হোম > বাণিজ্য

নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে ২৫ লাখ ডলারের এলসি

রোহান রাজিব

স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও ব্যাংক খাতের জালিয়াতি এখনো বন্ধ হয়নি। এই সরকারের আমলেও বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক এলসি বা ঋণপত্র খুলতে বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে।

ব্যাংকটির গুলশান শাখা নামসর্বস্ব বা অসচ্ছল ‘ইনফিনিট হরাইজন’ নামক একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২৫ লাখ ডলার বা প্রায় ৩১ কোটি টাকার এলসি খুলেছে। এলসি খোলার প্রস্তাব প্রথমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নাকচ করা হলেও দ্বিতীয় দফায় ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ব্যাংকটির পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই এই এলসি খোলেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও পর্যবেক্ষকের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা হয়েছে।

সন্দেহ রয়েছে, এসব অর্থ বিদেশে পাচার করার উদ্দেশ্যে অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করে এলসি খোলা হয়েছে। এতবড় জালিয়াতির ঘটনায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েকবার এবি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিশেষ তদন্ত করা হচ্ছে। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের মার্চে ইনফিনিট হরাইজন নামে প্রতিষ্ঠানটি আত্মপ্রকাশ করে। ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স পায় একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। আইআরসি ইস্যু হয় ১৭ অক্টোবর। অফিসের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়Ñ এমএস টাওয়ার হেলমেট (হ্যামলেট), ১৬ কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, বনানী ঢাকা। নথিপত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে দেখানো হয়েছে আবু নোমান নামে এক ব্যক্তিকে। আলোচ্য প্রতিষ্ঠানের নিট সম্পদমূল্য মাত্র ২৭ লাখ টাকা।

তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির গুলশান শাখায় প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্ট খোলা হয় গত বছরের ২৮ অক্টোবর। এরপর থেকে জমা ও উত্তোলন মিলিয়ে ৬৩টি লেনদেন করা হয়। এর মধ্যে ১৩টি লেনদেনে জমার পরিমাণ ছিল মাত্র সাত কোটি ৫১ লাখ টাকা আর ৫০টি লেনদেনে উত্তোলনের পরিমাণ এক কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

তবে প্রতিষ্ঠানের অফিসের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ইনফিনিট হরাইজন অফিসের ঠিকানায় গিয়ে আরো দুটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য মিলেছেÑ গ্লোবাল করপোরেশন ও বিঅ্যান্ডসি। এ দুটি প্রতিষ্ঠানও এবি ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক।

তথ্য অনুযায়ী, গ্লোবাল করপোরেশনের কাছে এবি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ২৩২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অপর গ্রাহক বিঅ্যান্ডসির কাছে ফোর্সড ঋণ ৫৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা আর স্বীকৃত বিলের পাওনা বাবদ ঋণ আছে ১৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এসব ঋণ খেলাপির খাতায় উঠেছে। খেলাপি থাকায় নতুন করে ঋণ নিতে প্রতিষ্ঠানটি খোলা হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সবকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক একজনই।

সরেজমিন অফিসের দেওয়া ঠিকানায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গিয়ে দেখা গেছে, ভবনটির নিচতলার দেয়ালে টাঙানো বিলবোর্ডে ইনফিনিট হরাইজন নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে সেখানে ব্যাংকটির অপর খেলাপি গ্রাহক গ্লোবাল করপোরেশনের নামটি খুঁজে পাওয়া যায় ভবনটির সপ্তম তলায় (লিফটের ছয়)।

পরে সপ্তম তলায় গিয়ে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখের দেয়ালে ইনফিনিট হরাইজন করপোরেশন নামসংবলিত ছোট একটি বিলবোর্ড রয়েছে। অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে রিসিপশনের টেবিলে চোখ পড়তেই দেখা গেল সেখানে পাশাপাশি ইনফিনিট হরাইজন করপোরেশ ও গ্লোবাল করপোরেশন বিডি নাম লেখা আছে।

তবে মূল অফিসে ঢোকার কাচের গেটের ওপর কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল না। অপর প্রান্তে ডানদিকে কাচের গেটের উপরিভাগে বিঅ্যান্ডসি প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল। অর্থাৎ গ্লোবাল করপোরেশন, বিঅ্যান্ডসি ও ইনফিনিট হরাইজনের অফিসের প্রবেশ গেট একটাই।

রিসিপশনে নিজের পরিচয় দিয়ে ইনফিনিটি হরাইজনের কর্ণধার আবু নোমানের কাছে দেখা করতে চাই বলা হলে জানানো হয়, তিনি অফিসে নেই। এরপর ভেতর থেকে এসে অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্যার নেই, আপনার ভিজিটিং কার্ড দিন, স্যারকে দেব যোগাযোগ করার জন্য।’ যোগাযোগের নম্বর চাইলেও তিনি দেননি।

ভবনটির ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই অফিস নেওয়া হয় সেলিম চৌধুরীর নামে। তিনি আবু নোমান নামে কাউকে চেনেন না।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইনফিনিট হরাইজন করপোরেশন অস্ট্রেলিয়া থেকে ছোলা আমদানির জন্য এবি ব্যাংকে এলসি খোলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টাকা পরিশোধ করা হবে দুবাইয়ের ড্যামেনস জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি নামে একটি প্রতিষ্ঠানে, যার প্রকৃত মালিক সেলিম চৌধুরী।

সেলিম চৌধুরী হলেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটরসের মালিক। এই সেলিম চৌধুরী ব্যবসার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করেননি। গ্লোবাল করপোরেশনের মালিক আবার সেলিম চৌধুরীর বোনজামাই। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মালিকই সেলিম চৌধুরী। অর্থাৎ সেলিম চৌধুরীর প্রতিষ্ঠানই আমদানিকারক আবার রপ্তানিকারকও।

জানা যায়, এবি ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক ইনফিনিট হরাইজন করপোরেশনের ভোগ্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র স্থাপনে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ৮০৪তম সভায় প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি দেওয়া সত্ত্বেও এলসি খোলা যেতে পারে বলে বোর্ডে অনুমোদন হয়। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনাপত্তির জন্য এলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়। কারণ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় গত ৮ ডিসেম্বর এক চিঠিতে নতুন ঋণ বিতরণে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ওই চিঠিতে বলা হয়, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত জামানতবিহীন নতুন ঋণ অনুমোদন না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলো। কিন্তু ওই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ঋণপ্রস্তাবটি উপস্থাপন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগকৃত সমন্বয়কের আপত্তি উপেক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান পর্ষদকে না জানিয়ে ৩১ কোটি টাকার এলসি খোলেন।

দ্বিতীয় ধাপে এলসি খোলার ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এমডির সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা আছে। সেক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে ৩১ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের নিষেধাজ্ঞাও মানা হয়নি।

পরিদর্শন বিভাগ এক নির্দেশনায় বলেছে, এবি ব্যাংকের গুলশান শাখার কৃষিঋণ ও সিএসএমই ঋণ ছাড়া সব ধরনের ঋণ দেওয়া আপাতত স্থগিত থাকবে। তিন ধাপে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নতুন ও অসচ্ছল প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে এতবড় এলসি কেন খোলা হয়েছে, সে বিষয়ে মার্চের শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এলসি খোলা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিল অব এন্ট্রি হয়। তবে সাইট এলসিতে ডকুমেন্ট রিসিভ করার ক্ষেত্রে টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখনো টাকা পরিশোধ করেনি ব্যাংকটি।

এ বিষয়ে গত ৫ মার্চ ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে এমডির সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি দেখা করেননি। পরে ব্যাংকটির জনসংযোগ বিভাগ থেকে বলা হয়, প্রথমবার এলসি পাঁচ শতাংশ মার্জিন নিয়ে খোলা হয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক নাকচ করে। তবে দ্বিতীয়বার শতভাগ মার্জিন নিয়ে খোলা হয়। তবে এ সংবাদসংক্রান্ত আরো একাধিক প্রশ্ন পাঠালেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ‍ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, প্রথমবার এই প্রতিষ্ঠানের এলসির প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংক নাকচ করে দিয়েছিল। তবে দ্বিতীয়বার এমডি বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়াই খুলেছেন।

এটা অবৈধভাবে খোলা হয়েছে। কারণ এতবড় এলসি এমডির একক সিদ্ধান্তে খোলা যাবে না। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা-ও উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খোলা হয়েছে, যে প্রতিষ্ঠানের মালিক একজন জুয়াড়ি। এখনকার প্রতিষ্ঠানের মালিকও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মালিক। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট (এফআইসিএসডি) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইউ) বিষয়টি তদন্ত করছে।

ছেঁড়া নোট বদলে দেওয়ার নির্দেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের

সাড়ে চার মাসেও মেলেনি পণ্যের অনুমোদন

বাড়লো স্বর্ণের দাম, ভরি ছাড়ালো ২ লাখ ১৭ হাজার

বিদেশে হাদির চিকিৎসার সব খরচ বহন করবে অর্থ মন্ত্রণালয়

চলতি মাসে যে ১০ ব্যাংকে কোনো রেমিট্যান্স আসেনি

চালের দাম বাড়ানোর সুযোগ খুঁজছে সিন্ডিকেট

ডিসেম্বরের ১৩ দিনে এসেছে দেড় বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স

১৭ ব্যাংকের ৫০-৯৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি

রেমিট্যান্সে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি

পর্দা নামল ১২তম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলার