‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর মাই কান্ট্রি’—জনসমুদ্রে ঘোষণা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের
ইতিহাস সৃষ্টি করে দেশে ফিরলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ১৭ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বদেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরেই তিনি খোলা পায়ে নিজ দেশের মাটির স্নিগ্ধ পরশ অনুভব করেন। আপ্লুত তারেক রহমান মাতৃভূমির একমুঠো মাটিও হাতে তুলে নেন। ১৭ বছর পর জনতার মঞ্চে উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হলেন খালেদা জিয়া ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই উত্তরসূরি। জনতার মহাসমুদ্র তাকে বরণ করে নেয়। ঢাকায় নেমেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে নিরাপত্তাসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি যান ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ের গণসংবর্ধনাস্থলে। সেখানে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন তার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান।’ আর সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দেশের প্রতিটি মানুষের সহযোগিতা কামনা করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সবশেষে যেকোনো মূল্যে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানান তিনি। সংবর্ধনা শেষে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মায়ের কাছে যান।
জুলাই বিপ্লবের মুখে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের পতন ও স্বৈরাচার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর বাংলাদেশে নতুন করে গণতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সর্বমহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ। নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় অবতরণ করেন তারেক রহমান। এর আগে বাংলাদেশ বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইটটি প্রথমে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে যাত্রাবিরতি শেষে ঢাকায় পৌঁছায়। সফরসঙ্গী হিসেবে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও মেয়ে জাইমা রহমানও ছিলেন। বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে নেমেই দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হন তিনি।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভিআইপি গেট দিয়ে বের হয়ে বিমানবন্দরের গেটের সামনের বাগানে জুতা-মোজা খুলে খালি পায়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় তিনি একমুঠো মাটি হাতে তুলে নেন। সেখানে এক আবেগঘন মুহূর্তের সৃষ্টি হয়। এরপর তিনি পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ের (৩০০ ফুট সড়ক) সংবর্ধনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হন। এ সময় তাকে বহনকারী ‘সবার আগে বাংলাদেশ’-খচিত লাল-সবুজ রঙের বাসের সামনে থেকে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের অভ্যর্থনা গ্রহণ করেন বিএনপির এই শীর্ষ নেতা।
যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ১৫ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগে, সেখানে দলের নেতাকর্মী ও উৎসুক লাখ লাখ মানুষের ভিড় ঠেলে বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থলে পৌঁছাতে তারেক রহমানের গাড়িবহরের পৌনে চার ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। সমাবেশ মঞ্চের কাছাকাছি যেতেই নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে পারেনি বাস। পরে বাস থেকে নেমে হেঁটেই মঞ্চে ওঠেন তারেক রহমান। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। পরে সভামঞ্চের তিনদিক ঘুরে হাত নাড়িয়ে উপস্থিত জনসমুদ্রের অভিবাদন গ্রহণ করেন। এ সময় মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ৩০০ ফিট এলাকা।
পরে দেশবাসীর উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন তারেক রহমান। বক্তব্যে দেশের মাটিতে ফিরতে পারার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। তিনি বলেন, রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমতে আজ আমি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পেরেছি; আপনাদের দোয়ায়, আপনাদের মাঝে। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল। ঠিক একই ভাবে ১৯৭৫-এ আবার ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদের হাত থেকে সুরক্ষা করা হয়েছিল। একই ভাবে পরবর্তীতে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণ এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু তারপরও ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আমরা দেখেছি ১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, ২০২৪ সালে এ দেশের ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, গৃহবধূ, নারী-পুরুষ মাদরাসার ছাত্রসহ দলমত, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল।
বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায় উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের সময় এসেছে সবাই মিলে দেশ গড়ার। এ দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছে, একই ভাবে সমতলের মানুষ আছে। এ দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। আমরা চাই সবাই মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন। অর্থাৎ আমরা একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, যে বাংলাদেশে একজন নারী, পুরুষ, শিশু- যেই হোক না কেন, নিরাপদে ঘর থেকে বের হয়ে ইনশাল্লাহ নিরাপদে আবার ঘরে ফিরে আসতে পারে।
তারেক রহমান বলেন, এ দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, চার কোটিরও বেশি তরুণ প্রজন্মের সদস্য, পাঁচ কোটির মতো শিশু, ৪০ লাখের মতো প্রতিবন্ধী রয়েছে, কয়েক কোটি কৃষক-শ্রমিক রয়েছে। এ মানুষগুলোর একটি প্রত্যাশা আছে এ রাষ্ট্রের কাছে, দেশের কাছে। আজ আমরা সবাই যদি ঐক্যবদ্ধ হই, সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, তাহলে আমরা এ লক্ষ-কোটি মানুষের সে প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারি ইনশাল্লাহ। একাত্তর সালে আমাদের শহীদরা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এরকম একটি বাংলাদেশ গঠনের জন্য।
আওয়ামী গুম-খুন ও নিপীড়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, বিগত ১৫ বছর স্বৈরাচারের সময় হাজারো মানুষ গুম-খুনের শিকার হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, নিরীহ মানুষও প্রতিবাদ করতে গিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, জীবন দিয়েছে। ২০২৪ সাল- মাত্র সেদিনের ঘটনা। আমরা দেখেছি আমাদের তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা কীভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষার জন্য।
শহীদ শরীফ ওসমান হাদিকে স্মরণ করে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘কয়েকদিন আগে এই বাংলাদেশে চব্বিশের আন্দোলনের, এই প্রজন্মের এক সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। হাদি শহীদ হয়েছে। হাদি চেয়েছিল এ দেশের মানুষের জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক; মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে পাক। আজ চব্বিশের আন্দোলনে ওসমান হাদিসসহ যারা শহীদ হয়েছেন, ১৯৭১-এ যারা শহীদ হয়েছেন, বিগত স্বৈরাচারের সময় বিভিন্নভাবে খুন-গুমের শিকার হয়েছেন, এ মানুষগুলোর রক্তের ঋণ যদি শোধ করতে হয়- আসুন আমরা আমাদের সেই প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যেখানে আমরা সবাই মিলে কাজ করব; আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলব।’
আধিপত্যবাদী শক্তির গুপ্তচররা এখনো বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত উল্লেখ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সদস্য যারা আছেন। আপনারাই আগামী দিনে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, দেশকে গড়ে তুলবেন। এ দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের সদস্যদের আজ গ্রহণ করতে হবে, যাতে এ দেশকে আমরা সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। শক্ত ভিত্তির ওপর, গণতান্ত্রিক ভিত্তি, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর যাতে এ দেশকে আমরা গড়ে তুলতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে আজ মঞ্চে এখানে জাতীয় অনেক নেতা বসে আছেন। আসুন আজ আমরা দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করি- আল্লাহর রহমত চাই। যেসব জাতীয় নেতা এ মঞ্চে আছেন, মঞ্চের বাইরে যেসব জাতীয় নেতৃত্ব আছেন; আমরা সবাই মিলে এ দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের জনগণের প্রত্যাশিত সে বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলতে চাই। যেকোনো মূল্যে আমাদের এ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে, যেকোনো উসকানির মুখে আমাদের ধীর-শান্ত থাকতে হবে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমরা দেশে শান্তি চাই।’ বিষয়টি তিনবার উচ্চারণ করেন তিনি।
মার্টিন লুথার কিংয়ের বিখ্যাত ডায়লগ আছে ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’-এর প্রসঙ্গ তুলে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, আজ এই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের সবার সামনে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সামনে আমি বলতে চাই, ‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান, ফর পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি। আজ এ পরিকল্পনা দেশের মানুষের স্বার্থে, দেশের উন্নয়ন, মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। যদি সে পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হয়, প্রিয় ভাই-বোনেরা সারা দেশে গণতন্ত্রের শক্তি যত মানুষ উপস্থিত আছেন, প্রত্যেকটি মানুষের সহযোগিতা আমার লাগবে। আপনারা যদি আমাদের সহযোগিতা করেন, ইনশাআল্লাহ আমরা ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব।
এ সময় মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাহায্য কামনা করে তারেক রহমান বলেন, ‘আসুন আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করি- হে রাব্বুল আলামিন, হে একমাত্র মালিক, একমাত্র পরওয়ারদিগার, একমাত্র রহমত দানকারী, একমাত্র সাহায্যকারী- আজ আপনি যদি আমাদের রহমত দেন তাহলে আমরা এই দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম করার মাধ্যমে আমাদের প্রত্যাশিত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারব। আজ আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি- ইনশাআল্লাহ আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা আসবে আমরা সবাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে ন্যায়পরায়ণতা, সেই ন্যায়পরায়ণতার আলোকে দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
বিএনপির চেয়ারপারসন ও তার অসুস্থ মা খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ‘এখান থেকে আমি আমার মা দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যাব। যে মানুষটি এই দেশের মাটি-মানুষকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবেসেছেন। তার সঙ্গে কী হয়েছে আপনারা প্রত্যেকটি মানুষ সে সম্পর্কে অবগত আছেন। সন্তান হিসেবে আপনাদের কাছে আমি চাইব, আজ আল্লাহর দরবারে আপনারা দোয়া করবেন, যাতে তিনি সুস্থ হতে পারেন।’
এ সময় ধর্ম, শ্রেণি ও রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে আমাদের দেশের শান্তি-শৃঙ্খলাকে ধরে রাখতে হবে। যেকোনো বিশৃঙ্খলা পরিত্যাগ করতে হবে।’ এ সময় ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার আহ্বানে স্লোগান তুলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আজ আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই- ‘সবাই মিলে করব কাজ, গড়ব মোদের বাংলাদেশ।’
সমাবেশস্থল রূপ নেয় জনসমুদ্রে
তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ে (তিনশ ফিট সড়ক) জনসমুদ্রে পরিণত হয় গতকাল সকাল থেকেই। এর আগে সেখানে গত বুধবার থেকে নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ভোরে ঢাকায় এসেছেন সানাহ উল্লাহ। তিনি বলেন, বাড়িতে বলে এসেছি, তারেক ভাইকে দেখতে যাচ্ছি, দেখে এসে মিষ্টি খাওয়াব। দুপুরে বিমানবন্দর থেকে অনুষ্ঠানস্থল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ তারেক রহমানকে শুভেচ্ছা জানান। বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফিট রূপ নেয় জনসমুদ্রে।
বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সেক্রেটারি নাজমুল হাসান রুবেলের নেতৃত্বে দশজন কর্মী অংশ নেন অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে। নাজমুল বলেন, ‘দীর্ঘ সময় আমরা নির্যাতিত হয়েছি। দেশে ভোটাধিকার ছিল না। আমাদের নেতা তারেক রহমানকে শুধু রাজনৈতিক কারণে দেশে আসতে দেওয়া হয়নি।’
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থেকে আসা বিএনপিকর্মী রুহুল আমিন বলেন, ‘দেশের মানুষ তারেক রহমানকে কতটা ভালোবাসে আজকের এই জনসমুদ্র তার প্রমাণ।’
বিমানবন্দরে দেওয়া হয় অভ্যর্থনা
বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তারেক রহমানকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়ে এবং আলিঙ্গনে-করমর্দনে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
এ সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ড. আব্দুল মঈন খান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ (টুকু) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় পতাকা হাতে তারেককে শুভেচ্ছা
জনস্রোতের মধ্য দিয়ে বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনা স্থলে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এ সময় গাড়ি থেকে হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন তিনি। আর নেতাকর্মীরা তাকে জাতীয় পতাকা নেড়ে শুভেচ্ছা জানান।
আলোচনায় ‘জেবু’
তারেক রহমানের সঙ্গে দেশে এসেছে তার পোষা বিড়াল জেবু। বিড়ালটিকে একটি বিশেষ খাঁচায় করে আনা হয়। পরে বিমান থেকে নামিয়ে তারেক রহমানের পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন স্থানে ছিল জরুরি চিকিৎসাসেবা
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) উদ্যোগে ২৫টি এবং দলের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ১৭টি মেডিকেল টিম কাজ করেছে। এ ছাড়া সংবর্ধনাস্থলের কাছে ৬ শয্যাবিশিষ্ট একটি অস্থায়ী মেডিকেল স্থাপন করা হয়। এছাড়া ঢাকা-১৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী এসএম জাহাঙ্গীর হোসেনের উদ্যোগে বিনা মূল্যে পানি ও খাবার সরবরাহ করা হয়।
শুক্রবার ও শনিবারের কর্মসূচি
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর তারেক যাবেন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে। সেখানে তার বাবা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করবেন। এরপর যাবেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
এরপর আগামীকাল শনিবার ভোটার নিবন্ধনের জন্য তারেক আগারগাঁও নির্বাচন কমিশনে যাবেন। সেখানে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাবেন। সেখানে জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবরের পাশে ইনকিলাব মঞ্চ-এর মুখপাত্র শহীদ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করবেন।
এরপর শ্যামলীতে যাবেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল)। জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে তিনি সেখানে যাবেন।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় ২০০৮ সালে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ওই সময় বিরাজনীতিকরণের অংশ হিসেবে ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জোর করেই তাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেয়। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মইনুল রোডের বাসা থেকে তাকে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করে। অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। ওই বছর ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি নিপীড়নের কিছু চিত্র তুলে ধরেছিলেন। রিমান্ড, নির্যাতনসহ ৫৫৪ দিন কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্যারোলে মুক্তি দেয় জরুরি অবস্থার সরকার। জামিন পাওয়ার আট দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালের রাতে স্ত্রী-কন্যাসহ তাকে চিকিৎসার নামে জোর করে লন্ডনে পাঠানো হয়। সেই সময়কার উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় এই তরুণ নেতাকে রাজনীতির বাইরে রাখতে জোরপূর্বক মুচলেকায় স্বাক্ষর করিয়েও রাখা হয়।
লন্ডনে পাঠানোর পরও থামেনি তার ওপর নির্যাতনের খড়গ। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ১৩টির পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে তার বিরুদ্ধে নতুন হয় ৭২টি মিথ্যা মামলা। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় তাকে। শেখ হাসিনার সরকার তার বিরুদ্ধে বারবার হুলিয়া জারি করে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করানো হয়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি মুফতি হান্নানকে দীর্ঘদিন রিমান্ড নির্যাতন করে এক বিতর্কিত স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। ওই স্বীকারোক্তিকে আমলে নিয়ে একুশে আগস্ট মামলার বিচার শুরুর পর ফের সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে সেখানে তারেক রহমানসহ আরো কয়েকজনকে জড়ানো হয়। এ মামলায় তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনার সরকার তার দলীয় বিচারবিভাগকে ব্যবহার করে তারেক রহমানকে কথা বলার পথও রুদ্ধ করে দেয়। আদালত নজিরবিহীনভাবে বাংলাদেশে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়। এই সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ায় সব মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সর্বশেষ এ বছর ২৮ মে ওয়ান ইলেভেনে দায়েরকৃত দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে হাইকোর্ট খালাস দেয়।
২০০৮ সালে নির্বাসনে যাওয়া তরুণ নেতা তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবন নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এরই মধ্যে এক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক নিপীড়ন, কারাবরণ ও প্রবাস জীবন সত্ত্বেও তিনি নিজেকে আধুনিক, সংস্কারমুখী ও তৃণমূলভিত্তিক এক গণনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। হয়ে উঠেছেন একজন পরিপক্ব রাজনীতিক।
দীর্ঘদিন জোরপূর্বক নির্বাসিত হওয়ার পর বীরের বেশে দেশে ফেরার রেকর্ড করলেন তারেক রহমান। বাংলাদেশে তো নয়ই, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো রাজনৈতিক নেতাকে দেড় যুগ নির্বাসনে থাকতে হয়নি। শেখ হাসিনা নির্বাসনে ছিলেন সাত বছর। তবে তার নির্বাসন কোনো শাসকের চাপে নয়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যার পর বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনা স্বেচ্ছায় নির্বাসনে ছিলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে তাকে দলের সভাপতি করলে তিনি বিনাবাধায় দেশে ফিরে আসেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য নেতাদের মধ্যে বেনজির ভুট্টো, গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, গোতাবায়া রাজাপাকসে, নওয়াজ শরিফ ও পারভেজ মোশাররফকে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। তবে তাদের নির্বাসনের সময়কাল ছিল দুই থেকে আট বছরের মধ্যে।