন্ডারে জ্যোতির প্রভাব খাটান তিনি। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাড়িতে ঠিকাদারদের মিলনমেলা বসত। জ্যোতির সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়া এবং অন্য ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামেও সেলিম হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা।
দুদক জানায়, সেলিমের সঙ্গে শেরেবাংলা নগরের আরেক টেন্ডারবাজ কাজলও জড়িত বলে জানা গেছে। ঢাকার অদূরে সাভারে পাঁচ কাঠার প্লট, মোহাম্মাদপুরে নামে-বেনামে ফ্ল্যাট এবং ভোলায় প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বন্ডের মাধ্যমে আরো ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা আছে। এ সম্পদের মধ্যে জ্যোতির বিনিয়োগ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জ্যোতির নামে দুদকের মামলার চার্জশিট
জ্যোতি এবং তার বাবা কামাল ও মায়ের নামে ২২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ৮৭ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে একটি চার্জশিট দাখিল করেছে দুদক। গত ১৮ ডিসেম্বর দুদকের পক্ষ থেকে এ চার্জশিট দেওয়া হয়।
জানা গেছে, গত বছরের ৯ অক্টোবর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কামালের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলার তদন্তে কামালের স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, তার ছেলে জ্যোতি ও মেয়ে শাফিয়া তাসনিম খানের সম্পৃক্ততা পায় দুদক। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, কামাল ও তার ছেলে জ্যোতি অসাধু উপায়ে অপরাধমূলক অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ২২ কোটি ৫৮ লাখ ৪০ হাজার ১৬২ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন। এছাড়া আসামিরা ৯টি ব্যাংক হিসাবে ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৩ টাকা লেনেদেন করে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ ‘দুর্নীতি ও ঘুস’ সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করেছেন।
জ্যোতির নামে আরেক মামলা
২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে বদলি, পদোন্নতি ও জনবল নিয়োগে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুস নেওয়াসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালসহ তার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতি দমন কমিশনের চার মামলায় আসামি হয়েছেন। অন্যরা হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ছেলে সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি এবং মেয়ে শাফিয়া তাসনিম খান।
মামলায় আসাদুজ্জামানের পরিবারের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি ৫৫ লাখ টাকার অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ৩৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৪১৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কামাল অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রেখে এবং আটটি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনকভাবে ৫৫ কোটি ৯২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩৬ টাকা লেনদেন করে মানি লন্ডারিংয়ে সম্পৃক্ত অপরাধ ‘দুর্নীতি ও ঘুস’ সংঘটনের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে রূপান্তর বা স্থানান্তর বা হস্তান্তর করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের সাপ্লাই বিভাগের টেন্ডারে অংশ নেওয়া খিলগাঁওয়ের এক ব্যবসায়ী জানান, আওয়ামী লীগের আমলে জ্যোতির লোকজনের চাপের কারণে আমরা টেন্ডার ড্রপ করতে পারতাম না।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন জানান, জ্যোতি এবং সহযোগীদের দুর্নীতির অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত আছে।