‘আল্লাহ সুন্দর, সৌন্দর্য ভালোবাসেন’―নবীজির এই বাণী নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যতত্ত্বের সংক্ষিপ্তসার, যার গভীর কিন্তু স্পষ্ট বার্তা হলো, সৌন্দর্য একটি স্বর্গীয় সিফাত। যা সুন্দর তার সবকিছুতেই সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। আধুনিক বিশ্বের গভীরতর কদর্যতার প্রেক্ষিতে সৌন্দর্যের এই সহজাত তাৎপর্য মনে রাখা জরুরি বৈকি।
অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী সমাজে সৌন্দর্যই ছিল স্বাভাবিকতা, কদর্যতা ব্যতিক্রম। কিন্তু আজ তা প্রায় বিপরীত রূপ গ্রহণ করেছে। কদর্যতাই হয়ে উঠেছে আসল নিরিখ। ফলে শিল্পোন্নত শহরসমূহে সৌন্দর্যের সন্ধানে আপনাকে হতে হবে গলদঘর্ম।
মুসলিম জাতিসমূহ এই অতি-আধুনিকতার বিস্তৃত কদর্যতায় আরো বেশি ছন্নছাড়া। তারা না পারছে আবহমান সৌন্দর্য রক্ষা করতে, না পারছে আধুনিক কলা-কানুনে আপাদমস্তক অভ্যস্ত হয়ে যেতে। ফলাফল―অন্তর্গত বিভ্রান্তি এবং ক্রমবর্ধমান অসহায়ত্ব।
অথচ এই মুসলিমরাই নির্মাণ করেছিলেন ইতিহাসের অসংখ্য সুন্দরতম মানববসতি― সমরখন্দ, বুখারা (উজিবেকিস্তান), বাগদাদ (ইরাক), ইসফাহান, শিরাজ (ইরান), ইস্তাম্বুল, বুরসা (তুরস্ক), কর্ডোবা, গ্রানাডা (স্পেন), টিম্বকটু (মালি), ফেজ ও মারাকেশ (মরক্কো) তাদের অন্যতম।
এই শহরগুলো একদিকে, নিঃসন্দেহে, ইসলামি সৌন্দর্যচেতনাকে মূর্ত করে তোলে। অন্যদিকে সৌন্দর্য ও কার্যকারিতা, পরিমিতি ও গতিশীলতা, প্রশান্তি ও উৎপাদনশীলতা, বস্তু ও রূপ, আত্মচেতনা ও বহুত্ববাদ শহুরে পরিবেশে কীভাবে সম্প্রীতি ও সাযুজ্যের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে তার সাক্ষ্যও দেয়। ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যেও আমরা দেখতে পাই, সৌন্দর্য―সত্য ও সদ্গুণের সঙ্গে বহুমাত্রিকভাবে সম্পর্কিত এবং এই মৌলিক মূলনীতি সৌন্দর্যকে একটি অস্তিত্বগত মাত্রা দেয়।
আবার সমুদয় সৌন্দর্যেরই সৃষ্টিজগতের সৌন্দর্যের সঙ্গে অভেদ্য যোগসূত্র বিদ্যমান। মৌমাছি ও আকাশনিচয়ের সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে প্রকাশিত হয় দৃশ্যমান রূপের আড়ালে নিহিত নিগূঢ় রহস্য। শিল্প আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও সৌন্দর্যবোধকে বিকশিত করার মধ্য দিয়ে আমাদের ভেতরে এবং মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত রহস্য অনুধাবনে সক্ষম করে তোলে। সর্বোত্তম শিল্পী হিসেবে আল্লাহ তায়ালা সবকিছু সুন্দরতমভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি চান আমরা তাঁর (সৌন্দর্যনীতি) অনুসরণ করি। সেদিক থেকে, সুচারু ও সুন্দরভাবে―তা যে কাজই হোক না কেন―সম্পাদন করা, আমাদের পরমের নৈকট্যেই অগ্রসর করে। তাই, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, সুন্দর ও সত্য অবিচ্ছেদ্য। সুন্দর আবির্ভূত হয় বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যতা, নৈতিক ন্যায্যতা এবং রুচিগত সৌকর্যের বৃহত্তর মোহনায়।
গ্রানাডার আল-হামরা প্রাসাদের প্রশান্ত সৌন্দর্য, ইস্তাম্বুলের সুলতান আহমেত মসজিদের রাজসিক গাম্ভীর্য, আগ্রার দর্শনীয় তাজমহল এবং জেরুজালেমের ডোম অব দ্য রকের দেদীপ্যমান উপস্থিতি―কী নির্দেশ করে! আবার, রুমি-হাফিজ-খৈয়ামের অমর কবিতামালা, মাত্রাকচি নাসুহ, লেভনির বিস্ময়কর অনুচিত্রসমূহ এবং কুরআনিক ক্যালিগ্রাফির প্রদীপ্ত সৌন্দর্য! কিংবা সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে বিরাজিত আলোকসাজ, বস্ত্রবুননে মধ্য এশিয়ার যাযাবর সম্প্রদায়ের সহজ কিন্তু সুগভীর কারুকাজ এবং আরবি, ফার্সি, তুর্কি ও ভারতীয় সংগীতের উৎকৃষ্ট অবদানসমূহ!
তারা যে সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আবির্ভূত এবং উত্থিতি লাভ করেছে, তা থেকে তাদের আলাদা করা যায় না। সেই প্রতিবেশ ও পরিমণ্ডল―গড়ে উঠেছিল মানবসভ্যতার এক বিশেষ ভাবাদর্শের ওপর, যা ছিল ঐশী সত্য ও সৌন্দর্য থেকে উৎসারিত নীতিসূত্রে লালিত।
অথচ সৌন্দর্যকে আজ বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। পরিণত করা হয়েছে বাজারি পণ্যে। প্রোপাগান্ডা করা হচ্ছে যে, সৌন্দর্য মানে ব্যয়বহুল বিলাসিতা এবং তা পুঁজিপতি শ্রেণির একচেটিয়া সম্পত্তি। এই প্রোপাগান্ডা আধুনিক সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুতর ধোঁকাবাজিগুলোর অন্যতম।
সৌন্দর্য কোনো বিশেষ শ্রেণির একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। এটি বিলাসিতা নয়, নয় বাহুল্য কিংবা অবহেলার বিষয়। বরং এটি মানবপ্রকৃতির একটি অপরিহার্য অংশ, যা আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়কে পরিশীলন করে। আমাদের মাঝে বিরাজিত আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অতিক্রম করে বিস্ময়, বিশ্রাম ও আনন্দের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। যথাযথ প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করতে চাইলে আমরা দেখব, সৌন্দর্য এমন একধরনের পরিমিতিবোধ ও প্রেমময় অনুভূতিকে পুষ্টি দেয়, যা আমাদের জীবনের যন্ত্রণা যাপনে সাহায্য করে।
এটি―আমরা যা, তার চেয়ে মহত্তর কিছুর সঙ্গে আমাদের যুক্ত করে। দীক্ষিত করে নম্রতা ও কৃতজ্ঞতায়। এটি আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের পরিমার্জন এবং আবেগসমূহের সুশৃঙ্খল সংহতি সাধন করে। এর কমনীয়তা আমাদের চিন্তা ও আচরণকে গভীর অর্থময়তায় বাঙ্ময় করে। গণিত এবং মানতিকের মৌলিক প্রস্তাবনাগুলো শুধু সত্যই নয়, মার্জিত এবং সুন্দরও। কোয়ান্টাম কণা থেকে প্রাণের বিন্যাস, কিংবা বিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল এবং সূক্ষ্মতম প্রপঞ্চসমূহ―সরলতা, সৌন্দর্য ও কমনীয়তার উপাদানে উদ্ভাসিত।
সৌন্দর্য সবকিছুকেই ভেদ করে। কোনো স্বাভাবিক আত্মাই সৌন্দর্যের আবেদনে উদাসীন থাকতে পারে না। সৌন্দর্য উপলব্ধি, অনুধ্যান ও উপভোগের জন্য তাই আত্মারও পরিশুদ্ধি এবং সৌন্দর্যায়ন প্রয়োজন। এর ফলাফল শুধু একটি মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি বা ভাবাবেগজনিত ভাববাদ নয়, বরং সেই সচেতনতা, যা পৃথিবী ও মানবজাতির অন্য সদস্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্মাণ করে, যা নানাভাবে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের প্রভাবিত করে। তাই ইসলামের ইতিহাসের সুন্দরতম নগরগুলো যেমন সর্বোচ্চ বিশ্বজনীন ছিল, তেমনি ছিল বহুত্ববাদী। সেইসঙ্গে সবচেয়ে সৃজনশীল ও নবায়নযোগ্যও। আমাদের চারপাশে ক্রমবর্ধমান কদর্যতার সমারোহে আমাদের এই সৌন্দর্যানুভূতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। মন্দ রুচি, স্থূলতা ও গড্ডলিকা কখনোই প্রকৃত সৌন্দর্য এবং নান্দনিক উপলব্ধির বিকল্প হতে পারে না।
ধর্মের নামে শিল্প ও নান্দনিকতাকে ভ্রুকুটি করার প্রবণতা সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বের ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করেছে। কিছু চরমপন্থি দল তো তাকওয়া ও পবিত্রতার নামে একে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ আর কিছুই হতে পারে না। কাবার সুগভীর সারল্য এবং সীমাহীন সৌন্দর্যই এর জীবন্ত দৃষ্টান্ত। ইসলামের নবীর শহর মদিনার প্রশান্ত মহিমাও সেটাই নির্দেশ করে।
মুসলিম বিশ্বের মারমুখো চরমপন্থিরা পাশ্চাত্যের আধুনিক যুদ্ধংদেহিতারই পুনরাবৃত্তি করছে―একইসঙ্গে চাচ্ছে ধর্মের দোহাই দিয়ে বর্বরতার ন্যায্যতা দিতে। দায়েশের (ISIS) কথাই ধরা যাক, এই মতাদর্শটি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভ্রান্ত, নৈতিকভাবে কলুষিত এবং সৌন্দর্যের দিক থেকে কুৎসিত। এগুলোর সর্বোত্তম প্রতিষেধক হলো, ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে গভীরতা, ন্যায্যতা ও সৌন্দর্য-সহকারে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা। এটাই এখন সমগ্র উম্মাহর দায়িত্ব। আল্লাহ সুন্দর, তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন। সুন্দর হওয়ার সাধনার ভেতর দিয়ে আমরা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে চাই। কোনো কুৎসিত চরমপন্থা এবং বাণিজ্যবাদ আমাদের এই মহত্তম ও সুন্দরতম মাকসাদ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।
মূল : ইব্রাহিম কালিন
বাংলা : শাহাদাত মাহমুদ সিদ্দিকী