ঠিক ১৫ বছর আগে তিউনিসিয়ায় মোহাম্মদ বাউয়াজিজির আত্মাহুতি পুরো আরব বিশ্বে এক বিশাল বিক্ষোভ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। এই আন্দোলনে বোঝা গেছে, আরব বিশ্ব কতটা গভীরভাবে গণতন্ত্র কামনা করে।
বহু বছর ধরে আরব বিশ্বের বেশ কিছু দেশে যেসব নেতা শাসন করে আসছিল, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বহু মিলিয়ন মানুষ। নিপীড়ন, দুর্নীতি আর বৈষম্যের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল তারা।
গুটিকয়েক মানুষের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতা নিয়ে তারা অভিযোগ তুলেছিল। এ কারণেই দুর্নীতি আর অন্যায় জন্ম নিয়েছিল। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে পুঞ্জীভূত ছিল সম্পদ। যেটা ঘটেছিল সেটাকে কেবল বিক্ষোভ বললে ভুল হবে। এটা ছিল মর্যাদা, দায়বদ্ধতা এবং গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য সংগ্রাম।
স্বাভাবিকভাবেই শাসকেরা বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রবল শক্তি প্রয়োগ করেছিল। বহু বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে। তাদের জেলে পাঠানো হয়েছে; কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য যে আন্দোলন, সেটাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে।
অল্প সময়ের মধ্যে চার পুরোনো স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। তারা হলেন তিউনিসিয়ার জাইন আল আবিদিন বেন আলি, মিসরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি, আর ইয়েমেনের আলি আবদুল্লাহ সালেহ।
বাহরাইন, আলজেরিয়া ও ইরাকের মতো দেশগুলোয় শাসকেরা বিক্ষোভকারীদের দ্রুত দমন করেছেন। আন্দোলন বড় আকার নেওয়ার আগেই তারা সেগুলো শেষ করে দিয়েছেন।
অন্যান্য জায়গায় বিক্ষোভের মাধ্যমে ছোট ছোট পরিবর্তন এসেছে। অথবা সিরিয়ার মতো দেশ দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে। দ্রুত কোনো পরিবর্তন সেখানে আসেনি।
সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশগুলোয় বিক্ষোভ বড় লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।
মিসর আর তিউনিসিয়া ছিল দুটি মাত্র দেশ, যেখানে প্রথম দিকে দীর্ঘমেয়াদি বড় পরিবর্তন এসেছিল। দুটো দেশেই স্বৈরশাসকের দ্রুত পতন হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তারা গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়েছিল।
যদিও ফলাফল সব জায়গায় এক রকম ছিল না, তবু আরব বসন্তকে বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবেই দেখেছে আরব বিশ্বের জনগণ। এই অঞ্চলে নিপীড়নের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ১৫ বছর পরে এসে সেটা আরো স্পষ্ট হয়েছে। মানুষের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আরো শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এই সময়টাতে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোও শিখেছে কীভাবে জনতার অভ্যুত্থানকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়া যায়।
মিসর আর তিউনিসিয়ার ঘটনাপ্রবাহ
মিসর আর তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের শুরুটা ভালোই মনে হয়েছিল। বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলে পার্লামেন্ট গঠন করেছিল। নতুন সংবিধান লিখেছিল। নতুন দল আর মিডিয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল। নতুন নেতা নির্বাচন হয়েছিল।
দুই দেশেই মুসলিম ব্রাদারহুডের দ্রুত বিস্তার ঘটেছিল। এই অঞ্চলে ব্রাদারহুডের কর্মকাণ্ড যথেষ্ট সংগঠিত। ইসলামপন্থিদের উত্থানকে অনেকে স্বাভাবিক ও ইতিবাচক মনে করেছে। অন্যেরা এটাকে দেখেছে সমস্যা হিসেবে। রাজনৈতিক ইসলামের বিষয়টি বাদ দিলেও মিসর আর তিউনিসিয়াকে ইতিবাচক উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। এই দেশ দুটি দেখিয়েছে, আরবদের জন্য স্বৈরশাসন চিরদিনের পরিণতি হতে পারে না।
এই দেশ দুটির পরিবর্তনের মধ্যে অনেক সমস্যা ছিল, সংকট ছিল; কিন্তু দুই দেশই দেখিয়েছে, আরব সমাজ গণতন্ত্র নির্মাণ করতে পারে। সেটা হয়তো শুরুতেই সবদিক থেকে আদর্শ ছিল না। তবু চেষ্টা ছিল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মিসর আর তিউনিসিয়া দেখিয়েছে, আরবরা গণতন্ত্র চায়। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল যথেষ্ট বেশি। কিছু পুরোনো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের মতোই ছিল উপস্থিতির হার। কিন্তু বাইরের চেহারা আর সংখ্যার আড়ালে সত্যটা লুকানো ছিল। বিশেষ করে মিসরে। মুসলিম ব্রাদারহুডের দল নির্বাচনে জিতেছে, প্রেসিডেন্ট পদেও জিতেছে; কিন্তু সত্যিকারের ক্ষমতা তাদের হাতে আসেনি।
মিসরের ডিপ স্টেট আগের মতোই শক্তিশালী ছিল। এই ডিপ স্টেটের মধ্যে রয়েছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, বিচার বিভাগ আর মিডিয়া। পুরোনো সরকার দুটো পার্লামেন্ট নির্বাচন আটকে দিয়েছে। এরপর ২০১৩ সালের গ্রীষ্মে ইসলামবিদ্বেষী উদারপন্থিদের সঙ্গে মিলে কাজ করেছে তারা। উভয়ে মিলে তারা মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে দেয়।
২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থান গণতন্ত্রকে পুরোপুরি সরিয়ে দেয়। পুরোনো ব্যবস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনে। অনেকে বর্তমান স্বৈরাচারকে আগের স্বৈরশাসকের চেয়েও খারাপ মনে করেন। আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি ছিলেন মুরসির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। কিন্তু দ্রুত তিনি ক্ষমতা দখল করেন। গণহত্যা ও গণগ্রেপ্তারে নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। মিডিয়া বন্ধ করে দেন। এরপর ভুয়া নির্বাচন সাজানো হয়। আইন বদলে ফেলা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সিসির শাসনব্যবস্থা হোসনি মোবারকের চেয়েও কঠোর।
তিউনিসিয়ার গণতন্ত্র আরেকটু দীর্ঘ হয়েছিল, কিন্তু সেটাও শেষ পর্যন্ত টেকেনি। ২০১৪ সালে তিউনিসিয়া নতুন সংবিধান গ্রহণ করে। তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বেজি সাইদ এসেবসিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। কিন্তু ২০১৯ সালে কাইস সেইয়েদ জিতে যান এবং এই প্রক্রিয়ার ইতি টানেন।
২০২১ সালের জুলাইয়ে দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর সাইয়েদ জরুরি ক্ষমতা দখল করেন। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। পার্লামেন্ট স্থগিত করেন। এর পর থেকে সাইয়েদ তার ক্ষমতা বাড়িয়েই গেছেন।
যে শিক্ষা পাওয়া গেছে
২০১০-১১ সালের বিক্ষোভ আন্দোলন থেকে মিসর আর তিউনিসিয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছে। সেটা হলো তাদের শাসকরা আসলে সে রকম কঠোর ছিলেন না। দুই দেশেই প্রায় ১৫ বছর আগে জনতার অসহযোগ আন্দোলন দমনের জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়েছিল। এখন কোনো বিক্ষোভ আর বিরোধিতারই অনুমতি নেই।
মিসরে ২০১৩ সালের এক আইনে বিক্ষোভ আন্দোলন নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৫ সালে তথাকথিত সন্ত্রাস আইন করা হয়েছে। এই আইনে ‘ঐক্য নষ্টের চেষ্টা’ হলে সেক্ষেত্রে কিংবা সন্ত্রাস দমনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
২০১৩ সালের পর মিসরের সামরিক সরকার নির্বাচন করার চেষ্টা করেছে। ভুয়া ভোট নেওয়া হয়েছে। এমন আইন করা হয়েছে, যেখানে পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্টের অনুগত থাকবে। সংবিধান বদলানো হয়েছে, যাতে সিসি ২০৩০ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারেন। যদি বিরোধিতা আসে, তাহলে সিসি তাদের গ্রেপ্তার করে নির্বাসনে পাঠাতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তিউনিসিয়ার সাইয়েদও সিসিকে অনুকরণ করছেন। যদিও সাইয়েদ এখনো সিসির মতো নিপীড়ক হয়ে ওঠেননি, তবে সংবিধান নতুন করে লিখেছেন তিনি। প্রেসিডেন্টকে সেখানে আরো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তার সামনের বাধা দূর করা হয়েছে। বারতেলসমান ট্রান্সফরমেশান সূচকে দেখা গেছে, তিউনিসিয়া অনেক বিষয়ে আরব বসন্তের আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
শাসনব্যবস্থায় ফাটল
পনেরো বছর পরে সেই সমস্যার সবই রয়ে গেছে, যেগুলোর কারণে বিক্ষোভ হয়েছিল। দুর্নীতি, অন্যায় ও অর্থনৈতিক সমস্যা সবই রয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা আরো বেড়েছে।
দুর্নীতির ধারণা সূচকে আরব দেশগুলোর স্কোর বেশ কম। অনেকের অবস্থান তলানির দিকে। বৈষম্যের মাত্রা এখনো অনেক ওপরে। ফ্রিডম হাউস সম্প্রতি ২১টি আরব দেশের রেটিং দিয়েছে। কেউই সেখানে ‘মুক্ত’ দেশের স্বীকৃতি পায়নি। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল- এর সূচকে ২০২৫ সালে ৯টি আরব দেশকে তালিকাভুক্ত করা হয়। বেশির ভাগই রয়েছে তালিকার তলানির দিকে।
উপসাগরীয় দেশগুলো ছাড়া আরব অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই অর্থনৈতিক সমস্যা চলছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, উপসাগরীয় দেশগুলোর বাইরে অন্য আরব দেশগুলোর মাথাপিছু জিডিপির হার রয়েছে নিচের দিকে। জাতিসংঘ এমনকি এটাও জানিয়েছে, এই দেশগুলোয় খাবার সংকট ও ক্ষুধা নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে।
মিসর আর তিউনিসিয়া এই অঞ্চলের সমস্যাগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে তুলে ধরেছে। ২০১১ সাল থেকে মিসরে সামরিক অর্থনীতির আকার বেড়ে গেছে। অসাম্য বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি আর দারিদ্র্য বেড়েছে।
তিউনিসিয়ার অর্থনীতিরও অবনতি হয়েছে। কার্নেগি এনডাউমেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইয়েদ যে কৌশল নিয়েছেন, তাতে ঋণের হার বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেতন কমে গেছে। কর্মসংস্থানও কমে গেছে।
গণতন্ত্র : এক অস্বস্তিকর সত্যি
শাসকদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ হলো জনগণ এখনো প্রবলভাবে গণতন্ত্র চায়। অ্যারাব ওপিনিয়ন ইনডেক্সে বলা হয়েছে, ৭০ শতাংশ আরব গণতন্ত্র চায়। মাত্র ১৯ শতাংশ বলেছে, তারা গণতন্ত্র চায় না। গণতন্ত্রের ইস্যুতে নিজেদের দেশকে খুব কম নম্বর দিয়েছে জনগণ। গণতন্ত্রকে তারা স্বাধীনতা, সমতা আর ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে। আরব বসন্তকে তারা পছন্দ করে। অ্যারাব ব্যারোমিটারের জরিপেও একই চিত্র উঠে এসেছে।
শেষ হয়নি আরব বসন্ত
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল আসাদের পতন হয়। নির্বাসনে পালিয়ে যান তিনি। আরব বসন্তের ১৪ বছর পরে এসে এই ঘণ্টা ঘটল। বড় এই ঘটনাটি বিশ্লেষকদের মনে করিয়ে দিয়েছে, আরব বসন্ত আসলে মরে যায়নি।
মরক্কোতে সম্প্রতি জেন-জিদের যে বিক্ষোভ হয়েছে, সেখানেও বিষয়টি বোঝা গেছে। বহু আরব, বিশেষ করে তরুণরা, পরিবর্তনের জন্য লড়তে প্রস্তুত।
নতুন বিক্ষোভের জন্য হয়তো শিগগিরই সময় ঘনিয়ে আসছে। আরব সরকারগুলো বিপদটা জানে। এর উদাহরণ মিসরের সিসি। সিসি মিসরীয়দের সতর্ক করেছেন, যাতে তারা ঘনঘন বিক্ষোভ না করে। বেশ কিছু বছর আগে তিনি বলেছিলেন, ২০১১ সালকে আর পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া হবে না। আতঙ্কটা সত্যি। সে কারণে মিসরের ডিপ স্টেট রাজনীতি বন্ধ করে রেখেছে।
সম্প্রতি সরকার নির্বাচনে কারচুপির মাত্রা আরো বাড়িয়েছে। সিসিকে প্রায় চিরকালের জন্য ক্ষমতায় রাখার পাঁয়তারা চলছে। ঘরের ভেতরের বিরোধিতা নিয়ে অখুশি মিসর এখন দেশের বাইরেও নজর রাখছে। বাইরের সরকারবিরোধী মিডিয়াগুলো তারা বন্ধ করে দিয়েছে। বিদেশে থাকা সরকারবিরোধীদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। তরুণ মিসরীয় আনাস হাবিব দ্য হেগের দূতাবাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেছিলেন। মিসরের মন্ত্রী স্টাফদের বলেছেন বিক্ষোভকারীদের আটক করতে, গ্রেপ্তার করতে। প্রতিশোধ হিসেবে হাবিবের বয়োবৃদ্ধ চাচাকে মিসরে গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ।
মিসর ছাড়াও আরব রাষ্ট্রগুলো তাদের নিরাপত্তা তৎপরতা বাড়িয়েছে। যেসব ব্যক্তিকে তারা চিহ্নিত করেছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এই কঠোর পদক্ষেপগুলো আতঙ্ক তৈরি করেছে। সরকারগুলো এটাকে আরব বসন্তের বিরতি হিসেবে দেখছে, শেষ হিসেবে নয়।
ইতিহাস দেখিয়েছে, আন্দোলন কোনো ধরনের আগাম বার্তা না দিয়েই শুরু হয়ে যায়। শেষ কথাটা জনগণই বলে। কখন তারা সেটা বলবে, সেজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আল জাজিরা অবলম্বনে জুলফিকার হায়দার