আন্তর্জাতিক সিডও দিবস আজ
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা পোশাক কর্মী হাফেজা (২৭)। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার কারণে রিকশা চালক স্বামী বাসা থেকে বের করে দেয়। থানায় গেলে পুলিশ বলে,‘এটি পারিবারিক ব্যাপার, আপস করো।’ অসহায় হাফেজা দুঃখ ভরা কণ্ঠে বলেন, দেশে আইন আছে ঠিকই, কিন্তু আমাগো মতো গরীব মানুষের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া অনেক দূরের ব্যাপার।
রাজশাহীর নায়লা (১৫) বলেন, পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে আমি বাল্য বিয়ের স্বীকার হই। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে স্বামীর মারধরের শিকার হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসি। পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকলেও অর্থাভাবে সুযোগ পাইনি।
এদিকে, নারীরা কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও কটূক্তির মুখে পড়ছেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, ‘ক্লাসে ভালো করলে অনেকে বলে, স্যারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয়েছে। তখন বুঝি, মেধা দিয়েও নিজেকে প্রমাণ করা কঠিন। হাফেজা, নায়লার মতো এখনো আমাদের দেশে সমাজের নারীর অহরহই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
এমনই বাস্তবতায় আজ ৩ সেপ্টেম্বর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক সিডও দিবস পালিত হবে। বেসরকারি সংগঠনগুলো বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি পালন করবে। জাতিসংঘের যে সাতটি সনদকে মৌলিক মানবাধিকার চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়,‘শুধু নারীসংক্রান্ত’ এই সিডও সনদ তার মধ্যে একটি। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সনদটি কার্যকর হতে শুরু করে। এরপর থেকেই এই সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ আন্তর্জাতিক সিডও দিবস হিসেবে পালন করে।
বাংলাদেশ এই সনদ অনুমোদন করে ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর। অনুমোদনকালে বাংলাদেশ সরকার ২, ১৩ (ক) এবং ১৬.১ (গ) ও (চ) ধারাগুলো আপত্তিসহ স্বাক্ষর করে। পরে জাতীয় পর্যায়ে গঠিত রিভিউ কমিটির সুপারিশ ক্রমে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ১৩ (ক) ও ১৬.১ (চ) ধারা থেকে বাংলাদেশ তার আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয়। তবে ধারা ২ এবং ১৬.১ (গ) থেকে আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয়ার বিষয়টি সরকার এখনও প্রক্রিয়াধীন। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপের জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং বৈষম্যমূলক আইন থাকলে তা বাতিল করতে বলা হয়েছে।
সরকার সনদের ২ নম্বর ধারায় সংরক্ষণ বলবৎ রেখেছে। এই ধারায় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং প্রয়োজনে আইন বা বিধিবিধানের পরিবর্তন, পরিবর্ধন অথবা বাতিল করবে। সরকার সনদের ১৬.১(গ) ধারাটির ব্যাপারেও সংরক্ষণ বলবৎ রেখেছে। এ ধারায় বিবাহ করা ও বিবাহবিচ্ছেদের সময় নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
সহিংসতার ভয়াবহ চিত্র
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৯৩৭ জন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫২৫ জনে। এর মধ্যে ৪৮১টি ধর্ষণ, ১০৬টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ১৭টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই (জানুয়ারি থেকে জুলাই) এক হাজার ৭৯০ নারী ও কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এর মধ্যে ৪০৫টি ধর্ষণ, ১১৭টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ১৮টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটেছে ৩২২ নারীর।
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য
শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, পুরুষের শ্রমশক্তি অংশগ্রহণ ৮১ শতাংশ, নারীর মাত্র ৪২ শতাংশ। একই কাজে নারীরা গড়ে পুরুষের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম মজুরি পান। গার্মেন্টসে প্রায় ৮০ লাখ নারী কাজ করেন। নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি ১০ শতাংশেরও কম।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি আমাদের সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, এর মূলে লুকিয়ে আছে নারীর প্রতি অপমান, অসহিষ্ণুতা, অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত রাখার মানসিকতা। আইনের ব্যবস্থাটাকে আরও নারীর প্রতি সংবেদনশীল করে তোলা জরুরি। কারণ, নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও আইন সেভাবে আমাদের সহায়তা করছে না। একটা মেয়ে বিচার চাইতে গেলে আদালতে ওই নারীকে বিচারক অপমানজনক মন্তব্য করছেন। অনেক নারী সম্পদের অধিকার থেকেও বঞ্চিত, এটিও মাথায় রাখতে হবে। এটিও এক ধরনের নির্যাতন, যেটিকে আমরা বলি ‘অর্থনৈতিক নির্যাতন’। এই বিষয়গুলো সার্বিকভাবে দেশের নারী-শিশুদের মধ্যেও একটি মানসিক প্রভাব রাখে যে, তাদের যোগ্যতা কম, তাদের ক্ষমতা কম। পুরুষই তাদের সবকিছুর নির্ধারক–পুরুষের ইচ্ছাতেই তাদের ভাগ্য, পেশা, কাজ নির্ধারিত হবে। এসব প্রতিনিয়ত হচ্ছে, আর তা পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের নারীর সমতা প্রতিষ্ঠিত করাটা এখন সময়ের দাবি।’
সমাধানের পথ
সিডওতে রাখা সংরক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে; দ্রুত অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন জরুরি; যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন ও বৈষম্য বিরোধী আইন করতে হবে; নারীর জন্য সমান মজুরি ও নেতৃত্বের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ বিনিয়োগ দরকার; সবচেয়ে জরুরি হলো মানসিকতার পরিবর্তন। নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নয়, পূর্ণ মর্যাদার নাগরিক হিসেবে দেখতে হবে।