সতেরো বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লাখ লাখ মানুষের উপচানো ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। ভিন্নমাত্রিক প্রত্যাবর্তন আর স্মরণকালের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে সাড়া জাগিয়েছেন। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে শীর্ষ সংবাদই শুধু হননি, রাজনীতির সদরে-অন্দরে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে জায়গা করে নিয়েছেন। স্বদেশের মাটিতে পা রেখে প্রথম যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখতে হচ্ছে বিশ্লেষকদের। ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল, ফর দ্য কান্ট্রি’, কিংবা ‘আই’-এর স্থলে ‘উই’ বসিয়ে যে দৃপ্ত উচ্চারণ করেছেন, তা দেশের মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে সমস্যাসংকুল একটি দেশে প্রত্যাশা তৈরি করা যত সহজ, তা বাস্তবায়ন যে ততই কঠিন সে বিষয়টিও অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রশ্নে বহু চ্যালেঞ্জ ও কণ্টকাকীর্ণ পথ যে সামনে রয়েছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তারেক রহমান মার্টিন লুথারের ভাষায় দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য তার প্ল্যানের (পরিকল্পনার) কথা জানানোর পাশাপাশি বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন। কিন্তু তার সেই পরিকল্পনা কী, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। তার ঘনিষ্ঠদের কাছে এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা জানার চেষ্টা করছেন। তারা বলছেন, এর আগে ঘোষিত ৩১ দফার সংস্কার পরিকল্পনা তো সবার জানাই আছে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে তার পরিকল্পনার লক্ষ্য রাষ্ট্র পরিচালনায় কাঠামোগত সংস্কার, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং জনজীবনের মৌলিক সংকট মোকাবিলা। নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় একাধিক অনুষ্ঠানে এরই মধ্যে তারেক রহমান জনকল্যাণকেন্দ্রিক আট দফা পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে। এই পরিকল্পনায় সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করে স্বল্প ও বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, কৃষকদের জন্য কৃষি কার্ড প্রবর্তনের মাধ্যমে সার-বীজ-সহায়তা সহজ করা এবং ন্যায্যমূল্যে ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এসব দফা শুধু নির্বাচনি অঙ্গীকার নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। নির্বাচনি মাঠে তারেক রহমানের এই পরিকল্পনা তারা ভোটারদের কাছে তুলে ধরবেন।
তারেক রহমানের বক্তব্যের চুম্বক অংশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তিনি ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার বদলে সম্মিলিত প্রয়াসের কথা বলেছেন। তিনি দেশ পরিচালনাকে একক নেতৃত্বের বিষয় হিসেবে না দেখে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই পরিবর্তনের কথা বলছেন। এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অবশ্য ইতিবাচক। রাজনৈতিক নেতৃত্বের বক্তব্যে সাধারণত আবেগ থাকে। সস্তা বাহবা নেওয়ার প্রবণতা থাকে। তারেক রহমানের বক্তব্যে আবেগের চেয়ে বাস্তবতা প্রাধান্য পেয়েছে। অনুপ্রেরণা অগ্রাধিকারে ছিল। জাতীয় নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। সবারই প্রত্যাশা—শিগগিরই তারেক রহমান তার লক্ষাভিসারী পরিকল্পনা, বাস্তবায়নের সময়সীমা, ফলাফল প্রভৃতি বিষয়ে সবিস্তারে খোলাসা করবেন এবং অর্থনৈতিক কাঠামো বা বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে বিশদভাবে জানাবেন।
তারেক রহমানের বক্তব্যে হোমওয়ার্কের ছাপ ছিল। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা মাথায় রেখেছেন বলে মনে হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশার বিষয়টি উপেক্ষা করেননি। বিশেষ করে জনআকাঙ্ক্ষার শীর্ষে থাকা জননিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্বারোপ বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্ম-বর্ণ-রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরিচায়ক।
প্রসঙ্গত, স্মরণ করা যেতে পারে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সিপাহি-জনতার মিলিত বিপ্লবে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুভার পেয়ে প্রথম দিকে যে বক্তব্যগুলো দিয়েছেন, তার সঙ্গে তারেক রহমানের বৃহস্পতিবারের বক্তব্যে অনেকখানি মিল রয়েছে। জিয়াউর রহমান দায়িত্ব নিয়েই দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে সমস্যাজর্জরিত অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য তার পরিকল্পনার কথা জানান দেন এবং তার উন্নয়নদর্শন দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস নেন। শহীদ জিয়া মনে করতেন, ছোট্ট দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে কাজের দিকে নিয়ে যেতে হবে। শহর থেকে গ্রাম—প্রতিটি মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলতে হবে। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল, উত্তরসূরি হিসেবে তারেক রহমানের মধ্যেও তা দেখতে আগ্রহী প্রায় ২০ কোটি মানুষ।
এখন কথা হচ্ছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামনে আসা চ্যালেঞ্জ ও সংকট মোকাবিলায় তারেক রহমান বা বিএনপি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দেখানো পথেই হাঁটবে, নাকি নতুন কোনো পথে, তা দেখা যাবে আগামী দিনে। জিয়ার অনুসৃত রাজনীতিকে পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করাই যে মঙ্গলজনক হবে, তা দেখতে প্রত্যাশী দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী মানুষ। শহীদ জিয়া জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, তাদের ভাগ্যোন্নয়ন এবং দেশের সুখী-সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়েছিলেন। বিদ্বেষ-বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্য ও সংহতির রাজনীতি এগিয়ে নিয়েছিলেন। ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে দেশকে এগিয়ে নিতে জনগণকে যে এক বিরাট শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
গত দেড় যুগের অপশাসনে জিয়াউর রহমানকে মুছে ফেলার কম চেষ্টা হয়নি। কিন্তু প্রমাণিত হয়েছে, যিনি গণমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন, ইতিহাসের পাতা থেকে চাইলেই তাকে মুছে ফেলা যায় না। তার জীবনকালের ব্যাপ্তি তুলনামূলকভাবে স্বল্প, মাত্র ৪৫ বছর। জীবনের শেষ দশকে কয়েকটি বছর তিনি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তার সংক্ষিপ্ত জীবনের সংক্ষিপ্ততর অধ্যায় দেশবাসীর সামনে রাষ্ট্রনায়কোচিত যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিলেন, রাজনীতির যে আদর্শ তিনি উপস্থিত করেছিলেন, তা-ই এদেশের ইতিহাসে তাকে স্থায়ী আসন তৈরি করে দিয়েছে। মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ হতে পারে—কী ছিল তার রাজনীতি? প্রতিটি সংকটকালে জিয়াউর রহমান ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল—এই ১০ বছরের ঘটনাপঞ্জি সামনে রাখলে দেখা যাবে, তার ভাবমূর্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ধ্যানধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বেতার থেকে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেশবাসী আজও বিস্মৃত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক এই দেশকে দিতে চেয়েছিলেন তার সত্তার পরিচয়; দিতে চেয়েছিলেন আত্মপরিচয়, সাহস আর শ্রমের অনুপ্রেরণা।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তিনি দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের জন্য আত্মোৎসর্গ করে গেছেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অনমনীয় প্রয়াস সুস্পষ্টভাবে উৎকীর্ণ। বাংলাদেশকে তিনি জগৎ সভায় পরিচিত করে তুলেছিলেন। দারিদ্র্যপীড়িত এই ছোট দেশটিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি-কূটনীতির ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছিলেন পাদপ্রদীপের আলোয়।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, রীতিনীতি, ব্যবস্থা ও মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। তিনি জনকল্যাণের রাজনীতির মূল সুরটি ধরতে পেরেছিলেন। বিদ্রোহ আর বিপ্লবের এই দেশে স্বৈরশাসন যে জনগণ কোনোমতেই মেনে নেবে না, মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়া তা ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন। এ কারণে তিনি সাহসের সঙ্গে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি বিদেশি ভাবধারার অন্ধ অনুকরণেরও ঘোরবিরোধী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বামও নই, দক্ষিণও নই। আমরা বাংলাদেশি।’ এদেশের রাজনীতিতে স্বাধীন জাতীয় বিকাশের তাগিদ তার কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়েছিল এবং তার রাজনীতি সেই কারণে জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক ও ইসলামি মূল্যবোধের ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, শোষিত-বঞ্চিত গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তিনি উন্নয়নের মূল প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের খুব কম থানাই আছে, যেখানে তিনি যাননি। গ্রামের মেঠো পথ ধরে তিনি হেঁটেছেন, নিজের চোখে মেখেছেন দারিদ্র্যক্লিষ্ট নিম্নবিত্ত মানুষের নিদারুণ কষ্টের রূপ। তার আগে শহুরে রাজনীতির আলোঝলমল অঙ্গন ছেড়ে আর কোনো রাজনীতিবিদ এমন সহজে গ্রামের মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। ঘুমন্ত গ্রামগুলোকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন। মূলত তার কারণেই গ্রামকে উপেক্ষা করে দেশে আর কারও পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব হয়নি, এখনো হচ্ছে না। যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে পিতা জিয়াউর রহমানকে ধারণ করে তারেক রহমানই পারেন সে কাজটি করতে।
জিয়াউর রহমান জানতেন, বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন, এদেশে প্রচুর সম্পদ আছে। আমরা যদি পরিশ্রম করি, তাহলে আমরা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারব। রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলেই তলাহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচেছিল। গ্রামে গ্রামে সেচের জন্য তিনি খাল খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিলেন। দ্বিগুণ ফসল উৎপাদনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলেন জনসাধারণের প্রতি। তার আমলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ও সম্প্রসারিত হয়। ঢাকাসহ সব শহর-নগরে লাগে উন্নয়নের স্পর্শ। রাজধানী ঢাকা নগরী তার সময়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপ্তি ও সৌন্দর্য লাভ করে। জাতি গঠনের জন্য তার এই সার্বিক প্রয়াস গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচায়ক। এই রাজনীতিকে তিনি বলতেন উৎপাদন ও নির্মাণের রাজনীতি। এর মাধ্যমে তিনি জাতিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করতে চেয়েছিলেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছিলেন দেশে। তার রাজনৈতিক সহনশীলতা বিরোধী শিবিরেও প্রশংসিত ছিল। জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দল-মতের মানুষকে ডাক দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন জাতীয় ক্ষেত্রে ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। বহুসংখ্যক রাজনৈতিক দল, বিরোধী সংবাদপত্র ও সংগঠন করার সুযোগ অবারিত করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তার প্রগাঢ় আস্থাই প্রমাণ করে। ব্যক্তিগতভাবে ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন সব দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। তিনি জানতেন, আমাদের সমাজে দুর্নীতি আছে এবং কম-বেশি থাকবেও। তা সত্ত্বেও নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্নীতি উচ্ছেদের জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। নিজের রাজনৈতিক দলকেও তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে স্থান দেননি। আত্মীয়-স্বজন ও তোষামোদকারীদের কাছে ঘেঁষতে দেননি।
রাষ্ট্রপতি জিয়া বাংলাদেশে একটা আধুনিক সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন। শিক্ষাবিস্তার, নারীজাগরণ, সাংস্কৃতিক উজ্জীবন এবং যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই বদ্ধ সমাজে আধুনিকতার স্পর্শ ও গতি সঞ্চার করতে চেয়েছেন। যুগ যুগ ধরে অবহেলিত নারীসমাজকে তিনি ডেকে এনেছিলেন কাজের ক্ষেত্রে। নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে তিনি ব্যাপক অভিযান শুরু করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘শিক্ষা ছাড়া এদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়।’
দারিদ্র্যপীড়িত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের বিড়ম্বনার কথাগুলো সবারই জানা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা এবং সাধ্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত থাকে। বাইরের চাপ, ভেতরের সীমাবদ্ধতা—সবকিছুর আবর্তে পড়ে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো আজও দারিদ্র্যমুক্তির পথ খুঁজে মরছে। এই পরিচিত বাধার মুখোমুখি দাঁড়িয়েই বাংলাদেশের সমাজকে আধুনিক, গতিশীল ও সমৃদ্ধ করে তুলতে নিরালস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। এই সৎ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে তার উল্লেখযোগ্য সাফল্যই তাকে জনসাধারণের কাছে হিমালয়সম জনপ্রিয়তায় আসীন করেছিল।
কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম তারেক রহমানকে বাংলার মার্টিন লুথার কিং হিসেবে বর্ণনা করে সংবাদ ও সংবাদ-ভাষ্য রচনা করেছে। জগতের সফল রাষ্ট্রনায়ক, নেতা ও সংস্কারকদের ভালো বিষয়গুলো গ্রহণ বা তাদের অনুসরণ দূষণীয় নয়। তবে তারেক রহমানকে নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার জন্য সুদূর পশ্চিমা দেশে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তার পিতা বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের আদর্শই ৫৪ বছরের ইতিহাসে সেরা। এমন নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক পাওয়ার জন্য গোটা বিশ্বই তৃষ্ণার্ত থাকে। জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রদর্শন গ্রহণ ও অনুসরণ করলেই তারেক রহমান ‘আরেক জিয়া’ হয়ে উঠতে পারবেন; লুথার কিং না হলেও চলবে।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনে বিএনপির ভেতরে নতুন করে যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, তা কতটা টেকসই হবে, সেটা নির্ভর করবে দলীয় নেতাকর্মীরা নেতার বার্তা কতটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন তার ওপর। চব্বিশের ৫ আগস্টের পর নির্বাসিত জীবনে থেকে তারেক রহমান বারবার নেতাকর্মীদের সতর্ক করছেন। আসন্ন নির্বাচন যে অতটা সহজ হবে না, সেটাও দফায় দফায় উচ্চারণ করেছেন। নেতা-কর্মীদের মধ্যে সহনশীলতা, সততা, আদর্শিক দৃঢ়তা এবং শহীদ জিয়ার কালজয়ী রাজনীতিকে ধারণ ও অনুসরণের মানসিকতা জাগ্রত করা জরুরি। সেটা করতে পারলেই তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটবে। মাঠপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সক্রিয়তা বেড়েছে, সঙ্গে থাকতে হবে পরমতসহিষ্ণুতা। নেতার সশরীর উপস্থিতি ভোটের প্রচারে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করবে, একই সঙ্গে আওয়ামী ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের উপযোগী আচার-আচরণও দেখতে চাইবে মানুষ।
রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের যে বার্তা তারেক রহমান দিতে চেয়েছেন, তার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করবেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বোদ্ধারা। আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা কেমন রাজনীতি দেখতে চায়, তা অনুধাবন করা খুবই জরুরি। মানুষ এখন অনেক সচেতন। অন্ধ আনুগত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। সেদিকে সজাগ থেকে সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে। তবেই সাফল্য ধরা দেবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক