সুন্দরবন কিংবা পার্বত্য এলাকার গহীন পাহাড়ি অরণ্যে দেখা যায় ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমারোহ। মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটা সরু পথ। এত কাছাকাছি গাছ আর লতা-গুল্মের ঝোপ, সূর্যের আলোও যেন ঠিকমতো মাটিতে পড়ছে না।
নগর জীবনে এমন দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। উল্টো কংক্রিটের চাহিদা মেটাতে গাছপালা কেটে পোড়ানো হচ্ছে ইটভাটায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের প্রথম কৃত্রিম বন ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’। পরীক্ষামূলকভাবে উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি এই বন প্রকৃতিপ্রেমী ও গবেষকদের মাঝে সাড়া ফেলেছে। প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে পরিবেশ সংরক্ষণের একটি টেকসই মডেল তৈরি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এমন প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি উদ্যেগে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে গড়ে উঠেছে একটি কৃত্রিম বন। যেখানে মাত্র চার হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গায় ছোট-বড় ১২০ প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্মে মাত্র তিন বছরেই ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
এই প্রকল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, 'মিয়াওয়াকি ফরেস্ট' পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলকভাবে দেশের প্রথম কৃত্রিম বন তৈরিতে সফল হয়েছেন তারা। প্রকল্পের পরামর্শক দেলোয়ার জাহান জানান, মাটি প্রস্তুত, জৈব উপাদান সংযোজন এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে বনায়ন করা হয়েছে।
সাধারণ বন থেকে এই বন ১০ গুণ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। এই প্রকল্পে স্থানীয় গাছের প্রজাতি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি গভীর বন তৈরি করা হয়েছে।
জানা যায়, মিয়াওয়াকি ফরেস্টের ধারণার প্রবক্তা হচ্ছেন জাপানের বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ আকিরা মিয়াওয়াকি। এ পদ্ধতিতে ছোট ছোট জায়গায় অল্প সময়ে বয়স্ক বনের আদল তৈরি করা যায়। তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মাত্র ৩০ বর্গফুটের মধ্যেও বন তৈরি করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে লাগানো গাছ সাধারণ বনের গাছের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়।
বছরে অন্তত এক মিটার বাড়ে। মিয়াওয়াকি উদ্ভাবিত এই বন তৈরির পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো স্থানে ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে গভীর বন তৈরি করা সম্ভব। বর্তমানে আকিরা মিয়াওয়াকির এই ধারণা কাজে লাগিয়ে নেদারল্যান্ডস ও ভারত তাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ গড়ে তুলে সুফল পাচ্ছে।
বাংলাদেশে মীরসরাই উপজেলার সোনাপাহাড় এলাকায় ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে এই ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ ধারণার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মিরসরাইয়ে ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ প্রকল্পে গড়ে তোলা ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্ভিদ ও প্রকৃতি চর্চা–সম্পর্কীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তরু পল্লবের প্রতিষ্ঠাতা, প্রাবন্ধিক ও উদ্ভিদবিষয়ক গবেষক মোকারম হোসেন বলেন, অল্প সময়ে বন সৃষ্টির দারুণ এক পদ্ধতি ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’।
দেশে বন বিলুপ্তির এ সময়ে মিরসরাইয়ে প্রকল্প সোনাপাহাড়ের উদ্যোগে মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ তৈরির মডেলটি একটি সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
এই পদ্ধতির বনের সবচেয়ে বড় উপকারী দিকটি হচ্ছে স্থানীয় প্রজাতির গাছ দিয়ে এই বন তৈরি করা হয় বলে দেশীয় ও স্থানীয় গাছ রক্ষায় এ বনের বড় ভূমিকা থাকে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্পটির শুরুর দিকে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তখন তাদের প্রস্তুতিপর্ব চলছে।
আমার জানামতে, মিরসরাইয়ের উদ্যোগটি ছাড়া এখন পর্যন্ত দেশে আর কোনো মিয়াওয়াকি ফরেস্ট নেই। সরকারি ন্যাড়া পাহাড়গুলোতে আগ্রহী ব্যক্তিদের অংশীজন করে মিয়াওয়াকি ফরেস্ট সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।