জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) একমাত্র ছাত্রী হল নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল—যেখানে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও যুক্তিবোধ গঠনের জায়গা হওয়ার কথা ছিল হল ডিবেটিং ক্লাব, সেখানে এখন চলছে ক্ষমতার রাজনীতি ও ভয়ভীতি। অভিযোগ উঠেছে, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ জোহরা ইমু কোনো নির্বাচন ছাড়াই, গঠনতন্ত্র ভঙ্গ করে স্বঘোষিতভাবে কমিটি দিয়ে হল ডিবেটিং সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক পদ দখল করেন। তার সাথে বাকি পদগুলোও দখলে নেন তার ঘনিষ্ঠরা। শুধু তাই নয়, সেই পদকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন একদল প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যারা এখন পুরো হলের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
হল ক্যান্টিনের খাবারের তদারকির নামে ত্রাসের রাজত্ব থেকে শুরু করে, হলে অবৈধভাবে শিক্ষার্থী তোলা। সবকিছুর নেতৃত্বেই থাকেন ইমু ও তার ঘনিষ্ঠরা। হল প্রভোস্টের সরাসরি বিভাগের ছাত্রী হওয়ায় তাঁর প্রশ্রয়েই ইমু ও তার সহযোগীরা এসব অপকর্ম করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ডিবেটিং ক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সকল পদ খোলা ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারণের কথা। গঠনতন্ত্রের ৬ ও ৭ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, সদস্যদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পদে কাউকে বসানো যাবে না। কিন্তু এসব নিয়ম উপেক্ষা করে ইমু নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকে নিয়ে একটি অবৈধ কমিটি গঠন করে প্রভাব বিস্তার করে তা ঘোষণা করেন। তাদের এই সিন্ডিকেটে নেতৃত্ব দেন হল ডিবেটিং ক্লাবের সেই সময়ের নেত্রী সিনিয়র নাঈমা আক্তার রিওতা ও শারমিন সুলতানা নিশি। তারা সম্ভাব্য অন্যান্য পদপ্রার্থীদের ভয় দেখিয়ে ও চাপ প্রয়োগ করে তাদের পছন্দের ইমুসহ বাকিদের নির্বাচন ছাড়াই অবৈধভাবে পদ দিয়ে কমিটি ঘোষণা করে। তাদের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হলেও ভয় ও চাপে অনেকে মুখ খুলতে পারেননি।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ইমুকে ঘিরে এখন হলে তৈরি হয়েছে এক ধরনের ‘ডিবেটিং সিন্ডিকেট’—যারা নামেমাত্র বিতর্ক ক্লাব চালালেও মূলত সেই সংগঠনকেই ব্যবহার করছে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে। এই চক্রের মাধ্যমে ইমু নিজের প্রভাব ধরে রেখেছেন, আর সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা তাঁর হয়ে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে হল ডিবেটিং ক্লাবের সাবেক নেত্রী নাঈমা আক্তার রিতা ও শারমিন সুলতানা নিশি এসব সিন্ডিকেটের দেখভাল করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে কমিটি গঠনের সময় তাঁরা ফোন ও মেসেজ দিয়ে এবং সরাসরি কথা বলে অন্য শিক্ষার্থীদের ভয় দেখান ও চাপ প্রয়োগ করেন। এ সংক্রান্ত প্রমাণাদিও প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। হল ডিবেটিং ক্লাবের একজন সদস্য বলেন, আমরা ভেবেছিলাম নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন হবে। কিন্তু একদিন হঠাৎ দেখলাম ইমুকে সাধারণ সম্পাদক করে বাকি পদেও তাদের পছন্দের মানুষদের দিয়ে নির্বাচন ছাড়াই অবৈধভাবে কমিটি ঘোষণা করেছে। এরপর থেকে সবকিছু ওদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।”
আরেকজন বলেন, “ইমুর চারপাশে এখন একটা চক্র গড়ে উঠেছে। তারা ডিবেটিং ক্লাবের নাম ব্যবহার করে এবং প্রভোস্টের বিভাগের ছাত্রী হওয়ায় সে তাঁর খুব ক্লোজ। এই পরিচয় দিয়ে এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নাম ব্যবহার করে হলে ভয় আর প্রভাব বিস্তার করছে।”
হলের অনেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, ইমু প্রভোস্টের বিভাগের ছাত্রী হওয়ায় তিনি এই সম্পর্ককে প্রভাব হিসেবে ব্যবহার করেন। এক শিক্ষার্থী বলেন, ইমু প্রভোস্টের ছাত্রী, তাই তার কিছু হবে না। তাই কেউ সাহস করে কথা বলে না। এদিকে, ক্যান্টিনের খাবারে পোকা পাওয়ার ঘটনাতেও এই সিন্ডিকেটের আচরণ আলোচনায় আসে। সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে মাবুদা প্রমাণসহ বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলে, ইমু তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হন এবং পোস্ট মুছে ফেলতে বলেন। মাবুদা জানান, “ইমু আপু আমার রুমে এসে বলেন—‘কেন ভোটের প্রসঙ্গ আনলি? এখনই ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দিবি।’ এমনকি ভয় দেখিয়ে চুপ করানোর চেষ্টা করেন।” এই ঘটনার পর অনেকেই বলেন, “এখানে খাবারের মান নয়, আসল বিষয় হচ্ছে ইমুর ক্ষমতা ও দাপট।”
হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেন, ইমু শুধু ডিবেটিং ক্লাব নয়, পুরো হলের নানা কার্যক্রমে প্রভাব খাটাচ্ছেন। ক্যান্টিন, রুম বণ্টন, বা কোনো অভিযোগ—সব জায়গায় তাঁর কথাই শেষ কথা। কেউ প্রতিবাদ করলে হেনস্তার শিকার হন। একজন বলেন, “ইমু আর তাঁর চক্র প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের মতামতের কোনো মূল্য নেই।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফাতেমাতুজ জোহরা ইমু বলেন, "প্রতিষ্ঠাকালীন ডিবেটিং কমিটি দেওয়ার পর আমাদেরটি ছিলো দ্বিতীয় কমিটি। নির্বাচন কেউ কখন দেয়, যখন একাধিক ম্যাডাম ক্লাবে থাকে। কিন্তু ডিবেটিং কমিটিতে তেমন একাধিক সদস্য প্রতিদ্বন্দী না থাকায় প্রতিষ্ঠাকালীন ডিবেটিং ক্লাব কমিটির আগের ইসি, ট্রেজারার ম্যাম ড.সাবিনা শরমীন, মডারেটর বুশরা জামান ম্যাম, প্রভোস্ট ম্যাম আঞ্জুমান আরা ম্যাম বর্তমান কমিটির পুরো প্রক্রিয়ায় ছিলেন। এ প্রক্রিয়ায় যদি গাফিলতি থাকে, তাহলে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার আগে আমি মনে করি তাদের সাথে আগে বসা উচিত।"
এ বিষয়ে নাইমা আক্তার রিতা আর শারমিন সুলতানা নিশির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।
হল ডিবেটিং ক্লাবের বিষয়ে হল প্রভোস্ট এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আঞ্জুমান আরাকে বার বার কল করলেও তিনি কল ধরেন নি, তবে এর আগে অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, “নির্বাচন সামনে রেখে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। যদি ইমু সত্যিই তাকে (মাবুদা) ক্ষমা চাইতে বলতে গিয়ে চাপ সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে তাকেও ক্ষমা চাইতে হবে।” তিনি আরও বলেন, “খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ এসেছে, বরবটি-কলমিশাক নিষিদ্ধ করা ছিল—তবুও কেন আনা হলো সেটিও তদন্ত করা হবে। রোববার বৈঠক ডাকা হয়েছে।”
প্রভোস্ট আরও স্বীকার করেন, “আমি শুনেছি ইমু মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। এ বিষয়ে হলে কয়েকটি অভিযোগ এসেছে। প্রয়োজন হলে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”