হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে গত ১৮ অক্টোবর সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল লিথিয়াম ব্যাটারি বিস্ফোরিত হয়ে অথবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে।
এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য আমদানি কমপ্লেক্সের কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনাকারীদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি) দায় খুঁজে পেয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) গঠিত তদন্ত কমিটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানাচ্ছে, তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী আইএইএবি-র শাস্তিসহ ভবিষ্যতে ঝুঁকি এড়াতে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে দ্রুতই প্রতিবেদন জমা দেবে।
এর আগে গত ৩ নভেম্বর জমা দেওয়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের দুটি সম্ভাব্য কারণের কথা উল্লেখ করেছে। এর একটি হচ্ছে তাপ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় রাখা লিথিয়াম ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে অথবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। তবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা—এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেনি এয়ারলাইন্সের তদন্ত কমিটি। গত ৩ নভেম্বর তারা বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।
বেবিচক গঠিত তদন্ত কমিটির সূত্রে জানা গেছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে বেবিচকের তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। যে কারণে কমিটির প্রতিবেদনে এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য বেবিচকের ভাড়াটিয়া কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএইএবি)-কে দায়ী করতে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হচ্ছে। সরকার চাইলে আইএইএবি’র বিরুদ্ধে মামলা বা জরিমানা করতে পারে—এমন কথাও উল্লেখ থাকছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরের ভেতর অগ্নিঝুঁকি এড়াতে কমিটির সুপারিশে বিমানবন্দরের ভেতরে থাকা কার্গো গোডাউন অন্যত্র সরিয়ে নিতে পরামর্শ দেওয়ার কথা ভাবছে। বিমানবন্দরের সামনে যে জায়গা আছে, সেখানে কার্গো গুদাম করার কথাও থাকতে পারে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া আরও কিছু সুপারিশ করা হচ্ছে প্রতিবেদনে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বেবিচক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শিগগিরই তদন্ত কমিটি বেবিচকের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।
অগ্নিকাণ্ডের ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তদন্ত কমিটি দেখেছে, দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে টিনের ছাউনিওয়ালা পশ্চিম শেড থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। এই অংশটি তখন কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান ডিএইচএল-এর লিজে ছিল। দুপুর ২টা ১৯ মিনিটে আগুনের শিখা দেখা দেয় এবং বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ ঘটে। ২ মিনিটের মধ্যেই পুরো ঘর আগুনের ধোঁয়ায় ভরে যায়। দুপুর ২টা ১৯ মিনিটে কন্ট্রোল টাওয়ার বিমানবন্দরের রেসকিউ ও ফায়ার ইউনিটকে ফোন দেয়। প্রথম বিমানবন্দর ফায়ার ট্রাক আসে ২টা ২৩ মিনিটে। তখন পুরো ঘর আগুনে ছেয়ে যায়। আরও দুটি ফায়ারের গাড়ি আসে ২টা ২৫ ও ২৬ মিনিটে। প্রতিটি ফায়ারের অগ্নি নির্বাপণী গাড়িতে ছিল ৯ হাজার ৫০০, ১২ হাজার ৫০০ লিটার পানি এবং ১ হাজার ২০০ এবং ১ হাজার ৫০০ লিটার ফোম।
বিমানবন্দরের এক নিরাপত্তা কর্মী ৯৯৯-এ ফোন করেন ২টা ২৫ মিনিটে। এরপর উত্তরা ফায়ার স্টেশন খবর পায়। তাদের প্রথম ফায়ারের গাড়ি পৌঁছায় ২টা ৫০ মিনিটে। তখন পুরো শেড আগুনে ভরে যায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একাধিক ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বেবিচকের তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, আগুন নেভানো বা নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না। কুরিয়ার ভবন যারা লিজ নিয়েছে, অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের ভূমিকা যথার্থ ছিল না।
তবে কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএইএবি)-এর কর্মকর্তাদের দাবি, ২০১৩ সালের পর তারা বেবিচকের কাছ থেকে কার্গো গুদাম লিজ নেয়, কিন্তু ২ বছর আগে বেবিচক এটার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। এখন জায়গার মালিক বেবিচক, বিমান মালামাল হ্যান্ডলিং করে, তারা শুধু ক্যারিয়ার। ওখানে যিনি ভাড়া দিয়েছেন তিনিই তো ইলেকট্রিক লাইন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না, তা মনিটর করবে। ফলে এটার দায়িত্ব বেবিচকের।
অন্যদিকে, বিমানের পৃথক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে লিজ চুক্তিতে প্রতিটি পণ্যের অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্ব স্পষ্টভাবে উল্লেখ এবং সব গুদাম, কার্গো শেড ও সার্ভিস ভবনে স্বয়ংক্রিয় অগ্নি শনাক্তকরণ ও নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে—টিনের কাঠামো ভাঙা ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের উৎসস্থলে ঢোকা সম্ভব হচ্ছিল না। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে ভাঙার যন্ত্র নেই। যে কারণে ফায়ার সার্ভিস বুলডোজার আনার পর আগুনের উৎসে পৌঁছানো যায়। বিকাল ৩টা ২১ মিনিটে সেনাবাহিনী আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। মোট ৩৭টি ইউনিট কাজ করে। এ ছাড়া কার্গো কমপ্লেক্সের কাছে পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্র্যান্ট ছিল না। এমন প্রেক্ষাপটে পানি আনতে হয় দূরের জায়গা থেকে। ঘটনার সময় কুরিয়ার ভবনে কেউ ছিলেন না।