হোম > আমার দেশ স্পেশাল

সাজানো চার্জশিটে বছরের পর বছর জেলে ধুঁকছেন বহু আলেম

কিবরিয়া হত্যা মামলা

সাইদুর রহমান রুমী

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় বিতর্কিত চার্জশিটের কারণে বছরের পর বছর ধরে কারাগারে অন্তরীণ রয়েছেন বহু নিরপরাধ আলেম।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, কিবরিয়া হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে মোট তিনবার চার্জশিট দাখিল করা হয়, যার একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। মামলার প্রথম ও দ্বিতীয় চার্জশিটে যাদের নামই ছিল না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা মামলায় জড়ানো হয়। একই মামলায় বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, জি কে গউছসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক আসামি জামিনে মুক্ত হলেও আলেমরা এখনো জেলের ঘানি টানছেন।

তিন দফায় চার্জশিট বদল

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ-পরবর্তী জনসভায় গ্রেনেড হামলায় শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত এবং অন্তত ৭০ জন আহত হন। ঘটনার পরদিন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মজিদ খান হত্যা মামলা দায়ের করেন।

২০০৫ সালের ১৮ মার্চ সিআইডি তড়িঘড়ি করে শহীদ জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের সভাপতি আবদুল কাইয়ুমসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করে। তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুল ইসলাম (আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি করা হয়)। এ অভিযোগপত্রে বাদীপক্ষ নারাজি দিলে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেয়।

২০১১ সালের ২০ জুন দ্বিতীয় দফায় হঠাৎ করে আসামির সংখ্যা বাড়িয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এই চার্জশিট নিয়েও কিবরিয়া পরিবারের পক্ষ থেকে আপত্তি ওঠে।

সবশেষ ২০১৫ সালের ১১ মার্চ সিআইডির তৃতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা পারুল ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এই চার্জশিটেই সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বিরোধীদল ও তথাকথিত জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ দেখাতে স্বনামধন্য কয়েকজন আলেমকে যুক্ত করা হয়। এই চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত আলেমদের মধ্যে রয়েছেন মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা শেখ ফরিদ, মুফতি মইনুদ্দিন শেখ, মাওলানা আবদুস সালাম, মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা তাজউদ্দিন ও হাফেজ সৈয়দ নাইম আহমেদ। এর মধ্যে মাওলানা আবদুস সালাম ও মাওলানা ইয়াহিয়া জেলে থাকা অবস্থায় রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। এএসএম কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া ও তার পরিবার বার বার এ সাজানো বিচারের বিরোধিতা করেছেন।

বন্দি আলেমদের মধ্যে হাফেজ সৈয়দ নাইম আহমেদ ছিলেন সুনামগঞ্জ জগন্নাথপুর এলাকার জমিয়তে উলামা ইসলামের জনপ্রিয় নেতা। ২০০৬ সালে একবার তিনি গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে নতুন করে কিবরিয়াসহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়। এসব মামলায় তিনি সম্পূর্ণ নিরপরাধ প্রমাণিত হলেও দীর্ঘ ১৯ বছর এখনো জেলে অন্তরীণ।

মাওলানা শেখ ফরিদ ও মুফতি মইনুদ্দিন শেখ উভয়েই বিখ্যাত ইসলামিক বক্তা ও জনপ্রিয় আলেম। ২০০৯ সালেই তাদের উভয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। বয়োবৃদ্ধ মুফতি আবদুল হাই ৯০ দশকের জনপ্রিয় ‘জাগো মুজাহিদ’ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সে সময়ই তাকে একবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিবরিয়া হত্যা মামলায় ২০২২ সালে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়।

বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করা মুফতি শফিকুর রহমান ইসলামী ঐক্যজোটকে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটে নিয়ে আসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাকেও ২০২২ সালে কিবরিয়া হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ।

এসব আলেমকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, কোটালিপাড়া শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলা, রমনা বটমূল বোমা ও সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা মামলাতে মুফতি হান্নানের একটি কথিত জবানবন্দির ভিত্তিতে ফাঁসানো হয়। এর ওপর ভিত্তি করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাকেও ২১ আগস্ট মামলায় ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি ২১ আগস্ট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মুফতি হান্নানের কথিত জবানবন্দির কোনো আইনি ভিত্তি নেই উল্লেখ করে বিএনপি নেতাদের সবাইকে খালাস দেন। কিন্তু আলেমদের মুক্তির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে জুলাই পরবর্তী সময়েও এসব আলেম নোয়াট মামলাগুলোতে দণ্ড মাথায় নিয়ে নিয়ে কারাগারে অন্তরীন ।

আলেমদের জড়াতে আমার ওপর চাপ ছিল

কিবরিয়া হত্যা মামলার শেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা পারুল বর্তমানে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল–১–এ সাক্ষ্য দিচ্ছেন। জবানবন্দিতে তিনি স্বীকার করেন, যেসব আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, মুফতি হান্নানসহ তাদের কেউ স্বীকারোক্তি দেয়নি। রাজনৈতিক চাপের মুখে বিএনপি নেতা আরিফুল হকসহ কয়েকজনকে আসামি করতে হয়েছে। তিনি আরো স্বীকার করেন, ভুয়া চার্জশিট দাখিলের কারণে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাকে পুরস্কৃতও করে।

এদিকে আদালত থেকে মেহেরুন্নেসা পারুলকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য উপস্থিত হতে বলা হলেও নানা টালবাহানায় এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলেন তিনি। বেশ কয়েক দফায় হাজির হতে বলার পর গত ৮ অক্টোবর তিনি ট্রাইব্যুনালে হাজির হন। সেদিনও অসুস্থতাসহ নানা অজুহাত দেন। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের আপত্তি এবং আদালত তাকে সিআইডি হেফাজতে নেওয়ার কথা বললে তিনি আদালতে শুধু নাম-ঠিকানা বলে চলে যান। পরবর্তী সময়েও তার এই টালবাহানা অব্যাহত থাকে। আদালত জেরার জন্য ২১ অক্টোবর দিন নির্ধারণ করলেও তিনি চোখের ছানি অপারেশনের কথা বলে বলে হাজির হননি। পরে ৪ ও ১১ নভেম্বর সিলেট আদালতে হাজির হওয়ার কথা থাকলেও তিনি হাজির হননি। সর্বশেষ ২৪ নভেম্বরও তিনি আদালতে হাজির হননি। এ নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ও ভুক্তভোগী পরিবারের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের দাবি, মেহেরুন্নেসা পারুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এই মামলার বানোয়াট চার্জশিট কীভাবে ও কার নির্দেশে বানিয়েছেন তা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বোমা হামলার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা— রেজা কিবরিয়া

সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া বলেছেন, সাড়ে ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা আমার বাবার হত্যাকারীদের রক্ষা করেছেন। এতে সন্দেহ হয়, তার নির্দেশেই এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। তিনি বলেন, বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশে মামলা–তদন্তকে বারবার ঘোলা করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় হবিগঞ্জের সাবেক এমপি আবু জাহির, সাবেক এমপি আব্দুল মজিদ খান ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী আমার পিতাকে হত্যা করেছে।

নিরপরাধ ভাই ২০ বছর জেলে

জেলে অন্তরীণ হাফেজ সৈয়দ নাইমের ছোট ভাই সৈয়দ মারুফ আহমদ আমার দেশকে বলেন, কিবরিয়া হত্যা মামলার প্রথম দুই চার্জশিটে তার ভাইয়ের নাম না থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে যুক্ত করা হয়। ১১৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে বিএনপি ও ইসলামিক নেতাদের নাম জড়িয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাতে রাজি না হওয়ায় ১৯ বছর ধরে তিনি কারাগারে। তার মামলায় ভূমিকা রাখার কারণে আমাকেও ২২ দিন গুম করে রাখা হয়েছিল। আরেক কারাবন্দি মুফতি শফিকুর রহমানের জামাতা গিয়াস উদ্দিন জানান, আমার শ্বশুর ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোট গঠনের অন্যতম কারিগর। এতেই শেখ হাসিনার টার্গেটে পরিণত হন তিনি।

হাসিনা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আলেমদের জড়িয়েছে

মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও মাওলানা শেখ ফরিদের আইনজীবী আবুল কাশেম আমার দেশকে বলেন, এসব আলেম আদালতের বিভিন্ন রায়ে ও পুলিশি তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। কিবরিয়া হত্যা মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তাও তার জবানবন্দিতে বলেছেন শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে তিনি তাদের আসামি হিসেবে ঢুকিয়েছেন। কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে তারা এখনো কারাবন্দি রয়েছেন।

কমিটি গঠনের সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সময় বিরোধী দলের বিভিন্ন নেতাকর্মী বিশেষ করে নিরীহ আলেমদের স্পর্শকাতর যে সব মামলায় জড়ানো হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত সুষ্ঠু সমাধানে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন আমার দেশকে বলেন, কিবরিয়া হত্যা মামলা, উদীচী, কোটালি পাড়ায় শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন মামলায় বিএনপি-জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা-কর্মীরা জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু নিরীহ আলেমরা এখনো জেলে বন্দি। এসব স্পর্শকাতর মামলা পুনঃতদন্তে পুলিশ, আইনজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিটি গঠন জরুরি।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, আরভাইনের গবেষক খন্দকার রাকিব এ বিষয়ে বলেন, কিবরিয়া হত্যা মামলাটিতে কয়েক দফা চার্জশিট পরিবর্তন করে ক্রমাগত অভিযুক্তের সংখ্যা বাড়িয়ে কথিত আসামিদের বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয়, এই মামলাগুলো ন্যায়বিচারের নয়, বরং ক্ষমতাসীনদের সন্দেহ ও শত্রু–চিন্তার ওপর দাঁড়ানো ছিল, যেখানে তারা ইচ্ছেমত যে কাউকে আইনের রশির মাঝে নিয়ে আসে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব তথাকথিত মামলা মূলত অন্যদের প্রতি বার্তা, যেখানে ক্ষমতাবানরা চাইলে যে কাউকে হুমকি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে, আর আইন-আদালত সেই সংজ্ঞার পথেই হাঁটে। অসংখ্য মামলা দিয়ে এভাবে আটক করে মামলার দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করার প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করে, সেখানে মামলার নিষ্পত্তি নয়, বরং মামলা চলমান রাখাই হয়ে ওঠে মূল লক্ষ্য।

জামায়াত ও সমমনাদের নির্বাচনি জোট অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা

হিন্দুত্ববাদী ভারতের কপট মাইনরিটি কার্ড

কামালের দাপটে ছেলে জ্যোতিরও বিপুল অবৈধ সম্পদ

মেট্রোস্টেশনে মেলে প্রাথমিক চিকিৎসা, জানেন না যাত্রীরা

পাঠ্যবই পরিমার্জনে গুরুত্ব পেল জুলাই বিপ্লব

চালু হচ্ছে বহু প্রতীক্ষিত বাণিজ্যিক আদালত, প্রস্তুতি সম্পন্ন

বিশাল সংবর্ধনায় আজ ফিরছেন তারেক রহমান

জামায়াতকে হাতে রেখে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় এনসিপি

বাংলাদেশ মিশন ঘিরে হিন্দু জঙ্গিদের তাণ্ডব

কৃষক লীগ ক্যাডারের কারবার চালান স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা