রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশই আটকে আছে মামলাজটে। এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ব্যাংকগুলো অর্থ আদায় করতে পারছে না। বর্তমানে এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৪৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ অর্থ মামলা-সংক্রান্ত জটিলতায় আটকে রয়েছে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বৈঠকে ব্যাংকগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
অর্থ উপদেষ্টাকে বৈঠকে জানানো হয়, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ছয়টি ব্যাংকে ৪৮ হাজার ২৯৬টি মামলা চলমান আছে। এসব মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ এক লাখ ১৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা, যা ছয় ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৭৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার জন্য প্রত্যেক ব্যাংকের আইন বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এছাড়া চলমান মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে মনিটরিং ব্যবস্থাও জোরদার করতে হবে।
কোন ব্যাংকের কত টাকা আটকা
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ আটকে গেছে জনতা ব্যাংকের। ১১ হাজার ৫৫০ মামলার বিপরীতে এই ব্যাংকের ৪৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের অর্থ জড়িত রয়েছে। এরপর সোনালী ব্যাংকের ২৪ হাজার ৮১২ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। এসব অর্থের বিপরীতে ১০ হাজার ৪২৯টি মামলা করা হয়েছে। ২০ হাজার ৩৭০ মামলার বিপরীতে অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অর্থ আটকে গেছে। রূপালী ব্যাংকের চার হাজার ৬৬১ মামলার বিপরীতে রয়েছে ৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ৭১২ মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৫৬২ মামলায় দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা আটকা পড়েছে।
খেলাপি ঋণ আদায় নাজুক
ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও আদায় পরিস্থিতি নিয়েও সভায় আলোচনা করা হয়। অর্থ উপদেষ্টাকে বৈঠকে জানানো হয়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে ছয় ব্যাংকের যে ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা পাওনা, তা এসব ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৫৭ শতাংশ। আবার মোট ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকার ৬৩ শতাংশ; অর্থাৎ ৫৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা রয়েছে এক জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছেই। ব্যাংকগুলো চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১২৮ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার এক দশমিক ছয় শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ খেলাপিদের থেকে চলতি ২০২৫ সালে জনতা ব্যাংক আদায় করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল পাঁচ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। কিন্তু বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি আদায় করেছে ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ১১ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৯২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ব্যাংকটি আদায় করেছে মাত্র ১৯ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অন্যদের তুলনায় বেশি আদায় করেছে রূপালী ব্যাংক। শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে রূপালী ব্যাংকের পাওনা ১০ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি বছর এক হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ব্যাংকটি আদায় করেছে ৯০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। সোনালী ব্যাংকের আদায় ৫০ লাখ টাকা। এ ব্যাংক শীর্ষ ২০ গ্রাহকের কাছে পায় ছয় হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটি এক বছরে ৩০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল।
এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকের ২০ গ্রাহকের কাছে পাওনা দুই হাজার ৫৭৯ কোটি টাকার মধ্যে এক বছরে ৪০০ কোটি টাকা আদায় করবে বলেছিল। কিন্তু ব্যাংকটি ছয় মাসে আদায় করেছে ১০ লাখ টাকা। আর বিডিবিএল ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল; কিন্তু আদায় হয়েছে তিন কোটি পাঁচ লাখ টাকা।
এ সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অত্যন্ত অসন্তোষজনক। ব্যাংকগুলোর কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। আবার ঋণখেলাপি হওয়ার আগেই ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ শনাক্তকরণে ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শীর্ষ ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের থেকে ব্যাংকের আদায়ের চিত্র হাতাশাজনক। তাই প্রতিটি ব্যাংকে বিশেষ টিম গঠনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেন তিনি।