যেকোনো কোম্পানির সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেনে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে হয়। বর্তমানে দেশে দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ রয়েছে। একটি দেশের সবচেয়ে পুরোনো এবং প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ হিসেবে পরিচিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং অপরটি চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)।
১৯৯৪ সালে সিএসইর যাত্রা শুরুর পর উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সে বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে যেকোনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে আইপিও বিধিমালা, ২০২৫-এর খসড়া প্রস্তাবে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসএসি) প্রস্তাবটির চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে আগামীতে দেশের উভয় এক্সচেঞ্জে অথবা যেকোনো একটি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে পারবে কোম্পানিগুলো।
তালিকাভুক্তিতে এমন নিয়ম চালু হলে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে সিএসই।
২০২৩-২৪ হিসাব বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালন আয়ের প্রায় ৭১ শতাংশই এসেছে তালিকাভুক্তির ফি থেকে। এ খাত থেকে মোট আয়ের পরিমাণ ২২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। পরিচালন আয়ের বাকি তিনটি খাত হলো-ট্রানজেকশন ইনকাম/ক্যাপাসটি চার্জ, ট্রেক নবায়ন আয়, সেবা আয় ও কমিশন। এসব খাত থেকে আয় হয়েছে ৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
উল্লিখিত হিসাব বছরে সিএসইর নিট আয়ের পরিমাণ ২৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং শেয়ারপ্রতি আয়ের পরিমাণ ছিল ৫০ পয়সা। অর্থাৎ সিএসইর আয়ের বড় অংশই নির্ভর করছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক ফি থেকে। তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ হিসাব বছরে সিএসইর প্রধান বোর্ডে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের সংখ্যা ৬২৩টি এবং এসএমইতে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের সংখ্যা ১৯টি।
জানতে চাইলে সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুদমদার আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ইক্যুয়িটি বেসড। মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত হলেও সেগুলো ভালো পারফর্ম করতে পারছে না। ডেরিভেটিভ, কমিডিটি মার্কেট, ইটিএফÑএসবের কিছু নেই।
সিএসই কমোডিটি মার্কেট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পদ্ধতিগত সংস্কার কিংবা নীতি সহায়তা ছাড়া ঐচ্ছিক তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সিএসইর জন্য সংকট তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তিতে স্বাধীনতা থাকা উচিত। কাউকে বাধ্য করা ঠিক নয়।
তবে সিএসইর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হলেও বস্তুত এখনো বাংলাদেশের প্রশাসনিক সব ব্যবস্থা রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রধান অফিসও ঢাকায় অবস্থিত। আগে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রামে প্রধান অফিস থাকলেও পরে সবই ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। এমনকি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রধান অফিসও ঢাকায়। ফলে বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীকরণের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সরকারের নীতিতে এর প্রতিফলন রয়েছে।
তারা আরো বলছেন, বিএসইসির কোনো শাখা অফিস চট্টগ্রামে নেই। কোনো মার্চেন্ট ব্যাংকের (শেয়ারবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান) চট্টগ্রামে কোনো অফিস নেই। ফলে কোনো ধরনের পদ্ধতিগত এবং নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত শুধু সিএসই নয়, পুঁজিবাজারের জন্য ভালো হবে না।
এ বিষয়ে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম আমার দেশকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে স্টক এক্সচেঞ্জগুলো কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তিতে নিজেদের ক্ষমতায়নের জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। নতুন আইপিও বিধিমালায় কোম্পানিগুলোর তহবিল সংগ্রহে স্টক এক্সচেঞ্জের সুপারিশের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে ইস্যুয়ার (কোম্পানি) যেকোনো স্টক এক্সচেঞ্জে অথবা উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তির আবেদন করতে পারবে। যদি ডিএসই কোনো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে না চায়, সেক্ষেত্রে সিএসই তালিকাভুক্ত করার সুযোগ পাবে।
তিনি আরো বলেন, দুই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করার বাধ্যবাধকতার কারণে ইস্যুয়ার কোম্পানির ব্যয় বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয়। গত ৩০ বছর ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। এটি আর কতদিন চলবেÑএমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, নতুন এ বিধান কার্যকর হলে স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে প্রতিযোগিতা এবং বাজারে আইপিওর সংখ্যা বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
আইসিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। তাদের উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্তিতে বাধ্য করা উচিত হবে না। তিনি আরো বলেন, ডিএসই এবং সিএসইর প্রায় একই ট্রেকহোল্ডার।
ঢাকা এবং চট্টগ্রামে তাদের শাখা রয়েছে। ফলে যে কেউ ঢাকা বা চট্টগ্রামে ট্রেড করতে পারে। এখন ডিএসই যেহেতু প্রধান শেয়ারবাজার, সেজন্য কোম্পানির বাজারদরের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রয়েছে ডিএসইর। সিএসইতে টার্নওভার কম উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিএসই কমিডিটি এক্সচেঞ্জ চালু করতে যাচ্ছে। এটি ভালোভাবে চালু করতে পারলে আগামীতে সিএসই বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারবে বলে মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।