পৌষের শুরুতেই সারা দেশে শীতের দাপট বেড়েছে। শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। নিম্ন আয়ের মানুষ কাজের সন্ধানে বের হতে পারছেন না। এতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শীতের প্রচণ্ডতায় শিশু ও বৃদ্ধরা নানারোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। কুয়াশার কারণে সড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। অনেক স্থানে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হচ্ছে। সরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ নেই।
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, চুয়াডাঙ্গায় কমছে না শীতের তীব্রতা। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকছে চারপাশ। তাপমাত্রার পারদ নেমেছে ১০ ডিগ্রির ঘরে। সকাল থেকে সূর্যের দেখা মেলেনি এ জনপদে। উত্তরের হিমেল হাওয়া প্রবাহিত থাকায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে কয়েকগুণ। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ কাজে বের হচ্ছেন না। শীতে দুর্ভোগে পড়েছে খেটে-খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ। শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকায় চুয়াডাঙ্গার সদর হাসপাতালে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা।
চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, গত বুধবার সকাল ৯টায় চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৭ শতাংশ। এটি এ মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা।
তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) প্রতিনিধি জানান, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় কনকনে ঠান্ডায় জেঁকে বসেছে শীত। এখানে শীতের তীব্রতা ক্রমেই বাড়ছে। পৌষ মাসের শুরু থেকে তেঁতুলিয়ায় ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা উঠানামা করছে। পৌষের প্রথম সপ্তাহে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গেছে। কুয়াশার কারণে মহাসড়কে সাধারণ যানবাহনগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে আগেই হাট-বাজার ও পথঘাট অনেকটা জনশূন্যে পরিণত হয়ে পড়ছে। তীব্র শীতের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা থমকে গেছে।
ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীতে ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় শীত বাড়ছে। মঙ্গলবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঘন কুয়াশায় এখানে সকালে সূর্যের দেখা মিলছে না। দিনের বেলা ঠান্ডা নিবারণে এখানকার গ্রামাঞ্চলের মানুষ খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে তারা ঠান্ডা নিবারণের চেষ্টা করেন। ঠান্ডার তীব্রতায় এখানে ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে সর্দি-কাশির প্রাদুর্ভাব। শিশু, বৃদ্ধরা আক্রান্ত হচ্ছে কোল্ড ডায়রিয়ায়।
কিশোরগঞ্জ (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান, শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মানুষ। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে মানুষ। নিম্ন আয়ের শ্রমিক, শিশু ও বৃদ্ধরা শীতে বিপাকে পড়েছে। হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত শ্বাসকষ্ট রোগীর সংখ্যা।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হাকিম জানান, গত বুধবার সকাল ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত মঙ্গলবার ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিন দিন তাপমাত্রা কমছে। হিমেল হাওয়া ও কুয়াশার কারণে শীতের তীব্রতায় জনজীবন প্রায় থমকে পড়েছে। শীতের তীব্রতায় বৃদ্ধ ও শিশুদের শীতজনিত শ্বাসকষ্ট রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কাহিল হয়ে পড়েছে নিম্ন আয় ও দিনমজুররা। অনেক শিশু ও বৃদ্ধ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লতিফুর রহমান জানান, সরকারিভাবে ৮৫০টি কম্বল বরাদ্দ পাওয়া রতন দেব বলেন, হাসপাতালে শীতজনিত রোগে বৃদ্ধ ও শিশুরা বেশি চিকিৎসা নিচ্ছেন। দিন দিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গাইবান্ধা প্রতিনিধি জানান, উত্তর জনপদের গাইবান্ধায় পৌষের শুরুতেই হিমেল বাতাস আর শৈত্যপ্রবাহে বাড়ছে শীতের প্রকোপ। শীতের প্রকোপ এবার কিছুটা বিলম্বে দেখা দিয়েছে। প্রতি বছর সাধারণত নভেম্বরে কিংবা ডিসেম্বরের শুরুতেই শীতের দেখা মিললেও চলতি বছর চলছে কিছুটা ব্যতিক্রম।
গত চার দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহের পাশাপাশি ভোরের হিমেল বাতাসে নাগরিক জীবনে স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে শীতের দাপট। সকাল হলেই কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। সারা রাত ঘন কুয়াশা যেন হালকা বৃষ্টির মতো পড়ছে ভোর পর্যন্ত। সঙ্গে বইছে কনকনে ঠান্ডা বাতাস, যা মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলছে। বিশেষ করে সকালের দিকে বাইরে বের হতে কষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষের। সকালে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করছে যানবাহন। শীতের এ প্রকোপে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন শিশু, বৃদ্ধ ও নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া দিনমজুর।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, কম্বল ক্রয়ের জন্য জেলার প্রত্যেক উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর ছয় লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। তারা কম্বল কিনে বিতরণ করছেন। এছাড়া মজুত কিছু কম্বলসহ এ পর্যন্ত জেলায় ২২ হাজার ৬০০ কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক যাদব সরকার বলেন, শীতের শুরু থেকেই জেলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ শুরু করা হয়েছে, এটি অব্যাহত থাকবে।
শিবালয় (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, ঘন কুয়াশার কারণে আরিচা-কাজিরহাট এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, ঘন কুয়াশার কারণে গতমঙ্গলবার রাত ৩টা থেকে আরিচা-কাজিরহাট এবং গত বুধবার সকাল থেকে পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে লঞ্চ, ফেরি, স্পিডবোটসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ সময় আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে তিনটি ফেরি মাঝ নদীতে নোঙর করে রয়েছে।
ঘন কুয়াশার কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের মানিকগঞ্জের শিবালয়ের পাটুরিয়া প্রান্তে ঘন কুয়াশা পড়ায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফেরির যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদেরকে তীব্র শীতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ সময় যানবাহনের শ্রমিকরা দুর্ভোগে পড়েছে। বিআইডব্লিউটিসির আরিচা ঘাটের ম্যানেজার আবু আব্দুল্লাহ বলেন, আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে গত মঙ্গলবার রাত থেকে ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, শীত জেঁকে বসেছে উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে। হিমশীতল বাতাসের সঙ্গে দেখা দিয়েছে ঘন কুয়াশার দাপট। কনকনে ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে লালমনিরহাটের জনজীবন। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের কবলে পড়েছেন তিস্তা ও ধরলা নদী তীরবর্তী চরাঞ্চল ও ছিন্নমূল মানুষ।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে শীতের দাপট আরো বাড়তে পারে। লালমনিরহাট জেলা হিমালয়ের অনেকটা কাছাকাছি হওয়ায় তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি ঘন কুয়াশা এবং হিমশীতল বাতাসের প্রবাহ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে শীতের তীব্রতাকে। গতকাল সকালে লালমনিরহাটের তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ০২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল হাকিম বলেন, শীতকালে শিশু ও বয়স্কদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। ঠান্ডা এড়িয়ে চলা এবং অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।
মাদারগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি জানান, জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় সূর্যের দেখা মেলেনি। সেই সঙ্গে ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে শীতের তীব্রতা বাড়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতবস্ত্রের চাহিদাও বেড়েছে।
উপজেলার হকার্স মার্কেট ও ফুটপাতের কাপড়ের দোকানগুলো এখন ক্রেতা-বিক্রেতাদের পদচারণায় জমজমাট হয়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের ক্রেতারা এসব দোকান থেকে শীতের কাপড় কিনতে ভিড় করছেন। ফুটপাতের এসব দোকানে শীতের চাদর, জ্যাকেট, সোয়েটার, কম্বল, মোটা কাপড়ের গেঞ্জি, হুডি, মাফলার, কমফোর্টার, হাতমোজা, কানটুপিসহ সব ধরনের শীতবস্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ক্রেতা দেখলেই বিক্রেতারা হাঁকডাক করছেন।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি জানান, এবার তো এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান নেই, কেডা হ্যামাক ঠান্ডার কাপড় দিবে। এলাই যে ঠান্ডা, হামরা কেমন করি বাঁচমু, সেই চিন্তাই আছি। ভোট আইলে তো সবাই কয়, এটা দিমু, সেটা দিমু, এখন তো হ্যামার ঘরোক কেউ দেখবার আইসে না। নেম্বর, চেয়ারম্যানরা কয় সরকার না দিলে হামরা কই থাকি ঠান্ডার কাপড় দিব। আজ থাকি আগুন জ্বলেয়া নাতি-নাতনিক নিয়ে কষ্ট করি রাত দিন পার করছি। ঠান্ডা আইলে হ্যামার ঘরে খুব কষ্ট।
কথাগুলো বলেন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ডাঙ্গার চরের কাইচ মতি বেগম। উত্তরের জনপদে চলতি শীত মৌসুমের শুরুতেই রোববার হতে ঘন কুয়াশা, কনকনে ঠান্ডা, হিমেল হাওয়া ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে অসহায় ও ছিন্নমূল পরিবারগুলো কাবু হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা চরাঞ্চলের ভাসমান পরিবারগুলো ঠান্ডায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। স্থবির হয়ে পড়েছে সব কার্যক্রম।