হোম > মতামত

খালেদা জিয়া : বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি

আবদুল লতিফ মাসুম

রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু নাম শুধু ব্যক্তি হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকে নাÑতারা সময়, সংগ্রাম ও রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিচ্ছবিতে রূপ নেয়। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম। আজ সকাল ৬টায় তার মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি হারাল এক দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতীক এবং এক আপসহীন নেতৃত্বের নাম। এর মাধ্যমে একটি যুগের অবসান ঘটল। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।

মহাকবি শেকসপিয়ারের সেই বহুল উদ্ধৃত উক্তি—‘Some are born great, some achieve greatness, and some have greatness thrust upon them.’—যদি কারো জীবনে প্রযোজ্য হয়, তবে তিনি খালেদা জিয়া। জন্মসূত্রে রাজনীতির কোনো প্রস্তুতি না থাকলেও ইতিহাস, দায়িত্ব ও নিয়তির অনিবার্য টানে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে রূপান্তরিত করেন এক অনন্য নেতৃত্বে।

১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়ির নয়াবস্তিতে জন্ম নেওয়া খালেদা খানম পুতুল বেড়ে উঠেছিলেন এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, মা তৈয়বা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। শৈশব ও শিক্ষাজীবন কেটেছে দিনাজপুরে। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চৌকস ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তার জীবনের গতি ভিন্ন এক পথে প্রবাহিত হয়। তবে এই পরিবর্তন ছিল নীরব, আড়ালবহুলÑএকজন সেনা কর্মকর্তার সহধর্মিণী হিসেবে তিনি ছিলেন নীরব শক্তি।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনে গভীর ছাপ ফেলে। স্বামী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, আর তিনি দুই সন্তান নিয়ে আত্মগোপন, গ্রেপ্তার ও বন্দিত্বের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন দখলদার বাহিনীর নির্মমতা। এই অভিজ্ঞতা তাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করলেও স্বাধীনতার পরও তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি। এমনকি রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে ‘ফার্স্ট লেডি’ হওয়ার পরও তিনি ছিলেন অন্তরালে—সংসার ও পরিবারই ছিল তার জগৎ।

কিন্তু ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক নির্মম সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণ করলে ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। দেশ, দল ও আদর্শ এক গভীর সংকটে পতিত হয়। সেই সংকটময় মুহূর্তে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এই সিদ্ধান্ত কোনো ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়, বরং দায়িত্ববোধ এবং আদর্শিক উত্তরাধিকার রক্ষার তাগিদ থেকেই ছিল।

এরপর শুরু হয় এক দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ রাজনৈতিক যাত্রা। সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলনে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে। আট বছরের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে তার দৃঢ়তা, সাহস ও নেতৃত্ব বিএনপিকে পুনর্গঠিত করে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক শক্তিতে রূপ দেয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বেই বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং তিনি হন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী—মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম মেয়াদের সবচেয়ে ঐতিহাসিক অবদান ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন। ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল তার রাজনৈতিক দর্শনের স্পষ্ট প্রতিফলন—ক্ষমতা নয়, দায়িত্বই রাজনীতির মূল কথা।

১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তার সরকার নানা বিতর্ক, সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। দুর্নীতি, সুশাসন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে তার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যা ইতিহাসের অংশ হিসেবেই মূল্যায়িত হবে। তবে এটিও সত্য, এই সময়ে বিএনপি দেশের ডানপন্থি ও মধ্যপন্থি রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে একত্র করে একটি বিস্তৃত গণভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়।

ক্ষমতার বাইরে থাকাকালেও বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন রাজনীতির প্রধান নির্ধারক শক্তি। এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার মাধ্যমে তাকে রাজনীতি থেকে উৎখাতের চেষ্টা করা হয়। সন্তানদের গ্রেপ্তার, নির্যাতন, নিজে কারাবরণ—কোনো কিছুই তাকে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে পারেনি। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, কারাদণ্ড ও গৃহবন্দিত্ব আরোপের ঘটনাগুলো ইতিহাসের এক কঠিন অধ্যায় হয়ে আছে।

বিশেষভাবে আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা তাকে দীর্ঘদিন রাজনীতি থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। তবে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তার মুক্তি এবং পরবর্তী সময়ে খালাস প্রমাণ করে—এই অধ্যায়ও ছিল বিতর্কিত ও সময়সাপেক্ষ।

তার রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ—ভূখণ্ডকেন্দ্রিক জাতীয় পরিচয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, উৎপাদন ও সুষম বণ্টন। তিনি রাজনীতিকে কখনোই কেবল ক্ষমতার লড়াই হিসেবে দেখেননি। ব্যক্তির ঊর্ধ্বে দল, দলের ঊর্ধ্বে দেশ—এই দর্শন তিনি আজীবন ধারণ করেছেন।

তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, দীর্ঘদিনের বিরোধীদলীয় নেতা, আপসহীন আন্দোলনের প্রতীক—এসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বেগম খালেদা জিয়া হয়ে উঠেছিলেন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তার নেতৃত্বে বিএনপি কেবল একটি দল নয়, বরং গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থের প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আজ তার প্রয়াণে বাংলাদেশ হারাল এক দৃঢ়চেতা নেতৃত্বকে। সমর্থক ও সমালোচক—সব পক্ষের কাছেই তিনি ছিলেন এক অবিচ্ছেদ্য রাজনৈতিক বাস্তবতা। ইতিহাস তাকে বিচার করবে তার সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা উভয়ের আলোকে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র নির্মাণ ও রক্ষার সংগ্রামে এক অনিবার্য নাম।

তিনি ছিলেন দেশনেত্রী, কারণ তিনি দেশকে নিজের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন; তিনি ছিলেন ইতিহাস, কারণ ইতিহাস তাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ‘এনেছিলে সঙ্গে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’

খালেদা জিয়া ও মর্যাদার রাজনীতি

ক্ষমা করবেন ম্যাডাম

আপসহীন দুই প্রজন্মের দুই প্রতিনিধির বিদায়

বেগম খালেদা জিয়া: এক হার না মানা জীবনের প্রতিচ্ছবি

গৃহবধূ থেকে দেশনেত্রী: এক সংগ্রামমুখর জীবনের আলেখ্য

নতুন বছরে যেসব ইস্যু মধ্যপ্রাচ্যকে চ্যালেঞ্জে ফেলবে

উত্তরবঙ্গের তাঁতপল্লি : নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব

ওসমান হাদি হত্যা ও আজাদির লড়াই

মব, গণআদালত থেকে পোস্ট-শাহবাগ

জাতীয় ঐক্যের এক অনন্য সুযোগ ও আমাদের দায়বদ্ধতা