চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা
পাহাড়ে ঘেরা সবুজের সমারোহের অপরূপ এক সৌন্দর্যের নাম বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। ভৌগোলিক- অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এই শহরের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। তবে এর সবটাই যেন ম্লান করে দিয়েছিল নগরীর জলাবদ্ধতা। প্রতিবছর বর্ষা এলেই ডুবে যেত নগর। ডুবে যেত বাড়িঘর, অলিগলি, দোকানপাট, শপিংমল, স্কুল-কলেজ, এমনকি হাসপাতালও। তবে এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। শহরে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টায় ২৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও কোথাও জলাবদ্ধতা নেই। কোনো কোনো স্থানে সাময়িক পানি উঠলেও দ্রুত তা নেমে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী খালে।
মূলত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আন্তরিকতা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), ওয়াসা, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে ৮ মাসেই পাল্টে গেছে চিরচেনা চিত্র। বর্তমানে এই উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে নগরবাসী। এ জন্য সিটি মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেনের আন্তরিকতাকেও সাধুবাদ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সচেতন নাগরিকদের অভিমত, গত ৩ দশকে অন্তত ৪ জন মেয়র ও একজন প্রশাসকসহ ৫ জন নগরপিতার দায়িত্ব পালন করলেও জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থ হয়েছেন সবাই। আর ২০১৭ সাল থেকে তো জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না করে একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে পার পেয়ে গেছেন জবাবদিহি থেকে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টা ও সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতায় সমস্যা উৎরানো সম্ভব হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতা
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে শুরু থেকেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ নজর ছিল। তিনি নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে চার উপদেষ্টাকে সমস্যা চিহ্নিতকরণের দায়িত্ব দেন। গত জানুয়ারি মাস থেকে সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ফাওজুল কবির খান ও ফারুক-ই-আজম দফায় দফায় সব সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময়, প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন এবং দিকনির্দেশনা দেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম সফরে এসে চলতি মৌসুমে জলাবদ্ধতা অর্ধেকে নামানোর নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
দায়িত্বপ্রাপ্ত চার উপদেষ্টা চট্টগ্রামে কেন জলাবদ্ধতা হচ্ছে, স্থায়ী সমাধানে করণীয় কী, কী কী প্রকল্প নিলে সমস্যা সমাধান হবেÑতা ঠিক করেন। সরকারের পক্ষ থেকে চসিকের চাওয়ামতে বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদনও দেওয়া হয়। বিশেষ করে আগে ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টি জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় থাকলেও বর্তমান সরকার সবকটি খাল অন্তর্ভুক্ত করে নতুন প্রকল্প দেয়। যদিও বর্ধিত খালের ওই প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। সব কাজ হয়ে গেলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে নগরবাসী মুক্তি পাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মেয়র শাহাদাতের তৎপরতা
নগরের ৫৭ খালের মধ্যে ৩৬টিতে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে সিডিএ। ইতোমধ্যে ২৫টি খালের কাজ সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। তবে এর বাইরেও রয়ে যায় ২১ খাল। আর এ খালই ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিষ্কার করে চসিক। ধীরে ধীরে সবকটি খাল পরিষ্কার হয় মেয়রের তত্ত্বাবধানে। এর আগে এগুলো একেকটি আবর্জনার ভাগাড় ছিল।
চসিক সূত্র জানিয়েছে, ১৫০ প্রকল্পের আওতায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নালা-নর্দমা পরিষ্কারের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। বর্ষার আগেই বিশেষ দল মাঠে নামিয়ে বীর্জা খাল, মিয়া খান নগর, দামপাড়া, ওয়াসা, জিইসি মোড়, কাপাসগোলা, আগ্রাবাদ, বাকলিয়া খাল পরিষ্কার ও খনন করা হয়। এ ছাড়া নগরের এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার নালা পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় এনেছেন মেয়র। আর এসবের কারণেই এবার জলাবদ্ধতামুক্ত নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছে চট্টগ্রাম। খাল খনন ও ড্রেন পরিষ্কারের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য মুখ থুবড়ে পড়া ৩৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পও এগিয়ে নেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ টিমের পরামর্শ
এদিকে নগরের খাল খনন ও পরিষ্কারের বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ড্রেনেজ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আনা হয়। যুক্ত করা হয় নগরবিদ শাহরিয়ার খালেদকেও। তারা বিভিন্ন খাল-নালা পরিদর্শন করে আটটি স্বল্পমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা দেন। এই কর্মপরিকল্পনায় ছিল স্বল্পমেয়াদে জলাবদ্ধতার সমস্যা কীভাবে সহনীয় করা যায়Ñসেই রূপরেখা। সরকার ও বিশেষজ্ঞদের দেওয়া পরামর্শেই চলে খাল খনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সংস্কার কার্যক্রম।
স্কুলে স্কুলে ডাস্টবিন ও হেলথ কার্ড
নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধান সমস্য নালা-নর্দমায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা। বড় পরিসরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো প্রকল্প না থাকলেও ছোট পরিসরে উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। প্রাথমিকভাবে টার্গেট করা হয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে নেওয়া হয় বিশেষ প্রকল্প ‘স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম’। যেখানে পাঁচটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হেলথ কার্ড বিতরণ করা হয় এবং বর্তমানে সব স্কুলে এ প্রকল্প চালু রয়েছে। এই কার্ডে রোগ নির্ণয়, টিকাদানসহ সব সেবা পাবে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ছোট-বড় সব স্কুলে ডাস্টবিন সরবরাহ করা হয়। বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মেয়র। তিনি জোর দেন যেখানে-সেখানে বর্জ্য না ফেলে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলার ওপর।
আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট সংস্কার
১৯৯৮ সালের পর থেকে ২৭ বছর ধরে আগ্রাবাদ বক্স কালভার্ট উন্মুক্ত করে খাল খনন ও পরিষ্কার করা হয়নি, যা ছিল জলাবদ্ধতার বড় কারণ। ইতোমধ্যে সেখানে থাকা বিষাক্ত গ্যাস ও গ্যাসের পাইপের মধ্যেও কাজ চালিয়ে ১৭টি স্লাবের মধ্যে ৭টি পরিষ্কার করা হয়েছে। বাকি ১০টির কাজ এখনো চলমান।
সিডিএ ও চসিকের সমন্বিত উদ্যোগ
নগরীর জলাবদ্ধতার পেছনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)Ñএ দুই সংস্থার সমন্বয়হীনতার অভিযোগ পুরোনো। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় ভুগে নগরবাসীকে এর মাশুল দিতে হতো। তবে এবার সরকারের নির্দেশে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় দৃশ্যমান হয়। আর এর মূলে ছিল চসিক। সমন্বয়ের কারণে দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে যাওয়ার ফলে বেশি বৃষ্টি হলেও নগরে তেমন জলাবদ্ধতা নেই। এতে স্বস্তিতেই বর্ষা পার করছে নগরবাসী।
হালিশহরের বাসিন্দা আরাফাত এলাহী বলেন, ‘আমাদের এলাকা প্রত্যেকবার ডুবলেও এবার জলাবদ্ধতা হয়নি। এটা সব সংস্থার সমন্বয়েরই ফল। আগের মেয়ররা কেবল নগরপিতার ট্যাগ লাগিয়েছেন।’
আগ্রাবাদের ব্যবসায়ী রেজাউল করিম বলেন, ‘এবার ২৪৩ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হলেও শহরে পানি জমেনি। কিছু কিছু এলাকায় পানি জমলেও দ্রুত সরে যায়। চট্টগ্রাম নিয়ে এবার সামাজিকমাধ্যমে নেতিবাচক কোনো প্রচার নেই।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ‘২৪টি খাল খনন ও পরিষ্কারের পাশাপাশি অনেক ড্রেন খালের সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে। নগরবাসীকে সচেতন করাসহ সেবা সংস্থাগুলো মধ্যে শতভাগ সমন্বয় হয়েছে।’
চসিক মেয়র ডা. শাহাদাৎ হোসেন আমার দেশকে বলেন, জনসচেতনতার পাশাপাশি নিয়মিত খান খনন, পরিষ্কার রাখা ও আবর্জনাকে সম্পদে রূপ দিতে পারলেই আমরা জলাবদ্ধতামুক্ত একটি শহর উপহার দিতে পারব। সামনে আরো অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। দ্রুত সেগুলো বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। সে সঙ্গে সবগুলো সংস্থার ইতোমধ্যে সমন্বয় করেছি। সবাই সহযোগিতাও করেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে গ্রিন, ক্লিন, হেলদি ও সেফ সিটি উপহার দেওয়ার যে অঙ্গীকার ছিলÑতা অচিরেই পূর্ণতা পাবে।