দেশের কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রকৃতির এক অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্পন্ন উচ্চতর কৃষিশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে অনন্য অবস্থান ধরে রেখেছে। দেশের কৃষি উন্নয়ন ও টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানসমৃদ্ধ দক্ষ কৃষিবিদ, প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও কৃষি প্রকৌশলী তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
ইতিহাস
বাংলাদেশের প্রথম উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট। ১৯৫৯ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ পূর্ব পাকিস্তান কলেজ অব ভেটেরিনারি সায়েন্স অ্যান্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করলেও স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এর নাম ঘোষণা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ভেটেরিনারি ও কৃষি অনুষদ নামে দুটি অনুষদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই পশুপালন অনুষদ নামে তৃতীয় অনুষদ চালু হয়। পরে, ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে শুরু হয় কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে কৃষি প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি অনুষদ এবং ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষাবর্ষে মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ যুক্ত হয়।
অবস্থান
ময়মনসিংহ শহর থেকে চার কিলোমিটার দক্ষিণে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে ১২০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। রাজধানী ঢাকা থেকে ১২০ কিমি উত্তরে অবস্থিত এই মনোরম সবুজ ক্যাম্পাস। সড়ক, রেল এবং নদীপথে যাতায়াতযোগ্য দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুষদ ও শিক্ষক
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ছয়টি অনুষদ, ৪৩টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউট। ভেটেরিনারি অনুষদে ৮টি, কৃষি অনুষদে ১৪টি, পশুপালন অনুষদে ৫টি, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদে ৫টি, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদে ৬টি এবং মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে ৫টি বিভাগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্নাতকপর্যায়ে ৯ টি এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৫০টি ডিগ্রি প্রদান করে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকসংখ্যা ৫৯৫ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক ৩৩০ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৬৪, সহকারী অধ্যাপক ১৬১ এবং লেকচারার ৪০ জন। কর্মকর্তা রয়েছেন ৩৯১ জন। ১১৮৯ কর্মচারীর মধ্য তৃতীয় শ্রেণির ৫৫২ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যা ৬৩৭ জন।
শিক্ষার্থী ও আবাসিক হল
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ হাজার ৪৬৯ জন। স্নাতক ৪ হাজার ৯১৬ জন, স্নাতকোত্তর ২৯৫ ও পিএইচডি ৫৫৮ জন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১১ জন। এর মধ্যে স্নাতক ১০৩ জন, স্নাতকোত্তর ৫ এবং পিএইচডি ৩ জন শিক্ষার্থী।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৮ হাজার ৩৭৮ জন গ্র্যাজুয়েট উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে স্নাতক ৩৩ হাজার ১৭৬ জন, স্নাতকোত্তর ২৪ হাজার ১০৪ ও পিএইচডি ১ হাজার ৯৮ জন। শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য ১৫টি হলের মধ্যে ছেলেদের ৯টি এবং মেয়েদের ৬টি আবাসিক হলের ব্যবস্থা রয়েছে।
রিসার্চ সিস্টেম
বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ১৯৮৪ সালের ৩০ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাউরেসের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ৪ হাজার ২৫৬টি গবেষণা প্রকল্পের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৭৩২টি গবেষণা প্রকল্প চালু রয়েছে। বাউরেস উদ্ভাবিত উন্নত কৃষিপ্রযুক্তিগুলো সম্প্রসারণের জন্য ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণ কেন্দ্র (বাউএক)।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (বিমক) আর্থিক সহায়তায় দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অফিসারদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। এ যাবৎ প্রশিক্ষণের সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯টি এবং প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজার ৫৫৩ জন। প্রশিক্ষণ এবং সেবার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক অর্জন করে।
উপাচার্য
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ জন শিক্ষক উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে প্রথম উপাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ওসমান গণি। বর্তমানে বাকৃবির ২৬তম উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া।
উপাচার্যের বক্তব্য
বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ৬৪ বছরে বাকৃবি দেশের কৃষি উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে। এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা দেশ-বিদেশে কৃষি সেক্টরে কাজ করে কৃষকের উৎপাদনশীলতা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে নিরলসভাবে অবদান রাখছে। স্বাধীনতার সময় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য জোগানো থেকে আজ সাড়ে ১৭ কোটি মানুষকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পেছনে বাকৃবির অবদান অপরিসীম। আধুনিক কৃষির রূপান্তর, জলবায়ু সহনশীল কৃষি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাকৃবি আজও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে আমাদের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার
কৃষিবিষয়ক বই সংগ্রহের বিচারে এশিয়ার বৃহত্তম লাইব্রেরি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনতলার এই ভবনে পুস্তক রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৯৭২ ভলিউম। গ্রন্থাগারে শিক্ষার্থীরা ৪০ হাজার ই-জার্নাল এবং ১০ হাজার ই-রিসোর্স সুবিধা গ্রহণ করে।
সহ-শিক্ষা কার্যক্রম
দেশের ক্যাম্পাস সাংবাদিকদের প্রথম সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (বাকৃবিসাস)। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর ১৯৬৩ সালে বাকৃবিসাস প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সংগঠনটির সভাপতি হাবিবুর রনি এবং সাধারণ সম্পাদক মো. আমান উল্লাহ দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে রোভার স্কাউট, সলিডারিটি সোসাইটি, বাঁধন, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, গ্রিন ভয়েস, রোটারেক্ট ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, সাহিত্য সংঘ, ক্যারিয়ার ক্লাব, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বিএনসিসিসহ বিভিন্ন সংগঠন শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলি, সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে।
গবেষণা কার্যক্রম
বাকৃবির গবেষকদের হাত ধরে উদ্ভাবিত হয়েছে অসংখ্য ফসলের জাত ও প্রযুক্তি। পাঙাশ থেকে ১১টি পণ্য, সরিষার ৮টি উচ্চফলনশীল, লবণসহিষ্ণু ও স্বল্পসময়ে উৎপাদনক্ষম জাত (বাউ সরিষা ১-৮), মিষ্টি আলুর ৬টি জাত (বাউ মিষ্টি আলু ৪-৬, রঙিন মিষ্টি আলু ৭-৯), উফশী ধান (বাউ-৬৩, বাউধান-২), বাউকুল, উফশী সরিষা (সম্পদ ও সম্বল, বাউ-এম/৩৯৫, বাউ-এম/৩৯৬) সয়াবিন (ডেভিস, ব্র্যাগ, সোহাগ, জি-২, বিএস-৪), আলু (কমলা সুন্দরী, তৃপ্তি), মুখীকচু তিনটিসহ (লতিরাজ, বিলাসী ও দৌলতপুরী) বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন গবেষকরা।
সম্প্রতি সময়ে ২৫টির বেশি বিপজ্জনক বালাইনাশক চিহ্নিত, চালে আর্সেনিক কমানোর সেচপদ্ধতি উদ্ভাবন, ফলের মাছি পোকা দমনে ‘ফ্রুট ফ্লাই ট্র্যাপ’, নারিকেলগাছে সাদামাছির নতুন প্রজাতি শনাক্ত, আমের বীজের নির্যাসে ব্যাকটেরিয়াবিরোধী গুণাগুণ উদ্ভাবন, সামুদ্রিক শৈবাল থেকে সাবান-ক্যান্ডি তৈরি, ব্রয়লারের হিট স্ট্রেস কমাবে আমলকী, মাছের ত্বক থেকে জেলাটিন তৈরি, অপ্রচলিত রোজেল থেকে খাদ্যদ্রব্য তৈরি, গবাদি পশুর হিট স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে এআই প্রযুক্তি, সমুদ্রে ভাসমান খাঁচায় কৃত্রিম খাদ্যে ভেটকি চাষ, বাউ বিফস্টেক টমেটো-১, নিউট্রিয়েন্ট ব্যালান্স অ্যাপ, সয়েল টেস্টিং কিট, সোলার ড্রায়ার, বাউ এসটিআর ড্রায়ার, উন্নত লাঙল ও স্প্রে মেশিন, আইপিএম ল্যাব বায়োপেস্টিসাইড, দেশি খেজুর থেকে ভিনেগার উৎপাদন, কলা ও আনারস উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলাসহ অসংখ্য কৃষি যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
গরু-ছাগলের মাংসে যক্ষ্মার জীবাণু শনাক্তকরণ, ব্রুসেলোসিসের হিট ফিল্ড ভ্যাকসিন, মোরগ-মুরগির রাণীক্ষেত রোগ ও ফাউলপক্সের প্রতিরোধক টিকা, হাঁসের পেগ ভ্যাকসিন, হাঁস-মুরগির ফাউল কলেরার ভ্যাকসিন, মুরগির স্যালমোনেলোসিস রোগ নির্ণয় প্রযুক্তি, গবাদি পশুর ভ্রূণ প্রতিস্থাপন, ছাগল ও মহিষের কৃত্রিম প্রজনন, কৃত্রিম প্রজননে ব্যবহৃত ষাঁড়ের আগাম ফার্টিলিটি নির্ণয়, গাভির উলানফোলা রোগপ্রতিরোধ কৌশল, হরমোন পরীক্ষার মাধ্যমে গরু ও মহিষের গর্ভ নির্ণয়, হাঁস-মুরগির উন্নত জাত উদ্ভাবন, সুষম পোলট্রি খাদ্যসহ প্রাণিসম্পদ খাতে অসংখ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বাকৃবির গবেষকরা।
কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন অনুসন্ধানী গবেষণা তৎপরতার মাধ্যমে টেকসই শস্যবীমা কার্যক্রম, পশুসম্পদ উপখাত ও ডেইরি উৎপাদনের উন্নয়ন, বাকৃবি জিয়া সার-বীজ ছিটানো যন্ত্র, উন্নত ধরনের হস্তচালিত টিউবওয়েল পাম্প, মাগুর ও শিং মাছের কৃত্রিম প্রজননের কলাকৌশল, শিং মাছের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন, ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি, খাঁচায় পাঙাশ চাষ, পেরিফাইটন বেজড মৎস্য চাষ, দেশি পাঙাশের কৃত্রিম প্রজনন, ডাকউইড দিয়ে মিশ্র মৎস্য চাষ, মাছের জীবন্ত খাদ্য হিসেবে টিউবিফিসিড উৎপাদনের কলাকৌশল, পুকুরে মাগুর চাষের উপযোগী সহজলভ্য মৎস্য খাদ্য তৈরি, শুক্রাণু ক্রয়োপ্রিজারভেশন প্রযুক্তি, স্বল্প ব্যয়-মিডিয়ামে ক্লোরেলার চাষ, মাছের পোনা পালনের জন্য রটিফারের চাষ, মাছের রোগ প্রতিরোধকল্পে ঔষধি গাছের ব্যবহার এবং মলিকুলার পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছের বংশ পরিক্রম নির্ণয়, তারাবাইম, গুচিবাইম ও বাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন, ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ি চাষ, সহজলভ্য মাছের খাদ্য তৈরি, একোয়াপনিকসের মাধ্যমে মাছ এবং সবজি উৎপাদন, মাছের বিকল্প খাদ্যের জন্য ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই চাষসহ মৎস্য খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে বাকৃবি। এছাড়া বাকৃবি ও বিনারবিজ্ঞানীরা মিলে লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে বাকৃবির অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে একজন শিক্ষকসহ ১৮ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ জামাল হোসেন হল, শহীদ শামসুল হক হল এবং শহীদ নাজমুল আহসান হল হয়েছে। এছাড়া ক্যাম্পাসে রয়েছে বিজয় ৭১, মরণসাগর স্মৃতিসৌধ ও শহীদ মিনার। ১৯৯৩ সালের ১৪ নভেম্বর উদ্বোধন করা হয় শহীদ বধ্যভূমি।
ভৌত স্থাপনা ও স্থান
প্রশাসনিক ভবন, অনুষদীয় ভবন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলন কেন্দ্র, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, প্রক্টর কার্যালয়, কেন্দ্রীয় মসজিদ, হেলথ কেয়ার সেন্টার, সেন্ট্রাল ল্যাবরেটরি, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, অতিথি ভবন ও কমিউনিটি সেন্টার, ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউস, সিড প্যাথলজি সেন্টার, শহীদ সাদ ইবনে মমতাজ পিএইচডি ডরমিটরি, আইআইএফএস এবং আইএডিএস। গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সুবিধার জন্য রয়েছে ডেইরি ফার্ম, পোলট্রি ফার্ম, ছাগল এবং ভেড়ার খামার, উদ্যানতত্ত্ব খামার ও ফিশ ফার্ম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে রয়েছে বহু পরিচিত স্থান ও মিলনকেন্দ্র। ফাস্ট গেট, ফিশারিজ মোড়, আব্দুল জব্বার মোড়, শেষ মোড়, লন্ডন ব্রিজ, কেআর মার্কেট, রেললাইন, হতাশার মোড়, বৈশাখী চত্বর, নদের পাড়, লেক, মিলন হোটেল, কৃষিবিদ চত্বর, লেক ভিউ এই জায়গাগুলো ক্যাম্পাসের জীবনধারায় যুক্ত করেছে নান্দনিকতা ও প্রাণচাঞ্চল্য।
বোটানিক্যাল গার্ডেন
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষে ২৫ একর জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে মনোমুগ্ধকর বোটানিক্যাল গার্ডেন। এখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন অঞ্চলের বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় কয়েক হাজার উদ্ভিদের বিশাল সম্ভার। দেশি প্রায় সব প্রজাতির উদ্ভিদের পাশাপাশি বিদেশি অনেক বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ছোট-বড়-মাঝারি ধরনের অসংখ্য গাছে ভরপুর গার্ডেনে রয়েছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির প্রায় ১০০০টি বড়, ১২৭৮টি মাঝারি ও ৪৪৬৭টি ছোটসহ প্রায় ৬৭৪৫টি গাছ। আন্তর্জাতিক সংস্থা বোটানিক গার্ডেনস কনজারভেশন ইন্টারন্যাশনাল (বিজিসিআই) কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম বোটানিক্যাল গার্ডেন এটি।
কৃষি জাদুঘর
আধুনিকতার ছোঁয়ায় প্রাচীনকালে ব্যবহৃত কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি এখন বিলুপ্তির পথে। এসব বিলুপ্ত প্রায় কৃষি যন্ত্রপাতি সংরক্ষণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে কৃষি জাদুঘর, সবাই যাকে কৃষি মিউজিয়াম নামে চেনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে এবং বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) সামনে জাদুঘরটি অবস্থিত। কৃষি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, প্রাচীনকালের কৃষি উপকরণ এবং যন্ত্রপাতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণে কৃষি যন্ত্রপাতি সংরক্ষণে ২০০৩ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয় কৃষি জাদুঘর। ২০০৭ সালের ৩০ জুন থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
ফিশ মিউজিয়াম
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বাংলাদেশের প্রথম ও সর্ববৃহৎ মৎস্য জাদুঘর ‘ফিশ মিউজিয়াম অ্যান্ড জার্মপ্লাজম সেন্টার’। সহজেই মাছের সঙ্গে পরিচিত হতে পারা, বিলুপ্ত এবং বিলুপ্তপ্রায় সব স্বাদুপানি ও সামুদ্রিক মাছ এবং জলজ প্রাণী সংরক্ষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই জাদুঘরটি। প্রায় ২৩৫ প্রজাতির দেশীয় মাছ ও বিভিন্ন জলজ প্রাণীর এক বিশাল সংগ্রহশালা। অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী রেজা হোসেনের ১০ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে ওঠা এ সংগ্রহশালা ২০১০ সাল থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ৫টি কক্ষে সাজানো এ জাদুঘর ২০১৮ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
জার্মপ্লাজম সেন্টার
আমেরিকার ‘ইউএস-ডিএআরএস’-এর গবেষণায় এটি বাংলাদেশ তথা এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ফলদ বৃক্ষের সংগ্রহশালা। ফলের জিন সংরক্ষণ, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র, ফলের হিডেন নিউট্রেশন সংরক্ষণ এবং কৃষকদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাকৃবির উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের সহযোগিতায় ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের অর্থায়নে ১৯৯১ সালে মাত্র ১ একর জমিতে কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে এটি বিস্তৃত হয়েছে প্রায় ৩২ একরজুড়ে।
খামার ব্যবস্থাপনা শাখা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্ন থেকে খামার ব্যবস্থাপনা শাখার অধীনে ৭৭৪ একর জমি থাকলেও বর্তমানে ২১১ একর আবাদি ও অনাবাদি জমি রয়েছে। এখন পর্যন্ত এসব জমির উৎপাদিত ১ কোটি ১৬ লাখ কেজি বীজ কৃষকের কাছে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার একর জমিতে বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ কৃষক সরাসরি বীজ ধান পেয়ে উপকৃত হয়েছে। এছাড়া ৩৪ হাজার কেজি গমের বীজ কৃষকের কাছে সরবরাহ করা হয়েছে।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠান
ফ্যাবল্যাবে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত উপকরণের প্রোটোটাইপ তৈরি, বিভিন্ন মেশিনের মডিউল তৈরি ও সিমুলেশন, কৃষি যন্ত্রপাতির নকশা এবং উন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের থিসিস প্রকল্প নির্মাণ ও প্রকল্প মডেলিংয়ের কাজে নিয়মিতভাবে গবেষণা এবং উদ্ভাবন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
ক্লিনিক : প্রশিক্ষণ, পশু চিকিৎসাসেবা প্রদানের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম পশু চিকিৎসালয় বাকৃবি ভেটেরিনারি ক্লিনিক। এছাড়া রয়েছে উদ্ভিদের রোগ নির্ণয়, গবেষণার কাজে ব্যবহৃত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম উদ্ভিদ চিকিৎসাকেন্দ্র ‘প্লান্ট ডিজিজ ক্লিনিক’।
আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কয়েকগুণ বেড়েছে খাদ্যশস্য উৎপাদন। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বাকৃবির হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট কৃষিবিদ। দেশের বিভিন্ন কৃষি সেক্টরে তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করে দেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। দেশের কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মৎস্য, ভেটেরিনারি, কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি খাতে তারা নিবেদিতভাবে কাজ করে কৃষিকে করেছেন আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও টেকসই।
ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত সবুজে ঘেরা মনোরম এ ক্যাম্পাস শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি বাংলাদেশের কৃষি বিপ্লবের সূতিকাগার। একাধিক দর্শনীয় স্থান, বিশ্বমানের গবেষণা এবং হাজারো সফল কৃষিবিদের সম্মিলনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আজ জাতির গর্ব, দেশের কৃষির আলোকবর্তিকা।