বিপ্লবী শরীফ ওসমান হাদি জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু স্মরণীয় ও আলোচিত বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে গেছেন। এরমধ্যে নিজের আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘রাজনীতিবিদের মৃত্যু বাসায় হতে পারে না। এটা কোনো ভালো মৃত্যু না। যিনি রাজনীতি করেন, যিনি লড়াই করেন, যিনি সংগ্রামী-তার মৃত্যুটা হবে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, রাজপথে। আমি ভীষণভাবে প্রত্যাশা করি ও ছোটবেলা থেকে স্বপ্নও দেখি এবং অনেক জায়গায় বলেছি। সেটি হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি তুমুল মিছিল হচ্ছে, সে মিছিলের সামনে আমি আছি, কোনো একটা বুলেট এসে হয়ত আমরা বুকটা বিদ্ধ করে দিয়েছে। এ মিছিলে হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে গেছি। আমি একটি ইনসাফের হাসি নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে চাই।’
বিপ্লবী শরীফ ওসমান হাদির সেই ইচ্ছাই যেন পূরণ করলেন মহান আল্লাহ। এত বিশাল জানাজা এবং লাখ লাখ মানুষের ভালবাসা কয়জনের ভাগ্যে জুটে। এমন সৌভাগ্য কয়জনের হয়। শনিবার দুপুরে মানিক মিয়া এভিনিউতে লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণে ওসমান হাদির জানাজায় জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকা থেকে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী জিয়াউল হক মিঠু (৫৫)।
তিনি বলেন, ‘আমার জীবদ্দশায় এতো বিশাল জনসমুদ্রের জানাজা আর কখনো দেখিনি। এটা জনসমুদ্র না বলে জনমহাসমুদ্র বলা যায়। স্বল্প বয়সেই শহীদ হাদি যা অর্জন করতে পেরেছে; তা কেউ শত বছরেও অর্জন করতে পারে না। সততা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে হাজার বছর মানুষের হৃদয়ে থাকবেন শহীদ ওসমান হাদি। মহান আল্লাহ যেন সর্বোচ্চ পুরস্কার দান করেন।’
ঠিক তখন পৌনে দুপুর দুইটা; ফার্মগেট মেট্রোরেল স্টেশনের সিঁড়ি বেয়ে নামা যাচ্ছিল না। ট্রেন থেকে নেমেই সবাই একযোগে স্লোগান ধরেন ‘তুমি কে আমি কে হাদি হাদি; দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। এ মিছিলটি সিঁড়ে থেকে নামতেই আটকে যায়। এরপর প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে একটু সামনে খামারবাড়ি মোড়ে গিয়ে দেখা গেল চারদিক থেকে শুধু মিছিল আর মিছিল আসছে। মিছিলের সবার একই ধরনের স্লোগান শোনা যায়। আর এ সব মিছিলের গন্তব্য একই গন্তব্য জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা মানিক মিয়া এভিনিউ।
পশ্চিম দিকে আরেকটু এগিয়ে দেখা গেল সংসদ ভবনের দক্ষিণ গেইট বন্ধ, সব মিছিল সংসদ ভবনের চারদিকের সড়কেই থমকে যায়। মানুষ গেইট দিয়ে ঢুকতে না পেরে উচ্চ সীমানা ডিঙিয়ে অনেককে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এসময় সেনাবাহিনী বাধা দিয়েও হিমশিম খাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আগত জনস্রোতের এক সিকি অংশও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। লাখ লাখ মানুষ সংসদ ভবনের বাইরেই চারদিকের সড়কে জানাজায় অংশ নিতে দেখা যায়।
সকাল ৯টার পর থেকেই মানুষ আসা শুরু হলেও দুপুর আড়াইটায় জানাজা নামাজ শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে চারদিক থেকে মুহুর্মুহু স্লোগানে মিছিলের ঢল নামে। এতে শহীদ হাদির জানাযাস্থল মানিক মিয়া এভিনিউতে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া এভিনিউয়ের আশপাশের এলাকায় ইতিহাসের রেকর্ড মুসল্লির সমাবেশ ঘটে।
সংসদ ভবনের বাইরে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেমগুলো কাজ না করায় জানাজা নামাজ পড়তে গিয়ে বেশিরভাগ মুসল্লি বিপাকে পড়েন। এসময় অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা যায়।
পরে দুপুর ২ টা ৩৫ মিনিটের দিকে জানাজা নামাজ শেষ হলে জনস্রোতের গন্তব্য পরিবর্তন হয়ে সবমিছিল ছুটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ জনস্রোতের সেদিকেই বইছিল।
রাসেল মিয়া (৪৫) নামের এক গারমেন্টস শ্রমিক আমার দেশকে বলেন, সকাল ৭টায় টঙ্গি থেকে রওয়ানা দিয়ে ৯টার দিকে জানাযাস্থলে যান। আগে না আসলে হয়ত ভেতরে প্রবেশ করতেই পারতাম না। জীবনে অনেক জানাজায় অংশ নিয়েছি; কিন্তু এতো মুসল্লির জানাজা এর আগে কখনো দেখিনি। সত্য ও ন্যায়ের কাণ্ডারি ও শ্রমজীবী-মেহনতি আপামর মানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন হাদি।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকা থেকে আসা জিয়াউল হক মিঠু (৫৫) বলেন, লাখ লাখ মুসল্লির অংশ গ্রহণে এতো বড় জানাজায় এর আগে কখনো দেখিনি। শরীফ ওসমান হাদি ছিলেন সত্যের পথিক ও মহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর; তাঁর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের যে ভালবাসা, জানাজায় অংশ না নিলে হয়ত বুঝতে পারতাম না।
আবু তালহা নামের মসজিদের খাদেম বলেন, এই বিশাল জনসমুদ্রের জানাজা বলে শরীফ ওসমান হাদি কেমন মানুষ ছিলেন। তার মতো মানুষ এদেশের খুবই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অকালেই আমরা তাকে হারালাম। এখনো খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
রাজধানীর মিরপুর ১০ এলাকা থেকে আগত এক হোটেল শ্রমিক মিলন বলেন, হাদিকে আমি অনুকরণ করতাম, তার সব কাজ ও কথা ভাল লাগতো। তাই তার প্রতি ভালবাসা থেকেই আজ তার জানাজায় অংশ নিতে এসেছি। আমার সাথে আরো কয়েকজন শ্রমিক এসেছেন একই কারণে।
আবুল কালাম নামের এক ট্রাক ড্রাইভার বলেন, আমার জীবদ্দশায় তো নয়, স্বাধীনতার পর লাখ লাখ মুসল্লির অংশ গ্রহণে এতো বড় জানাজা আর কখনো হয়েছে বলে জানা নেই। স্বল্প বয়সেই হাদি যা অর্জন করতে পেরেছিল; তা অনেকে একশো বছরেও অর্জন করতে পারে না।
তবে হাবিবুর রহমান নামের অপর ট্রাক ড্রাইভার বলেন, স্বাধীনতার পর শহীদ মেজর জিয়াউর রহমানের জানাজায়ও এমন ঢলে নেমেছিল মানুষের। ওই জানাজার থেকে বড় না ছোট তা বলতে পারবো না; তবে আজকের জানাজায় মুসল্লির ঢল অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে মনে হয়েছে। বিপ্লবী হাদির প্রতি ভালবাসা থেকেই এমন ঢল নামে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে আসা নোমান নামের এক শ্রমজীবী বলেন, বিপ্লবী হাদির কথাগুলো ছিল সত্য ও ন্যায়ের, ইসলামের, ইনসাফের কথা। যেকারণে তার কথাগুলো সর্বস্তরের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। তাই আজ লাখ লাখ মুসল্লি তার জানাজায় অংশ নিয়েছেন।
শনিবার জানাজায় লাখ লাখ মুসল্লির মধ্যেই বেশির তরুণ-যুবকদের অংশ নিতে দেখা গেছে। এ সময় অনেক মুসল্লিকে ওসমান হাদির জন্য প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখা গেছে।
‘আপনাকে যদি হত্যা করা হয়, সেই শহীদের রক্তের বিনিময় যদি বাংলাদেশ গড়ে যেতে পারেন। আগামী এক হাজার বছর বাংলাদেশের মানুষ নামাজে প্রার্থনায় আপনার জন্য শুধু দোয়া করবে।’ হাদির এই বিখ্যাত উক্তির কথা উল্লেখ করে যাত্রাবাড়ীর নোমান বলেন, মহান আল্লাহ যেন হাদির সেই ইচ্ছাই পূরণ করলেন।