হোম > মতামত

জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় আসার পটভূমি

সিরাজুর রহমান

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর সকাল ৮টায় কর্নেল রশীদ জিপে করে ৫৪ নম্বর আগামসি লেনের বাড়ি থেকে মুজিব সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে শাহবাগের রেডিও স্টেশনে নিয়ে যান। কর্নেল ফারুকসহ আরো কয়েকজন অফিসার সেখানে ছিলেন। তারা খন্দকার মোশতাককে সরকারের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। বলেন, মোশতাকই হচ্ছেন তাদের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য নেতা। জবাবে মোশতাক বলেন, শুধু তাদের কথায় তিনি ক্ষমতা নিতে পারেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিদ্রোহী অফিসাররা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান, বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খোন্দকার, বিডিআর প্রধান জেনারেল খলিলুর রহমান এবং রক্ষীবাহিনীর উপ-প্রধানকে সেখানে উপস্থিত করেন। আরো পরে এসেছিলেন পুলিশের প্রধান। তারা সবাই একে একে তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নেওয়ার পর বেলা সোয়া ১১টায় দেড় মিনিটের এক বেতার ভাষণে খন্দকার মোশতাক আহমেদ বলেন, তার প্রতি যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সে দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছেন। (দেখুন : বিবিসির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পনেরো বছর, প্রকাশক ইউপিএল)।

খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে নয়াদিল্লি ভালো চোখে দেখেনি। মোশতাক সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের যোগাযোগও ছিল ন্যূনতম। তার কারণ সৃষ্টি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়েই। তাজউদ্দীন আহমদের সরকারে খন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলতে পারে এবং তাতে প্রচুর প্রাণহানি হবে। আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সম্ভাবনা বিবেচনা করতে তিনি রাজি ছিলেন। সে লক্ষ্যে ওয়াশিংটনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন তিনি।

আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা ভারত সরকারের পরিকল্পনার বিরোধী ছিল। পাকিস্তান খণ্ডিত হবে এবং পূর্ব সীমান্ত নিয়ে তার মাথাব্যথা এবং বার্ষিক হাজার হাজার কোটি রুপির প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, শুধু সে লক্ষ্যেই ভারত মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছিল। তাই প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে তৎকালীন ভারত সরকারের নেতাদের সহযোগিতা প্রায় ফুরিয়ে যায়। তখনো সোভিয়েত জোট এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমি জোটের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ খুবই তীব্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের প্রধান আন্তর্জাতিক মিত্র।

যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার্থী পূর্ব পাকিস্তানের কেউ কেউ খণ্ডকালীনভাবে বিবিসির অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ২৫ মার্চের বর্বর সামরিক অভিযানের পর থেকেই তাদের কয়েকজনকে নিয়ে আমি বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরিচয়ে বিদেশি মিডিয়া ও লন্ডনে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সম্বন্ধে অবহিত করার কাজ শুরু করি। মূলত আমি দু-চার দিন পরপরই একটা করে ‘ফ্যাক্টশিট’ লিখতাম। সাইক্লোস্টাইল করে (তখনো ফটোকপি পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি) সেগুলো মিডিয়া এবং কূটনীতিকদের মধ্যে প্রচার করতেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা। আমরা আমাদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থনদানের জন্য দূতাবাসগুলোকে নিয়মিত অনুরোধ করতাম। কয়েকটি দূতাবাসের প্রতিনিধি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন।

সোভিয়েত দূতাবাসের হয়ে দ্বিতীয় সচিব গেনাডি জুরাফলফ আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। কয়েকবার তিনি বুশ হাউসে এসেও আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। মূলত তারা আমাদের দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি এবং প্রকাশিত কোনো কোনো খবরের বিশ্লেষণ জানতে চাইতেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে জুরাফলফ আমাকে বলেন, একজন ঊর্ধ্বতন সোভিয়েত কূটনীতিক সরাসরি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। নির্ধারিত তারিখে সন্ধ্যায় আমার তৎকালীন সহকর্মী আবিদ হোসেন ও শফিক রেহমানকে সঙ্গে নিয়ে আমি বুশ হাউসের কাছে চার্লস ডিকেন্স নাইট ক্লাবে যাই। সেখানে উপস্থিত হলেন গেনাডি জুরাফলফ ছাড়াও সোভিয়েত দূতাবাসের জনসংযোগ অধিকর্তা ভ্যালেরি কুজনেৎসফ এবং তৃতীয় এক ব্যক্তি, যার নাম আজ আর মনে করতে পারছি না।

তারা আমাদের বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নীতি ও লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের খুঁটিয়ে-নাটিয়ে প্রশ্ন করেন। সবশেষে কুজনেৎসফ বলেন, দিল্লিতে প্রবাসী সরকার যদি খন্দকার মোশতাক আহমেদের পরিবর্তে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করতে রাজি হন, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন দেওয়ার কথা বিবেচনা করবে। সে রাতেই আমি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে টেলিফোনে সে বৈঠকের কথা জানিয়ে দিই। আমার অনুরোধ-উপরোধে তিনি প্রকাশ্যে এবং পূর্ণকালীনভাবে আমাদের আন্দোলনে যোগ দিতে রাজি হয়েছিলেন এবং তার অনুরোধে আমি মিডিয়া সংযোগের দায়িত্ব বজায় রাখতে রাজি হই। তার কয়েক দিন পরই বিচারপতি চৌধুরী বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সুতরাং প্রায় প্রতিদিনই দিনের শেষে আমরা খবরাদি বিনিময় এবং ভবিষ্যৎ কর্মসূচি সম্বন্ধে আলোচনা করতাম।

এর মাত্র তিন দিন পর ভোরবেলায় রেডিওতে শুনি, ‘কূটনৈতিক দায়িত্বের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ কার্যকলাপের’ (গুপ্তচরবৃত্তির) দায়ে লন্ডনের সোভিয়েত দূতাবাসের ৩০৬ জন (উপরোল্লিখিত তিনজনসহ) কূটনীতিককে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। স্বভাবতই আমরা পরের কিছুদিন খুবই ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যেই খবর পেয়েছিলাম, খন্দকার মোশতাকের পরিবর্তে আব্দুস সামাদ আজাদকে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়েছে এবং মোশতাককে দেওয়া হয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রীর পদ। সেটা ছিল ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকের ঘটনা।

আবার অভ্যুত্থান-খালেদ মোশাররফ

ফিরে আসি ১৯৭৫ সালের প্রসঙ্গে। ৩ নভেম্বর ভোর রাতে আরো একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে বাংলাদেশে। মোশতাক ইতোমধ্যেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। ২ নভেম্বর রাতে সে নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে মোশতাক বঙ্গভবনে যে বৈঠক ডাকেন তাতে হাজির ছিলেন স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল, মন্ত্রিসভার সদস্য ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, জেনারেল এম এ জি ওসমানী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর। রাত ১টায় বৈঠক শেষ হয়। আড়াইটার দিকে কর্নেল রশিদ এসে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে খবর দেন যে বঙ্গভবনে কর্মরত সামরিক প্রহরীদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। খুব সকালে ক্যাপ্টেন নূর এসে মোশতাককে জেনারেল খালেদ মোশাররফের পক্ষ থেকে সাত দফা শর্তের একটা তালিকা দেন। সে তালিকার মূল কথা ছিল, খালেদ মোশাররফের দাবিগুলো মেনে নেওয়া হলে সেনাবাহিনী মোশতাককে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল রাখবে।

মোশতাক খালেদ মোশাররফের শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তিনি আর রাষ্ট্রপতি থাকতে চান না। তার জবাব নিয়ে ক্যাপ্টেন নূর চলে গেলেন। আরো পরে মোশতাক যখন তার মিলিটারি সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মশুরুল হকের কামরায় ছিলেন, তখন জেনারেল খালেদ মোশাররফ তাকে ফোন করেন। তিনি এবং বিমানবাহিনীর নবনিযুক্ত প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল তওয়াব দাবি করেন, বঙ্গভবনে অবস্থিত শেখ মুজিবের ঘাতকদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ প্রমুখ সংশ্লিষ্ট অফিসাররা আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, তারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে খালেদ মোশাররফের সমর্থক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন। এই অচলাবস্থার অবসানের জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তার মধ্যস্থতায় জেনারেল খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহী অফিসারদের বিদেশে নির্বাসনে পাঠাতে রাজি হন।

সে রাতে (২ নভেম্বর ১৯৭৫) জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী ডিনারের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন। ১টার দিকে বাড়ি ফিরে তারা শুয়ে পড়েন। ঘণ্টাখানেক পরই দরজায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে জেনারেল জিয়া উঠে গিয়ে দরজা খোলেন। উপস্থিত খালেদ মোশাররফের প্রতি অনুগত অফিসাররা তাকে বলেন, তাকে গৃহবন্দি করা হচ্ছে। তারা বাইরের ফটক এবং দরজায় তালা লাগিয়ে দেন। একাধিক অফিসার জিয়াকে পাহারা দেওয়ার জন্য বাড়ির ভেতরেই অবস্থান করছিলেন।

প্রবল বিরোধিতা

খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে দিল্লি খুবই খুশি হয়েছিল। কূটনৈতিক মহলে বিষয়টি তখন বহুল আলোচিত ছিল। বিবিসিতেও ভারতের সে প্রতিক্রিয়ার খবর আমরা জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশে কিছুসংখ্যক অফিসার এবং বহু জওয়ান খালেদের প্রবল বিরোধিতা করেছেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে গোলাগুলি বিনিময়ে বেশ কয়েকজন মারাও গিয়েছিলেন। তিন মাস পর ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি যখন ঢাকা যাই, আমার বড় ভাই এয়ার কমোডর এ বি এম মাহবুবুর রহমান আমাকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অফিসারদের একটা বাড়িতে নিয়ে যান। সে বাড়ির দেয়াল ও সিলিংয়ে তখনো অন্তত এক হাজার বুলেটের দাগ ছিল।

জওয়ানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া খুবই বিরূপ ছিল। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে কয়েকজন অফিসার তাদের ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু মুজিব হত্যার পরের অতি অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সেসব অফিসার তাদের খোঁজখবর করেননি। তারা তখন খুবই অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। তারপর সেসব অফিসার নিরাপদে বিদেশে চলে গেলেন, তাদের কথা ভাবলেন না। সাধারণ সৈনিকরা এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা বলেই দেখেছিল। সেসব সৈনিকের অভ্যুত্থান করার শখ মিটে গিয়েছিল। সে জন্যই খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে, বিশেষ করে অত্যন্ত জনপ্রিয় অফিসার জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করায় সাধারণ সৈনিকরা রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়।

এই ক্রুদ্ধ সৈনিকদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন কর্নেল তাহের। অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে জেনারেল খালেদ মোশাররফ ভারত সীমান্তের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সৈনিকদের হাতে ধরা পড়ে তিনি নিহত হন। আর একটা ব্যাপার এখানে সক্রিয় ছিল। এর কিছুকাল আগে থেকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সেনাবাহিনীর ভেতরে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছিল। গণচীনে তখন অনিয়মিত স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনী ছিল। জাসদ ও কর্নেল তাহের বাংলাদেশেও সে রকম একটা সমাজতন্ত্রী এবং স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন। ক্যান্টনমেন্টগুলোতে তখন উপরিউক্ত লক্ষ্যে নিয়মিত জাসদের প্রচারপত্র বিলি হতো। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে জওয়ানরা মিছিল করে স্লোগান দিচ্ছিলÑ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই, অফিসারের কল্লা চাই’।

খালেদ মোশাররফের হত্যার পর একদল সিপাহি জিয়ার বাসভবনে হাজির হন এবং ফটক ও দরজা ভেঙে তাকে মুক্ত করে। তারপর তারা কাঁধে করে জেনারেল জিয়াকে সেনা সদর দপ্তরে নিয়ে যান। আরো পরে তারা এসে জেনারেলের ইউনিফর্ম নিয়ে যান। এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমাকে দিয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর। আমি তখন রানি এলিজাবেথের সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতে গিয়েছিলাম।

বিগত কয়েক দিনে শাসক দলের কোনো কোনো মন্ত্রী ও নেতা জেনারেল জিয়া জেলহত্যার জন্য দায়ী বলে কুৎসা রটনা করছিলেন। ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশাররফের লোকরা তাকে গৃহবন্দি করেছিল এবং সর্বক্ষণ তাকে পাহারা দিচ্ছিল। ৭ নভেম্বর জওয়ানরা এসে তাকে মুক্ত করা পর্যন্ত সেভাবেই তিনি পাহারাধীনে গৃহবন্দি ছিলেন। তা ছাড়া খালেদ মোশাররফ তখন সেনাবাহিনীর অধিকর্তা। এমতাবস্থায় ৩ নভেম্বর রাতের জেলহত্যায় শহীদ জিয়াউর রহমান কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন, সেটা কোনো সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বোধগম্য হবে না। আওয়ামী লীগ মন্ত্রী ও নেতাদের কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে তারা সর্বক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। শহীদ জিয়া ও তার পরিবারের ওপর ক্রমাগত মিথ্যা অপবাদের বোঝা চাপানো না হলে তাদের গদি নিরাপদ নয় বলেই তারা মনে করেন।

দিল্লির জিয়া-বিরোধিতা

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার একাধিক সাক্ষাৎকার ও একটি দীর্ঘ একান্ত আলাপচারিতা হয়েছে। তাকে আমি সত্যিকারের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাশীল বলে মনে করতাম। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। আমার সহকর্মী স্যার মার্ক টালি তো বলেছিলেন, সেনাবাহিনীকে ভালোবাসতেন বলেই তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বেসামরিক ক্ষেত্রে তার অবদান আরো ব্যাপক। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন দেশের অর্থনীতি তখন বিধ্বস্ত। রক্ষীবাহিনী আওয়ামী লীগের ৪০ হাজার বিরোধীকে হত্যা করেছিল। চুয়াত্তরের মন্বন্তরে ৭০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। শেখ মুজিব চতুর্থ সংশোধনী জারি করে গণতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করেছিলেন। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল তিনি নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। সরকারি মালিকানাধীন চারটি বাদে অন্য সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

জেনারেল জিয়া এই শতমুখী নৈরাজ্যের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। অবাধে পত্রপত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে আবার বৈধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষিত বেকারদের গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত রাখার জন্য তিনি খাল খনন ও নদী সংস্কারকাজ শুরু করেন। মেধাবী ছাত্রদের বার্ষিক সমুদ্র ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়ে তিনি তাদের অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য ১৯ দফা কর্মসূচি চালু করেছিলেন তিনি। জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তির নামে সামাজিক উত্তেজনা জিইয়ে রেখে শুধু দেশের ভবিষ্যতেরই সর্বনাশ করা হচ্ছে। সে অবস্থার প্রতিকারের জন্যই তিনি সমাজের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন।

শহীদ জিয়াকে আমৃত্যু দিল্লির প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সহযোগিতামূলক উন্নয়নের লক্ষ্যে সার্ক গঠন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টির প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ ব্যাপারেও তিনি পদে পদে দিল্লির কাছ থেকে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। ভারত সরকার তখন মনে করেছিল, জিয়াউর রহমান সার্কের মাধ্যমে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল প্রভৃতি ছোটখাটো প্রতিবেশী দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে ভারতের বিরুদ্ধে একটা জোট গঠনের চেষ্টা করছিলেন। সার্ক সম্বন্ধে বর্তমান ভারত সরকার ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহ অদৃষ্টের পরিহাস বলেই মনে হয়।

এমনকি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের সব চেষ্টাকে দিল্লি অগ্রাহ্য করেছে। শেষে আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাককে দিল্লি পাঠিয়ে জিয়া তাদের দেশে ফেরত আনেন। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে জিয়া কি অজান্তে নিজের মৃত্যুকেও আমন্ত্রণ করেছিলেন? এখন অনেকেই বিশ্বাস করেন যে মুজিব হত্যার পেছনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ভূমিকা ছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে দিল্লির অনুপ্রেরণা ছিল বলেই অনেকের ধারণা। জিয়াউর রহমানের হত্যা রহস্য ইতিহাস ভবিষ্যতে উদঘাটন করবে। কিন্তু কতগুলো সত্য অনেকেরই জানা আছে। ভারতের মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময় ‘র’-এর কোনো কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাপ্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সখ্য গড়ে উঠেছিল। জিয়া হত্যার মাত্র ১৩ দিন আগে শেখ হাসিনা ভারত থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন।

লেখক: প্রখ্যাত সাংবাদিক, বিবিসি বাংলার সাবেক উপপ্রধান

যে শিখা জ্বলে উঠেছিল ৭ নভেম্বর

দম বন্ধ হওয়ার মতো সেই ৭২ ঘণ্টা

৭ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে বর্ষা বিপ্লব

নিউ ইয়র্কের প্রতিধ্বনি বাংলাদেশের নির্বাচনে!

জেনারেল মঞ্জুরকে যেভাবে গুলিতে হত্যা করা হয়

নির্বাচনি মিত্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী

ম্যালকম এক্স থেকে মামদানি

জিয়া হত্যা ছিল গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল

৭ নভেম্বর বনাম হালের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি

মোদির ভারতে অর্থ ও পেশিশক্তির গণতন্ত্র