হোম > সারা দেশ > রংপুর

তিনটিতেই দলীয় কোন্দলে বেকায়দায় বিএনপি

কুড়িগ্রামের চার আসন

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম

ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারের প্রবাহে বারবার ক্ষতবিক্ষত জনপদ কুড়িগ্রাম। উত্তরের সীমান্তবর্তী এই জেলায় নদীগুলোর স্রোত যেমন ভৌগোলিক মানচিত্র পাল্টে দেয়, ঠিক তেমনি বদলে যায় রাজনৈতিক পরিবেশ ও মাঠ। চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি ভাঙা মানুষ, কাজ হারানো কৃষক, জীবিকার অনিশ্চয়তায় থাকা দিনমজুর এবং শহরের তরুণ প্রজন্ম—সবাই এবার ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায়। তাদের ভরসার প্রতীক হতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে গ্রাম থেকে চর, শহর থেকে বাজার, চা-দোকান থেকে ফেরিঘাট—সবখানেই বিরাজ করছে ভোটের আমেজ। ভোটারদের মুখে একটাই প্রশ্ন—কে পাল্টে দেবে কুড়িগ্রামের ভাগ্য, কাণ্ডারি হয়ে দাঁড়াবে জনতার পাশে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলেও উত্তেজনা, আলোচনা ও সম্ভাবনার তীব্রতা বাড়ছেই। কুড়িগ্রামের চারটি আসন ঘিরে এখন চলছে দলীয় বৈঠক, স্থানীয় গ্রুপিং, মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের নানামুখী তৎপরতা। ঘোষিত দুদলের প্রার্থীদের নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন ভোটাররা।

জুলাই বিপ্লবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দলটির প্রায় সব নেতা পালিয়ে গেছেন। কেউ কেউ গা-ঢাকা দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদী দলটির অন্যতম সহযোগী জাতীয় পার্টির নেতারা না পালালেও ইতোমধ্যে জনধিকৃত হয়ে পড়েছেন। দলটি নিষিদ্ধ না হলেও ভোটের মাঠে নামার অবস্থা নেই। জাতীয় পার্টির সেই দুর্গ দখলে মরিয়া বিএনপি ও জামায়াত।

আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীদের তৎপরতা থাকলেও ধানের শীষের মনোনয়ন নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেখা দিয়েছে চারটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই। বিশেষ করে ১, ৩ ও ৪ নম্বর আসনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। অন্যদিকে সুপরিকল্পিতভাবে প্রার্থী ঘোষণা করা জামায়াত এগোচ্ছে অত্যন্ত সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত পন্থায়। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরাও মাঠে আছেন।

কুড়িগ্রাম-১ (নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারী)

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই আসনে একবার জয়লাভ করে বিএনপি। অন্যদিকে সাতবার জয় পায় জাতীয় পার্টি। সেই দুর্গ ভেঙে দেয় আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের রাতের ভোটের মাধ্যমে। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে আসনটি আবার ছেড়ে দেওয়া হয় জাতীয় পার্টিকে। জুলাই বিপ্লবের পর পাল্টে গেছে ভোটের সব সমীকরণ। এবার বিএনপি ও জামায়াত প্রার্থীর মধ্যেই মূলত লড়াই হবে।

এ আসনে বিএনপি থেকে মনোনীত হয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি সাইফুর রহমান রানা। জামায়াত তাদের প্রার্থী করেছে দলটির রংপুর মহানগর শাখার সাবেক সেক্রেটারি অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলামকে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের কুড়িগ্রাম জেলা শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক হারিসুল বারী রনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মাঠে নেমেছেন। তবে এনসিপি থেকে তিনজন মনোনয়ন ফরম তুললেও এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি।

এখানে বিএনপির ভোট বেশি থাকলেও ধানের শীষের বাক্সে সেগুলো পড়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে দলীয় কোন্দলের কারণে। প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ও নেতাকর্মীরা। তবে রানা বিভিন্নভাবে প্রচার চালিয়ে তার অনুসারীদের উজ্জীবিত রাখার পাশাপাশি ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন।

অন্যদিকে জোর প্রচারে নেমেছেন জামায়াত প্রার্থী অধ্যাপক আনোয়ারুল। মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন মাহফিল ও জনকল্যাণমুখী কাজে। ইতোমধ্যে ছেয়ে গেছে ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনে।

ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হারিসুলও মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। নিয়মিত প্রচারে ইসলামি মূল্যবোধের কথা তুলে ধরে তৃণমূলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াচ্ছেন তিনি।

এছাড়া গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী কেন্দ্রীয় ছাত্রঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও কোটাবিরোধী আন্দোলনের নেতা বিন ইয়ামিনও স্বল্পপরিসরে প্রচার চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

কুড়িগ্রাম-২ (ফুলবাড়ী, রাজারহাট ও সদর)

কুড়িগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই আসন অধিকাংশ সময় জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। এটি দলটির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে নিশানা গাড়তে চায় বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। প্রচার চালাচ্ছে ইসলামী আন্দোলনও।

এই আসনে বিএনপি প্রার্থী করেছে দলটির জেলা শাখার সদস্য সচিব সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদকে। দলীয় কোনো কোন্দল না থাকায় এবং ক্লিন ইমেজের প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হওয়ায় আছেন বেশ ফুরফুরে মেজাজেই। ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছেন পুরো এলাকা। গণসংযোগ, উঠান বৈঠকসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাড়াচ্ছেন জনসমর্থন।

অন্যদিকে জামায়াত প্রার্থী অ্যাডভোকেট ইয়াসিন আলীও এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। দলীয় ভোটের পাশাপাশি চরাঞ্চলে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে বেশ। মিছিল-মিটিং ও দলীয় বৈঠকের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছেন তিনি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় তার কর্মীবাহিনী তৈরি করে গোছাচ্ছেন নির্বাচনি মাঠ।

তবে প্রচারে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সমন্বয়ক ড. আতিক মুজাহিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রনেতা ইতোমধ্যে তরুণ ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এলাকায় গণসংযোগ ও বেসরকারি বিভিন্ন টেলিভিশনে কুড়িগ্রাম নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা তরুণ প্রজন্ম এবং ভোটারদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে বলে দলটির নেতাকর্মীরা দাবি করছেন। চিরাচরিত রাজনৈতিক পন্থা পরিহার করে কুড়িগ্রামের উন্নয়নে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর)

একটি মাত্র উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম-৩ আসন গঠিত। এখানে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের হাতে বারবার প্রতারণার শিকার এই আসনের ভোটাররা এবার সৎ, যোগ্য ও তরুণ নেতৃত্ব খুঁজছেন।

জামায়াত থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মাহবুবুল আলম সালেহীকে প্রার্থী ঘোষণা করার পরপর নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। তরুণ তুর্কী হিসেবে ইতোমধ্যে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি। সব ভোটারের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যাওয়ার পাশাপাশি এলাকার উন্নয়নে তার উদ্ভাবিত নানা পরিকল্পনাও ছড়িয়ে দিয়েছেন তরুণদের মাঝে। আধুনিক উলিপুর গঠনে বিদেশের আয়েশি জীবন ছেড়ে গাঁয়ের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কাজ করার লক্ষ্যে জোর প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।

জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি তাসভীর উল ইসলামকে ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণার পরপরই প্রচারে নেমেছেন তিনি। এলাকায় জনসভা, উঠান বৈঠক, ব্যানার, ফেস্টুন, মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করছেন তিনি। তবে তার প্রার্থিতা পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল খালেকের কর্মী-সমর্থকরা। তারা মনে করেন, উলিপুরের ফ্যাসিবাদবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন ও জেল-জুলুমের শিকার আবদুল খালেকই মনোনয়নের একমাত্র দাবিদার। এদিক দিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে আছেন তাসভীর।

এই আসনের রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি ও ভোটাররা বলছেন, বিএনপির পর্যাপ্ত ভোট থাকা সত্ত্বেও দলীয় বিভক্তি দলটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

ইসলামী আন্দোলন থেকে মনোনয়ন পেয়ে ডা. আক্কাস আলীও বসে নেই। তিনিও বিভিন্ন এলাকায় প্রচার ও গণসংযোগ চালাচ্ছেন। সাবেক সংসদ সদস্য হওয়ায় এলাকায় তার নিজস্ব ভোট ব্যাংক আছে। এছাড়া এনসিপি থেকে এই আসনে পাঁচজন মনোনয়ন ফরম তুললেও এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি।

কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী)

বেকারত্ব, যোগাযোগব্যবস্থার দুরবস্থা, কৃষি সংকট ও নদীভাঙনকবলিত কুড়িগ্রাম-৪ আসনে জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ নেতারা বারবার নির্বাচিত হলেও এলাকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তাই ভোটাররা বারবার নতুন প্রার্থী বেছে নেন এলাকার উন্নয়ন ও তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়।

পাঁচ মাস আগেই রৌমারী উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রার্থী ঘোষণা করে দলটি। বিএনপি থেকে প্রার্থী করা হয়েছে তারই আপন বড় ভাই আজিজুর রহমানকে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন থেকে সরব আছেন হাফিজুর রহমান।

একই বাড়ি থেকে দুই ভাই প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচনি এলাকায় নতুন আলোচনা তৈরি হয়েছে। দলের প্রার্থী হয়েই প্রচার শুরু করেছেন জামায়াত নেতা মোস্তাফিজুর। ব্যানার, ফেস্টুন, উঠান বৈঠকের পাশাপাশি রাস্তাঘাটের উন্নয়নমূলক কাজ করে ইতোমধ্যে এলাকার মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেছেন তিনি।

অপরদিকে বিএনপি প্রার্থী আজিজুর এলাকায় নির্বাচনি প্রচার শুরু করলেও আছেন কিছুটা অস্বস্তিতে। জাতীয়তাবাদী মহিলা দল কেন্দ্রীয় কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক মমতাজ হোসেন লিপি বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করছেন; পাশাপাশি তিনিও এলাকায় গণসংযোগ চালাচ্ছেন।

নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তরের এই সীমান্তবর্তী জেলার মানুষের কৌতূহল বাড়ছে। চারটি আসনের জনস্রোত কোনদিকে যাবে—তা এখনো অনিশ্চিত। তবে কুড়িগ্রামের নদীভাঙন, মৌসুমি বন্যা, রাস্তাঘাটের সমস্যা, কর্মসংস্থান সংকট, সীমান্ত সমস্যা—এসব সমাধানে যিনি ভূমিকা রাখবেন, তাকেই জনগণ বেছে নেবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।

আবারও বিদ্রোহের আগুন কুড়িগ্রাম-৪ আসনে

বিএনপির প্রার্থী পরিবর্তন চেয়ে আজ পার্বতীপুরে অবরোধ

গাইবান্ধায় এনসিপির মনোনয়ন পেলেন সোহাগ ও আসাদুজ্জামান

এই প্রজন্মকে বস্তাপচা রাজনীতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না

বাড়ির সামনে খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মামা-ভাগনের মৃত্যু

রংপুরে ২ আসনে এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা

দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের ছাড় দেয়া হবে না: শিবির সভাপতি

কুড়িগ্রামে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু

পঞ্চগড়ে বাড়ছে শীতের তীব্রতা, বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ

এ প্রজন্মকে দাবায় রাখতে চাইলে পরিণতি ভয়াবহ হবে: শিবির সভাপতি