বিশেষজ্ঞদের অভিমত
ভারতের প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে একটি স্বাধীন এবং ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার পররাষ্ট্রনীতির মূল্যায়ন করে বলছেন, মুসলিম বিশ্ব ও চীনের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ভারতের সঙ্গে তিনি বৈরিতা এড়িয়ে সব সময় একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাও করেন।
তারা বলেন, খালেদা জিয়া ‘লুক-ইস্ট পলিসি’ গ্রহণের মাধ্যমে চীনসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের ওপর বিশেষ জোর দেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কার্যকর করার ব্যাপারে সব সময় তিনি ছিলেন সচেষ্ট। বিশেষ করে সার্ক এবং ওআইসির মতো সংস্থাগুলোকে কার্যকরের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল খুবই ইতিবাচক।
বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে বলেন, বিএনপিপ্রধান একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির জন্য কাজ করেছেন। খালেদা জিয়া ভারতীয় প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে সবার সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে তিনি কখনই ছাড় দেননি। বেগম জিয়াই প্রথম ফারাক্কা ইস্যুটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তুলে ধরে ভারতকে রীতিমত অবাক করে দিয়েছিলেন।
শহীদুজ্জামান আরো বলেন, চীন ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন তিনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি আওয়ামী লীগের ভারতনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি থেকে বাংলাদেশকে দূরে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি এতে সফলও হয়েছিলেন।
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান। তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক চাইতেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশাও ছিল ঠিক সে রকম।
বাংলাদেশের লুক-ইস্ট পলিসির কথা তুলে ধরে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে লুক-ইস্ট পলিসিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যাও তৈরি হয়েছিল শেষ মেয়াদে। তার মন্ত্রিসভার কয়েক সদস্য বাংলাদেশে তাইওয়ানের একটি কনস্যুলেট অফিস খোলার চেষ্টা করেছিলেন, যা ছিল একেবারেই ভুল পদক্ষেপ। খালেদা জিয়া মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সর্বোপরি তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে বলেন, খালেদা জিয়া একটি স্থিতিশীল পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তিনি একটি উন্মুক্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। তার সময়ই তিন বিঘা করিডোর খুলে দেওয়া হয়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে উন্মুক্ত করা হয় বাজার। তিনি ভারতের সঙ্গে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখার কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য তিনি সবাইকে নিয়ে সার্ককে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন।
হুমায়ুন কবীর আরো বলেন, খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনি লুক-ইস্ট পলিসি নিয়েছিলেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল চীন ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি একটি টেকসই অংশীদারত্ব গড়ে তোলা। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ার জন্য তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার সরকারের সময় মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশের মানবসম্পদ রপ্তানির দুয়ার খুলে যায়। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ২৪টি দেশকে সন্ত্রাসের মদতদাতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশকে তখন থেকে নিরাপদে রেখেছিলেন খালেদা জিয়া।