জুলাই বিপ্লবের অগ্রসেনানী ও ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শরীফ ওসমান হাদি আর নেই। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৩০ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। হাদির চিকিৎসা দেখাশোনার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৩২ বছর। ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজেও মৃত্যুর খবর প্রচার করা হয়েছে। তার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ পুরো বাংলাদেশ।
গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হাদি। রাজধানীর পল্টনের কালভার্ট রোড এলাকায় ঘাতকরা তাকে গুলি করে। মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে নেওয়া হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। গত সোমবার দুপুরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার দ্রুত এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। এ সময় হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার পরিবারের সম্মতি নিয়ে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে তার মস্তিষ্ক থেকে গুলি বের করার জন্য অস্ত্রোপচার করেন। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। হাদি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ রাজনৈতিক দলের নেতারা তার এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে ওসমান হাদিকে দেখে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণান বুধবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে তার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে অবহিত করেন। ফোনালাপে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন।’
ইনকিলাব মঞ্চের আরেক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, হাদি যদি রবের ডাকে সাড়া দিয়ে শহীদের কাতারে শামিল হন সেক্ষেত্রে পুরো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মজলুম জনতাকে সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণে শাহবাগে জড়ো হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আমরা শাহবাগে অবস্থান করব এবং পুরো বাংলাদেশকে অচল করে দেওয়া হবে। খুনি যদি ভারতে পালিয়ে যায় সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যেকোনো মূল্যে তাকে গ্রেপ্তার করে ফেরত আনারও অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ওসমান হাদির সঙ্গে তার দুই ভাই রয়েছেন। তার পরিবারের আরেক সদস্য বৃহস্পতিবার রাতেই সিঙ্গাপুর রওনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
জুলাই বিপ্লবের অগ্রনায়ক শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করা ফয়সাল করিম মাসুদ ভারতে পালিয়েছে বলে দেশের গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সন্দেহভাজন অভিযুক্তরা ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশটিতে পালিয়ে যায়। এটি পরিকল্পনারই অংশ ছিল বলে জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কয়েকটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ১২ ডিসেম্বর হাদির ওপর হামলার পর মোটরসাইকেল লুকিয়ে রেখে দ্রুত ঢাকা ছাড়ে সন্দেহভাজন ফয়সাল ও চালক আলমগীর শেখ। তারা একটি প্রাইভেটকারে করে প্রথমে ময়মনসিংহে যায়। সেখানে আবার গাড়ি পরিবর্তন করে আরেকটি মোটরসাইকেলে করে যায় সীমান্তে। এরপর শূন্যরেখা পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় দুজন। তারা দালালের মাধ্যমে সীমান্ত অতিক্রম করে। তবে তারা পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যদের চোখ কীভাবে ফাঁকি দিতে পারল তা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। এতে আর কোনো পক্ষ তথা দেশীয় কোনো অপশক্তির যোগসাজশ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
র্যাবের একটি সূত্র জানায়, দেশে যেকোনো স্থানে থাকলে তারা গ্রেপ্তার হতে পারে এই ভয়ে ভারতে পালিয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোন না থাকায় কোনো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করা যায়নি।
বুধবার ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবীর ও মা হাসি বেগমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাদের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় ডিবি ফয়সালের বাবার মোবাইল ফোনের কল লিস্ট খতিয়ে দেখে। ফয়সালের বাবার মোবাইল ফোন নম্বরে বিদেশি একটি নম্বর থেকে কল এসেছিল। ওই কলটি ভারত থেকে ফয়সাল করেছিল বলে ডিবিকে জানিয়েছে তার বাবা হুমায়ুন।
ফয়সালকে সীমান্ত পারে সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার দুজনের বৃহস্পতিবার তিনদিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার আমার দেশকে বলেন, ‘হাদির ঘটনায় কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। আমরা ক্লু উদঘাটনের চেষ্টা করছি।’
ফয়সাল করিমকে সীমান্তপারে সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার দুজন রিমান্ডে
হাদি হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদকে অবৈধ পথে ভারতে পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগে গ্রেপ্তার দুজনকে তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। তারা হলো উপজাতি সিবিয়ন দিউ ও সঞ্জয় চিসিম। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশীতা ইসলামের আদালত বৃহস্পতিবার তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল জোনাল টিমের পরিদর্শক ফয়সাল আহম্মেদ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে রিমান্ডের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। শুনানি শেষে বিচারক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী জানিয়েছেন।
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার। হাদির মৃত্যুতে জাতীর উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। বৃহস্পতিবার রাতে জাতীর উদ্দেশে তিনি ভাষণ দেন।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ওসমান হাদির মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব নেবে সরকার। বৃহস্পতিবার রাতে জাতীর উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন।
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে বিএনপির শোক
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বার্তায় এ শোক প্রকাশ করা হয়।
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে জামায়াতে ইসলামীর শোক
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির শাহাদাত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। বৃহস্পতিবার রাতে ওসমান হাদির মৃত্যুর পর নিজের ফেসবুক পোস্টে এ কথা বলেন জামায়াত আমির।
শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে তারেক রহমানের শোক
ইনকিবাল মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বৃহস্পতিবার রাতে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পোষ্টে তারেক রহমান লেখেন, আমি শরীফ ওসমান হাদির মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে শোকাহত। আল্লাহ যেন তার রুহের মাগফিরাত করেন। তার এই অকাল শহীদি মৃত্যু আবারও মনে করিয়ে দিল- রাজনৈতিক সহিংসতা কত বড় মানবিক মূল্য দাবি করে।