তিন দফা দাবি আদায়ে বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ করে আন্দোলনে অনড় অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারিও আমলে নেননি তারা। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচিতে বার্ষিক পরীক্ষার শিডিউল বিপর্যয়ে চরম অনিশ্চয়তা, মানসিক চাপ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। নিজেদের স্বার্থে চাকরি বিধি লঙ্ঘন ও শিশু শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে শিক্ষকদের এ আন্দোলন দাবি আদায়ের নগ্ননজির স্থাপন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটছে। উদ্ভূত সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি।
সরকারের সতর্কবার্তার পর অনেক স্কুলের সহকারি শিক্ষক আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে কর্মে যোগ দিয়েছেন। তারা বলছেন, এই আন্দোলনের পেছনে পতিত স্বৈরাচারের ইন্ধনে রয়েছে; ফলে অনড় থেকে সরকারকে বেকায়দা ফেলতে চায় শিক্ষকরা।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক আমার দেশকে বলেন, বিগত স্বৈরাচারের আমলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের অধিকাংশই আওয়ামী চেতনার। ফলে দাবি আদায়ের চেয়েও এখন তাদের কাছে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য বেশি বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার পিরোজপুরের নেছারাবাদে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে দুই দফায় মারামারির ঘটনা ঘটেছে। বার্ষিক পরীক্ষা না নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা পরিষদের গেটের সামনে শিক্ষকেরা আন্দোলন করতে গেলে বিক্ষুব্ধ অভিভাবকরা তাদের পিটিয়েছেন।
জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গতকাল ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এতে বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। তবে নারায়ণগঞ্জ, পটুয়াখালী, চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু জেলায় কোনো কোনো স্কুলে প্রধান শিক্ষক ও প্রশাসনের সহায়তায় পরীক্ষা নেয়ার খবর পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের লক্ষণখোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সাবেরা বেগম আমার দেশকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের আন্দোলনের সঙ্গে আমি নেই। আমরা স্কুলে যথারীতি পরীক্ষা নিচ্ছি। আমাকে না জানিয়েই তারা ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ আহ্বায়ক হিসেবে আমার নাম ব্যবহার করেছে। এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। এজন্য তারা আমাকে ‘ঘসেটি বেগম’ বলে গালিগালাজ করেছে।’
এই শিক্ষক আরো বলেন, ‘আমার মতো অনেক শিক্ষক, আন্দোলন থেকে সরে গেছেন। নারায়ণগঞ্জের ৫ উপজেলার সব কটিতেই পরীক্ষা হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামের বেশিরভাগ জেলাসহ দেশের অধিকাংশ স্কুলে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে বলে, তিনি দাবি করেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ আহ্বায়ক শাহীনুর আল আমিন বলেন, ‘আমাদের কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে; কর্মসূচি থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। সরকারের নির্দেশনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি; হুমকিতেও উদ্বিগ্ন নই। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। শিক্ষিকা সাবেরা বেগমের বক্তব্যের বিষয়ে বলেন, তিনি এ ধরনের কর্মসূচির একমত নয় বলে এমন বলছেন। তবে আহবায়ক খায়রুন নাহার লিপিসহ অধিকাংশ নেতা গতকাল ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বুধবার বিকালে জরুরি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষকদের অবিলম্বে কর্মে ফেরার নির্দেশনা দেয়। একই সঙ্গে কর্মবিরতি বা শাটডাউন অব্যাহত থাকলে সরকারি চাকরি আইন, আচরণবিধি ও ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কড়া সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়। তবে সেটা আমলে নেয়নি আন্দোলনকারীরা। শিক্ষক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বাস্তবে দাবি পূরণে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। মন্ত্রণালয় ছলচাতুরিপনার মাধ্যমে এ আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কোথাও বলপ্রয়োগের চেষ্টা করছে।
এদিকে, তিন দফা দাবি আদায়ে সহকারী শিক্ষকরা কর্মবিরতি ও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে সারাদেশে প্রাথমিক শিক্ষায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অসংখ্য বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে, ফলে বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে।
শিক্ষকরা নিজ নিজ উপজেলা বা থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার (এটিইও) কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন। তবে ঢাকাসহ কিছু বিভাগীয় শহরে সীমিত আকারে পরীক্ষা নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সহকারী শিক্ষকরা লাগাতার কর্মবিরতি পালন করলেও যশোরে এ কর্মসূচির কোনো প্রভাব নেই। মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামীমা খাতুন বলেন, কর্মসূচি পালনে কোন চাপ নেই, শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক দায়িত্ব পালন করছেন।
যশোর ইনস্টিটিউট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দা শিরিন সুলতানা বলেন, এখানে কোনো শিক্ষক কর্মবিরতি পালন করছেন না। তাই অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে না। ১০ ডিসেম্বরের মধ্যই বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করবো।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সরকারি বিদ্যালয় গেটের তালা ভেঙে প্রবেশ করে পরীক্ষা নিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
বৃহস্পতিবার সকালে দশম গ্রেডসহ তিন দফা দাবিতে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকারি মঙ্গলসুখ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান গেট তালাবদ্ধ করে বার্ষিক পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখেন শিক্ষকরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তালা ভেঙে বিদ্যালয়ে ঢোকেন ইউএনও কাউসার হামিদ। পরে সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় বিদ্যালয়টিতে। এ বিদ্যালয়ে চলতি বছরে ৭০২ জন শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্রে জানা যায়, দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত তিন লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষকের বেশির ভাগই সহকারী শিক্ষক। প্রধান শিক্ষকরা দশম গ্রেডে উন্নীত হলেও সহকারী শিক্ষকরা এখনও ১৩তম গ্রেডে রয়েছেন, যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
দাবি আদায় আন্দোলনের সমন্বয়ক ও আহ্বায়কদের কয়েকজনকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার শোকজ নোটিশ দেওয়ায় ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তবে অভিভাবকরা বলছেন, হঠাৎ পরীক্ষা বন্ধ হওয়ায় শিশুরা মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। তাদের শিক্ষা জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে দেশের শিক্ষাকাঠামোর সবচেয়ে বড়, এই স্তর সংকটে পড়েছে। এতে ক্ষুব্ধ অনেক অভিভাবক। তারা বলছেন, বার্ষিক পরীক্ষার সময় এমন আন্দোলন ঠিক হয়নি। ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক-অভিভাবক মারামারি
শিক্ষক আদনান হোসেন বলেন, সারা দেশে সহকারী শিক্ষকদের শাটডাউন কর্মসূচি চলছে। কিন্তু নেছারাবাদে সহকারী শিক্ষক ছাড়াই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছিল। আমরা কোনো বাধা দিইনি। তারপরও উপজেলার কোথাও কোথাও কয়েকজন ব্যক্তি শিক্ষকদের হুমকি দিচ্ছিল। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আমরা উপজেলা পরিষদে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিলাম। এমন সময় রুহুল আমীন নামের একজন এসে গালিগালাজ করেন। প্রতিবাদ করতেই তিনি আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালান।
আন্দোলনের কারণে নেছারাবাদের সহকারী শিক্ষকেরা পরীক্ষা নিচ্ছেন না। ২ ডিসেম্বর থেকে উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা শুরু হলেও সহকারী শিক্ষক না থাকায় প্রধান শিক্ষকেরা একাই পরীক্ষা পরিচালনা করছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে ১৬৯টি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক একযোগে উপজেলা চত্বরে জড়ো হলে কয়েকজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সময় অভিভাবক রুহুল আমীন ও শিক্ষক আদনান হোসেনের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা থেকে হাতাহাতি হয়।
অভিভাবক মো. রুহুল আমীন বলেন, পরীক্ষার সময় স্কুল ফেলে শিক্ষকেরা উপজেলা চত্বরে আসেন। বিষয়টি জানতে চাইতেই শিক্ষক আদনান হোসেন আমার ওপর চড়াও হয়ে হামলা চালান।
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের নেতা আনোয়ার উল্যাহ বলেন, ‘আমরা ২২ দিন অপেক্ষা করেছি। কোনো বাস্তব অগ্রগতি না দেখেই বাধ্য হয়ে শাটডাউনে যেতে হয়েছে।’
ময়মনসিংহের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষকরা। বার্ষিক পরীক্ষা দিতে এসে শ্রেণিকক্ষে তালা দেখে চরম দুর্ভোগে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। নান্দাইলের বিদ্যালয়গুলোতে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হতে দেখা গেলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে হয়নি।
লাগাতার কর্মবিরতি, বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনের পর বরগুনার আমতলী উপজেলার ১৫২টি বিদ্যালয়ে কমপ্লিট শাটডাউন পালিত হচ্ছে। কোনো বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। বৃহস্পতিবারও একই অবস্থা বিরাজ দেশের অধিকাংশ স্কুলে। তবে কোনো কোনো স্কুলে প্রধান শিক্ষক, নৈশপ্রহরী ও অভিভাবকদের সহযোগিতায় সব স্কুলে পরীক্ষা হয়েছে।