নিপুণ গোলাকার আকৃতির মৃত হ্রদ ‘সেন্ট আনা’ প্রায় ৯৫০ মিটার উচ্চতায় ঘুমন্ত এক আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ভেতর অবস্থিত। বৃষ্টির থইথই জলে হ্রদটি ভরপুর। ঝাঁকে ঝাঁকে শুধু ক্যাটফিশেরাই এখানে বাস করে। ভাল্লুকেরা পানি খেতে আসে এখানে, মানুষের পথ না মাড়িয়ে পাইন-অরণ্যের ভেতর থেকে হেলেদুলে তারা বের হয়ে আসে।
হ্রদের অপরপাশেই একটা সমতল জলাভূমি আছে, স্যাঁতসেঁতে নরম ভূভাগ, লোকজন খুব একটা যায় না সেখানে। এখন সেই জলাভূমির ওপর কাঠের তক্তায় বানানো একটা আঁকাবাকা পথ শুয়ে আছে।
এই হ্রদটাকে শ্যাওলার লেকও বলে; আর এর জলের কথা যদি বলি, জনশ্রুতি আছে—এর পানি কখনো জমে না। হ্রদের মাঝামাঝি জায়গাটা সবসময়ই উষ্ণ। লেকের মৃত পানির মতো আগ্নেয়গিরির মুখটাও হাজার হাজার বছর ধরে মরে পড়ে আছে।
শতাব্দীর থমথমে নৈঃশব্দ্য এই বিরানভূমির ওপর সর্বদা উবুড় হয়ে বসে থাকে।
এক আদর্শ জায়গা বটে! আর্ট ক্যাম্পের আয়োজকদের একজন প্রথম দিনই আগত শিল্পী-কবিদের চারপাশটা ঘুরিয়ে দেখানোর সময় এই মন্তব্য করেছিলেন—জটিল চিন্তাভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকবার জন্য উপযুক্ত স্থান তো বটে, ঘোরাঘুরির জন্যও সেরা, সর্বদা সতেজ হাওয়া বইছে। মনোরম এই সুব্যবস্থার ব্যবহার করেছিল সকলে। ক্যাম্পের খুব কাছেই হাজার মিটার উঁচু শৃঙ্গের পর্বত। পাহাড়ে ওঠানামার চড়াই-উতরাই দুই পথে পথিকের ভিড়ও ছিল বেশ, ভিড়—তার মানে এই নয় যে, আর্টক্যাম্পে এক্সাইটিং কাজকর্ম কিছু হচ্ছিল না। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর সকলে আরো উদ্যমে-উৎসাহে সৃজনশীল কাজে মগ্ন হচ্ছিল, সময়—তার স্বভাবমতোই কেটে যাচ্ছিল আর তাদের সৃষ্টিমুখর অভিপ্রায়গুলো এই জায়গার বরকতে পুষ্ট হচ্ছিল, ধীরে ধীরে কল্পনা থেকে বাস্তবে আকৃতি পাচ্ছিল নান্দনিক শিল্পকর্মগুলো।
প্রত্যেকেই ক্যাম্পে বরাদ্দ পাওয়া জায়গায় থিতু হয়েছে, নিজেদের মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছে। অধিকাংশই মূল ভবনে ব্যক্তিগত ঘর পেয়েছে, কেউ কেউ ইচ্ছা করে পুরোনো কাঠের কুঁড়েঘরে বা বহুদিনের পরিত্যক্ত চালাঘরে জুটেছে। তিনজন উঠেছিল ক্যাম্পের মধ্যিখানে মূল ভবনের বিশাল চিলেকোঠা ঘরে। সকলেই আপন ধ্যানমঞ্চটি নির্ধারণ করে নিয়েছিল। বলা বাহুল্য, মননশীল কাজের সময় নিরবচ্ছিন্ন নির্জনতা সবচেয়ে জরুরি বিষয়।
সেভাবেই কাজ চলছিল নির্বিঘ্নে, প্রশান্তচিত্তে, দিনগুলোও কেটে যাচ্ছিল সেই ছন্দেই—বেশিরভাগ সময় কাজ, বাকি সময়টুকু হাঁটা, হ্রদে একটু মনোরম স্নান, সুস্বাদ খাওয়া-দাওয়া আর সন্ধ্যায় ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে বসে হোমমেইড ব্রান্ডি হাতে দিলখোলা গান।
তবে এই গল্পে এমন সাধারণ সামষ্টিক বর্ণনাভঙ্গি ব্যবহার করাটা ভুল হয়েছে আসলে, কারণ ধীরে ধীরে; কিন্তু নিশ্চিতভাবেই প্রকাশ পেল— যেটা সূক্ষ্ম অবজার্ভারেরা প্রথম দিনেই টের পেয়েছিলেন; আর বাকিদের কাছে তৃতীয় দিন সকাল নাগাদ ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত হলো—বারোজনের এই দলে এমন একজন আছে, যিনি বাকিদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাতের।
তার আগমনটাই স্বয়ং ঘোর রহস্যময়, বা ন্যূনতম এইটুকু তো বটেই; অন্যদের মতো সে—না ট্রেনে এসেছে, না বাসে।
যেদিন সে আসে, সন্ধ্যা ৬টা বা সাড়ে ৬টা হবে, সবাই দেখল, হঠাৎ করেই তিনি পায়ে হেঁটে শিবিরের ফটক দিয়ে ঢুকে পড়লেন, যেন সোজা হেঁটেই চলে এসেছেন; একবার শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানালেন সকলের উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে।
আয়োজকেরা এমনকি একরকম সম্মান দেখিয়েই প্রথমে তার নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন। লোকটির উদাসীন নীরবতার প্রতিক্রিয়ায় তাদের আরো কৌতূহলী হয়ে জোরদার জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলো—তিনি কীভাবে এলেন? লোকটা দায়সারা উত্তর করল শুধু—কেউ তাকে গাড়িতে করে রাস্তার এক মোড়ে ছেড়ে গিয়েছে।
কিন্তু চরাচরব্যাপী এই নৈঃশব্দ্যের ভেতর কেউ তো কোনো গাড়ির শব্দ শুনল না, যেটা তাকে রাস্তার বাঁকে নামিয়ে যেতে পারে!
তাই এই ভাবনাটা—যে তিনি একটি গাড়িতে এসেছেন বটে, কিন্তু সেই গাড়ি পুরো পথ নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট রাস্তার বাঁক পর্যন্ত এসেছে এবং তারপর তিনি নেমে হেঁটে এসেছেন—তা বেশ অবিশ্বাস্য লাগল, কেউই তাকে ঠিক বিশ্বাস করল না—বা আরো পয়েন্টে যদি বলি, কেউ তার কথার মর্ম বুঝে উঠতে পারছিল না।
তাই সেই প্রথম দিন থেকেই একমাত্র সম্ভাব্য, একমাত্র যুক্তিসংগত—যদিও একইসঙ্গে সবচেয়ে অযৌক্তিক সম্ভাবনাটি অবশিষ্ট ছিল—তিনি পুরো পথটাই হেঁটে এসেছেন।
বুখারেস্ট থেকে যাত্রা শুরু হলো। ট্রেনে-বাসে চড়েননি, কেবল অবিরাম পায়ে হাঁটা; কে জানে কত সপ্তাহ ধরে—সেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ পেরিয়ে সন্ধ্যা ছ’টা বা সাড়ে ছ’টার দিকে সেন্ট আনা হ্রদের পাশে স্থাপিত আর্টক্যাম্পটির ফটকে এসে হাজির হয়েছিলেন এ আগন্তুক। তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, আয়োজক কমিটি কি জনাব আয়ন গ্রিগোরেস্কুকে স্বাগত জানানোর সম্মান পাচ্ছে? তখনো তিনি একটি সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ-বাচক মাথা নেড়ে উত্তর সেরেছিলেন।
অবশ্য তার জুতাটার দিকে তাকালে সম্ভাবনাটাকে এত অবিশ্বাস্যও লাগবে না। জুতো দুটো সম্ভবত বাদামি রঙের ছিল একসময়—হালকা, গরমের দিনের জন্য বানানো সিন্থেটিকের লোফার, আঙুলের ডগার অংশে ছোট নকশা সেলাই করা ছিল, এখন ফাটা-ছেঁড়া জুতাটা যেন পায়ের চারপাশে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়বে। সোল দুটো আলগা হয়ে গিয়েছে, হিলগুলো ক্ষয়ে সমতল, ডান পায়ের কনি আঙুলের কাছে চামড়ার আবরণীটা ত্যারছাভাবে ছিঁড়েছে, ফলে নিচের মোজা প্রকাশিত হয়ে আছে।
তার সবকিছু শেষ অবধি একটা রহস্যই থেকে গেল, কারণ শুধু তার জুতোগুলোই নয়, বরং তিনি যে পোশাক-পরিচ্ছদ পরেছিলেন তাও অন্যদের পশ্চিমা বা পশ্চিমাসুলভ পোশাক থেকে ছিল আলাদা। তার জামাকাপড় দেখে মনে হচ্ছিল ব্যক্তিটি এইমাত্র সোজা চাউশেস্কু যুগ—আশির দশকের শেষ দিকের সেই দারিদ্র্য আর হতাশার সময় থেকে টাইম ট্রাভেল করে হঠাতই বর্তমানের চিত্রপটের ভেতর এসে উপস্থিত হয়েছেন।
বিবর্ণ ফ্যাকাশে ঢিলেঢালা প্যান্টটা মোটা ফ্লানেল কাপড়ের মতো কিছু একটা দিয়ে তৈরি, টাখনুর ওপর নির্বিকারভাবে ঝুলছিল এবং আরো বেদনাজনক তার হতদরিদ্র ঢিলেঢালা কার্ডিগানটি, এক বিপুল হতাশার মতো শ্যাওলাধরা মলিন সবুজ—একটি চেক শার্টের উপর চাপানো, গরমকাল সত্ত্বেও গলা পর্যন্ত বোতাম লাগানো ছিল।
জলচরী হাসের মতো তিনি হালকা গড়নের, কুঁজো কাঁধ, মাথাজোড়া টাক, বিকটদর্শন বিধ্বস্ত মখাবয়বে গাঢ়-বাদামি দুটো বিশুদ্ধ চোখ, জ্বলছিল—দুটো নিখাদ জ্বলন্ত চোখ; ভেতরের উত্তাপে জ্বলছিল না, বরং দুটি স্থির আয়নার মতো, যেন বাইরের কোনো জ্বলন্ত জিনিসকে প্রতিফলিত করছে।
তৃতীয় দিনের মধ্যে সবাই বুঝতে পারল, আর্ট ক্যাম্প তার জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় না, কাজকর্ম কিছুই করতেন না, সামার ভ্যাকেশনে মানুষ যা করে—সাঁতার কাটা, পাহাড়ি পথে হাঁটা বা মাছ ধরা বা আরো মনোরম আনন্দদায়ক কাজকর্ম কিছুই তিনি করতেন না, যা এই ধরনের আর্টক্যাম্পগুলোতে এসে লোকে প্রধানত করে।
আয়োজকদের কাছ থেকে একজোড়া জুতো চেয়ে নিয়েছিলেন তিনি। (তারা স্টোর রুমে পেরেকে ঝোলানো একজোড়া বুট খুঁজে পেয়েছিল) তিনি সারা দিন সেই বুট পরে ঘুরতেন। ক্যাম্পের ভেতরেই ঘোরাফেরা, কখনো পরিধির বাইরে যেতেন না, কখনো পাহাড়ে ওঠেননি, কখনো পাহাড় থেকে নামেননি, কখনো হ্রদের চারপাশে পায়চারি করেননি, এমনকি শৈবাল-ঢাকা ছোট হ্রদের ওপর কাঠের তক্তা বিছানো পথটিতেও কখনো হাঁটতে দেখা যেত না তাকে। ক্যাম্পেই থাকতেন, এদিক-সেদিক পায়চারি করতেন, অন্যরা কী কাজকর্ম করছে, তা দেখতেন, মূল ভবনের সমস্ত ঘরেই তার যাতায়াত ছিল।
চিত্রশিল্পী, প্রিন্টমেকার, ভাস্করদের পিঠের পেছনে নীরবে এসে থামতেন এবং গভীর মনোযোগে দেখতেন—কীভাবে একটি শিল্পকর্ম দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে; চিলেকোঠায় উঠতেন, চালাঘরে ও কাঠের কুঁড়েঘরে যেতেন, কিন্তু কারো সঙ্গে কথা বলতেন না, কোনো প্রশ্নের উত্তরে সামান্যতম শব্দও মুখ থেকে বেরুতো না, যেন তিনি বোবা-কালা, বা যেন তিনি বুঝতে পারছেন না তার কাছে কী চাওয়া হচ্ছে; একেবারে নিঃশব্দ, নির্লিপ্ত, অনুভূতিহীন—একটি ভূতের মতো, একটি গাছের মতো এবং যখন তারা এগারোজনই তাকে খেয়াল করতে শুরু করল; যেমন করে গ্রিগোরেস্কুও তাদের পর্যবেক্ষণ করছিল—তাদের একটা উপলব্ধি হলো।
তারা সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে বসে নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছিল। (গ্রিগোরেস্কুকে কখনো সে আড্ডায় দেখা যায়নি, সে প্রতিদিনই তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেত) উপলব্ধিটা হলো যে, হ্যাঁ, লোকটার আগমন হয়তো অদ্ভুত ছিল, তার জুতো, তার কার্ডিগান, তার বিধ্বস্ত মুখ, তার শীর্ণজীর্ণ পরিচ্ছদ, তার ইটের ভাটার মতো চোখ, সবই অস্বাভাবিক—কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টা তারা তখনই আবিষ্কার করল, যা এতদিন কারো চোখে পড়েনি এবং সেটাই আসলে সবচেয়ে আশ্চর্য—এই মহান সৃজনশীল মানুষটি, যিনি সবসময় সতেজ সক্রিয় বলে পরিচিত, এখানে এসে যেখানে সবাই শিল্প তৈরিতে মগ্ন—তিনি পুরোপুরি বেকার, একেবারেই কিছুই করছেন না।
তিনি যে কিছুই করেন না—এই উপলব্ধিটাই তাদের বিস্মিত করছিল। আরো বেশি অবাক হচ্ছিল এই ভেবে, এত দিনে তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারল! ক্যাম্প শুরু হওয়ার পর ছয়, সাত, বা আট দিন কেটে গিয়েছে। কেউ কেউ তো তাদের কাজে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে, অথচ এখন এই মুহূর্তে তারা ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
তিনি আসলে কী করছিলেন?
কিছুই না, একেবারেই কিছুই না। নাথিংনেস!
তখন থেকে অজান্তেই তার গতিবিধির প্রতি নজর পরতে থাকল তাদের, আর একদিন কোনো এক উপলক্ষে সম্ভবত দশম দিনে তারা খেয়াল করলেন, ভোরবেলা এবং পুরো শান্ত সকালের সময়টা জুড়েই, যখন সাধারণত অন্যরা ঘুমিয়ে থাকে, তখন বেশ কিছুটা সময় এমন যায়, যখন গ্রিগোরেস্কু, যিনি সাধারণত ভোরের ওঠেন বলেই পরিচিত, তাকে কোথাও দেখা যায় না । কোথাও নেই—না কুড়েঘরে, না চিলেকোঠায়, না ভেতরে না বাইরে, কিছু সময়ের জন্য তিনি জাস্ট ‘নাই’ হয়ে যান।
তাদের কৌতূহল তীব্র হলো। বারোতম দিন সন্ধ্যায় কয়েকজন অংশগ্রহণকারী সিদ্ধান্ত নিল, তারা পরদিন খুব ভোরো ঘুম থেকে জেগে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে। একজন হাঙ্গেরিয়ান চিত্রশিল্পী অন্যদের জাগানোর দায়িত্ব নিল। গ্রিগোরেস্কু তার ঘরে নেই এটা যখন তারা নিশ্চিত হলেন, তখনো রাত অন্ধকার, ভোর হবে হবে, তারা মূল ভবন ঘুরে এসেছে, প্রধান ফটক পেরিয়ে বাইরেও খুঁজেছে, কুঁড়েঘর, চিলেকোঠাও দেখে এসেছে দুজন; কিন্তু কোথাও লোকটার চিহ্ন নেই। হ্রদ থেকে মৃদুমন্দ সমীরণ বইতে শুরু করেছে, ভোরের প্রস্ফুটমান আলোয় তারা বিভ্রান্তের মতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মাথার ওপর দিয়ে পরি উড়ে যাওয়ার মতো আকস্মিক নীরবতা। কিছুক্ষণ পর একটি শব্দে তারা সংবিৎ ফিরে পেল।
শব্দটা অতি ক্ষীণ, কোত্থেকে আসছে বোঝা যাচ্ছিল না। কিছুটা দূর থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছে সাউন্ড, আরেকটু সংহত করে বললে, ক্যাম্পের অদৃশ্য অনুমেয় সীমানার ওপার থেকে, দুটো বাথরুম দেওয়া আছে ওখানে, ধরে নেওয়া হয় ওটিই একটি সীমানা, কারণ সেখানের শুরুবিন্দুটি থেকে ভূখণ্ডটি আর ক্যাম্পের পরিপাটি অঙ্গনের মতো ছিল না; সর্বময় বিরাজমান প্রকৃতি, যাকে কোনো একসময় জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এখান থেকে, সে এখনো ফিরিয়ে নেয়নি বটে, তবুও স্থানটা পরিত্যক্ত, এক ধরনের এবড়োখেবড়ো, ভূতুড়ে, নো-ম্যান’স ল্যান্ডের মতো, যার উপর ক্যাম্পসাইটের মালিকরা ব্যবহৃত আবর্জনা ফেলার স্থান ছাড়া আর কোনো দৃশ্যমান দাবি রাখেনি। ভাঙা ফ্রিজ থেকে শুরু করে প্রতিদিনের রান্নাঘরের ময়লা, যা কিছু ফেলা যায়, সবই সেখানে ফেলা হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পুরো জায়গাটা ঢেকে গেছে ঘন ও কাঁটাওয়ালা আগাছা পরগাছায়—মানুষের সমান উঁচু এক অবিনশ্বর জঙলার স্তর, ইউজলেস।
নিচে কোথাও এই ঝোপঝাড়ের কোনো এক পয়েন্ট থেকে শব্দটা ভেসে আসছে। এরপর কী করতে হবে, তা নিয়ে আর দ্বিধায় রইল না তারা। কোনো শব্দ খরচা হলো না, মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, নীরবে মাথা নাড়ল, জংলার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিছু একটা লক্ষ করে এগিয়ে চলল ঝোপ বিধ্বস্ত করে, শ্যাওলা মাড়িয়ে সামনের দিকে। বেশ গভীরে যাওয়ার পর ক্যাম্পসাইটের ভবনগুলো থেকে বেশ দূরেই, তারা শব্দটাকে চিনতে পারল। গর্ত খোড়ার শব্দ। কেউ মাটি খনন করছে। শব্দের উৎসের দিকে ঘুরল এবারে। যন্ত্রটা মাটিবক্ষ ভেদ করছে, তারপর মৃত্তিকা তুলে উপরে ছুঁড়ে ফেলছে, আর সেটা বুনো ঝাউ ঘাসের ওপর পড়ে ঝপ-ঝপ শব্দ করছে। শব্দ লক্ষ করে তাদের ডানে মোড় নিতে হলো, দ্রুত দশ-পনেরো পা এগুতেই একটা বিশাল গর্তের কিনারে আবিষ্কার করল নিজেদের, আরেকটু হলে গড়িয়ে যেত নিচের দিকে। গর্তটা প্রায় তিন মিটার চওড়া এবং পাঁচ মিটার লম্বা, যার কেন্দ্রতলে গ্রিগোরেস্কুকে দেখা গেল, এক ধ্যানে কাজ করছেন। পুরো গর্তটি বেশ গভীর, মস্তকটি ওপর থেকে দেখা যায় কি যায় না এবং তিনি এমন ধী-সহযোগে কাজ করছিলেন, টেরই পাননি কয়েকজন যে এসে দাঁড়িয়েছে এখানে। দৈত্যাকার গর্তটির কিনারায় দাড়িয়ে তারাও কেবল নীরবে কাজ দেখছিল গ্রেগেস্কুর।
গর্তের ভেতর, একদম মাঝখনে, একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। পুরোটা মাটি থেকে গড়া, মেটে ভাস্কর্য। প্রথম নজরে তারা শুধু এটুকুই দেখল—একটা মাটির তৈরি ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল ভাস্কর্যটা এত নিখুঁত, এত জান্তব, যেন ঘোড়াটা কেশর ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে পাশ ফিরল—ভীষণ জোরে দৌড়াচ্ছে, কোথাও পালাচ্ছে, দাঁত বেরিয়ে আছে, মুখে ভয়ের ফেনা জমেছে। শেষে তারা বুঝল, গ্রিগোরেস্কু আসলে চারপাশের আগাছা পরিষ্কার করে বিশাল এই গর্তটা খুঁড়েছে। মাঝের অংশে ঘোড়াটির চারপাশ থেকে সে এমনভাবে মাটি সরিয়েছে, যেন আতঙ্কিত স্থবির একটা ঘোড়া মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে, যেনবা সে ছিল পাতাললোকে, গভীর কোনো অজানা ভয়ের তাড়া খেয়ে পালাচ্ছিল জ্যান্ত ঘোড়ার মতো, আর গ্রিগোরেস্কু তাৎক্ষণিকভাবে তাকে মাটি খুঁড়ে মুক্ত করেছেন। হতভম্ব হয়ে তারা কজন গ্রিগেরেস্কুর কাজ দেখছিল সে ভোরবেলায়, সে এক মনে কাজ করে যাচ্ছে, আশপাশের উপস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, উদাস। ১০ দিন ধরে তাহলে তিনি এই কাজটা করছেন, ভোর থেকে সকাল অবধি খোঁড়াখুঁড়ির কাজটা করেন। একজন দর্শকের পায়ের নিচ থেকে মাটি পিছলে পড়ল। তার শব্দে মনোযোগ বিঘ্নিত হলে গ্রিগেরেস্কু কাজ না থামিয়ে ওপরে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য শুধু দণ্ডায়মান ব্যক্তিদের দিকে ফিরে মাথা ঝুঁকিয়ে মৃদু কুর্নিশ করল।
শিল্পীদের ভেতর অস্বস্তি শুরু হলো, কারু কিছু বলা উচিত এখন। ফরাসি চিত্রশিল্পী একজন মৃদু গলাখাঁকারি দিয়ে নিচু স্বরে বলল, অসাধারণ কাজ হচ্ছে, আয়ন! গ্রিগোরেস্কু এবার কাজ থামিয়ে মই বেয়ে গর্ত থেকে উঠে এলেন। পরিষ্কার করার জন্য রাখা কোদাল দিয়ে বেলচায় লেগে থাকা মাটি পরিষ্কার করলেন। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। তারপর হাতটা ধীর ভঙ্গিতে নেড়ে চারপাশের পুরো পটভূমির দিকে বড় করে ইঙ্গিত করলেন আর ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন, এখনো এমন অনেক সংবিগ্ন ঘোড়া মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। তারপর বেলচা তুলে আবার মই বেয়ে গর্তে নেমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করলেন। বাকি শিল্পীরা কিছুক্ষণ সেখানে বিমূঢ় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে মূল ভবনের দিকে ফিরে গেল। কর্মশালার বিদায়ি দিন চলে এলো।
আয়োজকরা শেষ সন্ধ্যায় বড় খানার আয়োজন করল, পরদিন সকালে পাততাড়ি গুটিয়ে ক্যাম্পের গেটগুলো বন্ধ করা হলো; একটি চার্টার্ড বাস প্রস্তুত সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, আর যারা বুখারেস্ট বা হাঙ্গেরি থেকে নিজ গাড়িতে ড্রাইভ করে এসেছিল, তারা সেভাবেই রওনা করল। গ্রিগোরেস্কু বুটগুলো আয়োজকদের ফিরিয়ে দিয়ে নিজের পুরোনো জীর্ণ জুতাজোড়া পড়ে নিলেন, কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করে বাসে উঠলেন। বাস ক্যাম্প থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি গ্রাম্য রাস্তার বাঁকে পৌঁছালে তিনি হঠাৎ বাসচালককে গাড়ি থামাতে নির্দেশ দিলেন, কিছু একটা বললেন, যার অর্থ—এখান থেকে তার একাই এগিয়ে যাওয়াটা ভালো হবে, কেউ স্পষ্ট বুঝতে পারল না তার কথাটা, কণ্ঠস্বর খুবই জড়ানো ছিল। বাসটা মোড়ে পেরিয়ে চোখের আড়াল হলো। গ্রিগোরেস্কু রাস্তা পার হওয়ার জন্য ঘুরলেন, আর হঠাৎই সর্পিল আঁকাবাঁকা পথের নিচে মিলিয়ে গেলেন—যেন হাওয়া। পড়ে রইল কেবল শূন্য দৃষ্টিভূমিটি, পর্বতমালার অটুট মৌনতা, খাঁ-খাঁ প্রান্তরজুড়ে ঝরাপাতা মরাপাতারা আর এক সীমাহীন নিস্তব্ধতা—যা সবকিছুকে ক্যামোফ্লেজে গোপন করে রেখেছে, লুকিয়ে রেখেছে মাটির গভীরে জ্বলন্ত পৃথিবীর অতলে যা কিছু বিহ্বল...