হোম > বাণিজ্য

সংকুচিত হয়ে আসছে ইউরোপের রপ্তানি বাজার

সংকটে পোশাক খাত

সোহেল রহমান

দেশে সামগ্রিক অর্থনীতির ধীরগতির মধ্যে কিছুটা আশাব্যঞ্জক ছিল রপ্তানি প্রবৃদ্ধি। কিন্তু ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এসে ভাটা পড়েছে রপ্তানি আয়ে। সামগ্রিক আয় কমার অন্যতম কারণ দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের দুরবস্থা। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক খাত।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ইউরোপের বাজারগুলোয় ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়েছে। এছাড়া মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা, দেশভেদে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের পোশাক খাত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোশাক খাতে মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেক ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। এ অঞ্চলে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইউরোপের বাজারে চলতি জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৭৮৩ কোটি ডলার। আগের বছর একই সময়ে রপ্তানি ছিল ৭৯১ কোটি ডলার। ফলে রপ্তানি কমেছে এক দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। স্পেন, পোল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসে রপ্তানি বাড়লেও একক দেশ হিসেবে দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার জার্মানিসহ ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও ইতালিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে।

ইপিবির তথ্য মতে, নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি হয়েছে তিন দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল তিন দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমার হার ৫ শতাংশ। অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৩০২ কোটি ডলার, আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩৩০ কোটি ডলার। শতকরা হিসাবে গত বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৬৩ কোটি ডলার, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ৩৮০ কোটি ডলারেরও বেশি। আগস্ট মাসে রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ১১ কোটি ডলার কমে ৪০৩ কোটি ডলার থেকে ৩৯২ কোটি ডলারে নেমে আসে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানির অবস্থা সন্তোষজনক নয়। গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি পরিবর্তনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারছে না এ শিল্প খাতটি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে এক লাফে শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় প্রায় ১৫০ শতাংশ। বর্তমান সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কৌশল হিসেবে এবং দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শে ঋণের সুদহার ৯ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়। ২০২৪ সালেও দুই দফা গ্যাসের দাম বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ৩১ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়। আবার অন্তর্বর্তী সরকার নতুন শিল্প সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৪০ টাকা করেছে।

পতিত সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং বর্তমান সরকারের নতুন শিল্পের জন্য অতিরিক্ত গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ এ খাতকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া শক্তিশালী বিপণন কার্যক্রমের অভাব, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যে বৈচিত্র্য না আনা, দুর্বল বিপণন কৌশল এবং সরকারি প্রণোদনা কমে যাওয়াই রপ্তানি কমার প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, রপ্তানি উৎসাহিত করতে পাঁচ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ছিল। এখন তা কমে দুই শতাংশে নেমে আসায় রপ্তানিকারকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমার দেশকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে পোশাকের রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ চীন ও ভারতের আগ্রাসী রপ্তানি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অনেক বেশি শুল্কের কারণে তারা কম দামে ইইউতে রপ্তানি করছে। এ কারণে সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি কমছে। ব্যাংক লুটপাট, উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের শিল্প খাতটি বর্তমানে মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। এর মধ্যে কিছু কাস্টমস কর্মকর্তা আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রপ্তানিকারকদের ভোগান্তির চেষ্টা করছেন।

বস্ত্র ও পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী—পোশাক রপ্তানির এ সংকটের শুরু পতিত হাসিনা সরকারের আমলের; ২০২৩ সাল থেকে। রপ্তানি ধসে সে সময় বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২২ মাসে বন্ধ হয়ে গেছে আরো ২২৬টি কারখানা। এর মধ্যে আওয়ামী আমলে আর্থিকভাবে ব্যাপক সুবিধাভোগী কিছু ব্যবসায়ী নেতার কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে। এসব নেতাদের কেউ বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে আছেন, আবার কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। ফলে সামগ্রিক পোশাক রপ্তানিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।