প্রাচীনকাল থেকে গরু মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ । কিন্তু আধুনিক ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে এই চারপেয় পশুকে নিয়ে ধর্মীয় পবিত্রতার যে ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে, তা কি শাস্ত্রের নির্দেশ, নাকি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশল—এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের হিন্দু ধর্মের শাস্ত্র, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং আধুনিক ভারতের জটিল রাজনীতির গলিপথ ঘুরে আসতে হবে।
প্রাচীন বৈদিক সমাজে গরু ছিল অর্থনৈতিক সম্পদের প্রতীক। গরুর সুস্বাদু মাংস ও দুধ শ্রমনির্ভর জীবনযাত্রার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পরিচিত ছিল। ঋগ্বেদে গরু নিয়ে একাধিক শ্লোক রয়েছে, যেখানে গোমাংস ভক্ষণ এবং গরু বলির উল্লেখ পাওয়া যায়। ভাষ্যকার সায়নাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন, দেবতা ইন্দ্রের উদ্দেশে ‘পনেরো-বিশটি ষাঁড় রান্না’ করা হতো। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও গরু বলি ও মাংস ভক্ষণের বিবরণ রয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ তার ‘কমপ্লিট ওয়ার্ক’ নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন, বৈদিক যুগে গোমাংস ভক্ষণ ব্রাহ্মণদের মধ্যে স্বাভাবিক ছিল, এমনকি অতিথি আপ্যায়নের জন্য শ্রেষ্ঠ ষাঁড় জবাই করা হতো। ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা তার ‘দ্য মিথ অব দ্য হোলি কাউ’ বইয়ে দেখিয়েছেন, বৈদিক যুগে গরু পবিত্র মাতৃত্বের প্রতীক ছিল না। সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের গবেষণাও এই তথ্য সমর্থন করে।
তা হলে কখন এবং কেন গরু ‘গোমাতা’ হয়ে উঠল? ঋগ্বেদে ‘আঘ্ন্যা’ শব্দটি দুধদানকারী গাভির জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ—‘যাকে হত্যা করা উচিত নয়।’ কিন্তু এটি সব গরুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অহিংসা দর্শন এবং কৃষিভিত্তিক সমাজে গরুর উপযোগিতা ধীরে ধীরে পবিত্রতার ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলে। মোহনদাস করমচাঁদ মহাত্মা গান্ধী তার ইয়ং ইন্ডিয়া (১৯২১) পত্রিকায় স্বীকার করেছেন, বেদে গরু উৎসর্গের কথা উল্লেখ থাকলেও পবিত্রতার ধারণা শাস্ত্রীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফল।
আধুনিক ভারতে গো-রক্ষা আন্দোলন ধর্মীয় আবেগের আড়ালে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়ে একটি ভয়াবহ সামাজিক সংকটে রূপ নিয়েছে। এই আন্দোলনের একটি বিস্ময়কর দিক হলো, কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গরুর মল ও মূত্রকে পবিত্র এবং ঔষধি হিসেবে গ্রহণের প্রচলন, যেমন গোমূত্র থেরাপি বা পঞ্চগব্য, যা আয়ুর্বেদের নামে প্রচারিত হয়। অথচ একই সময়ে গরুর সুস্বাদু মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকা হয়, যা বৈদিক যুগে সাধারণ বিষয় ছিল। এই বৈপরীত্য শুধু ধর্মীয় আবেগের অসংগতিই প্রকাশ করে না, বরং গো-রক্ষার নামে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক নীতির জটিলতাকেও তুলে ধরে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং মার্কিন কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২০ সালে ভারত বিশ্বের শীর্ষ গোমাংস রপ্তানিকারক ছিল। ২০১২ সালে ভারত ৩৬ লাখ টন গোমাংস উৎপাদন করে, যার মধ্যে ১৬ লাখ টন রপ্তানি হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস (২০১৯) জানিয়েছে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোই এই উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। একদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মা গরুর পবিত্রতা প্রচার এবং গরুর মল-মূত্রের ব্যবহারে উৎসাহিত করা, অন্যদিকে গোমাংস রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন! এই দ্বৈত নীতি একটি সুপরিকল্পিত নোংরা রাজনৈতিক কৌশল। যারা গরু রক্ষা ও পবিত্রতার কথা বলেন, তারাই এই ব্যবসার প্রধান লাভভোগী এবং এর সঙ্গে জড়িত।
গো-রক্ষার নামে চালানো আন্দোলন, বিশেষ করে বিজেপি ও আরএসএসের নেতৃত্বে, ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক মুনাফায় রূপান্তর করেছে। দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা এটিকে ‘রাজনৈতিক প্রতারণা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। অমর্ত্য সেন ‘দি আগুমেনটেটিভ ইন্ডিয়ান’ ও রোমিলা থাপার ‘দি পাস্ট অ্যাজ প্রেজেন্ট’ গরুর পবিত্রতাকে আধুনিক হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই আন্দোলন শুধু ধর্মীয় মেরূকরণই ঘটায়নি, বরং একের পর এক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে, যার শিকার প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে—২০১৫ সালে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে মুহাম্মদ আখলাককে গোমাংস রাখার সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা; ২০১৭ সালে রাজস্থানে পেহেলু খানকে গরু পরিবহনের অভিযোগে নৃশংসভাবে হত্যা; ২০১৮ সালে ঝাড়খণ্ডে মুজাফফর খানকে গরু পরিবহনের অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা; ২০২৩ সালে বিহারের চাপড়া জেলায় নাজিব কোরায়শিকে গোমাংস বহনের সন্দেহে হত্যা। এ ছাড়া ২০২৪ সালে উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় গুলফাম নামে এক মুসলিম যুবককে গুলি করে হত্যা করে হিন্দু সন্ত্রাসীরা এবং ২ হাজার ৬০০ মুসলিম হত্যার হুমকি দেয় জঙ্গিরা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (২০১৯) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে গো-রক্ষার নামে অন্তত ৪৪ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৩৬ জন মুসলিম। ইন্ডিয়া স্পেন্ডের (২০১৭) তথ্যে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৬৩টি গো-রক্ষাসংক্রান্ত হামলায় ২৮ জন নিহত হয়, যাদের মধ্যে ২৪ জন মুসলিম এবং ১২৪ জন আহত হয়। বার্তা সংস্থা রয়টার্স (২০১৭) জানায়, এই হামলার ৯৭ শতাংশ ঘটেছে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর। হিন্দুস্তান টাইমস (২০১৭) রিপোর্টে বলা হয়, গো-সংক্রান্ত সহিংসতায় নিহতদের ৮৬ শতাংশ মুসলিম। এই তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট, গো-রক্ষার নামে প্রায় অর্ধশত মুসলিম নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, যা ধর্মীয় মেরূকরণ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
এই সহিংসতার পেছনে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বা প্রশ্রয় স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, পেহেলু খানের মামলায় তার কাছে মাংস সরবরাহ করার বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে (রয়টার্স ২০১৭)। আখলাকের হত্যার পর মাংস ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রথমে মাটন বলা হলেও পরে গোমাংস বলে রিপোর্ট পরিবর্তন করা হয়।
ঋগ্বেদের বৈদিক যুগ থেকে আধুনিক ভারত পর্যন্ত গরুর অবস্থান একটি সাধারণ জীব থেকে ‘গোমাতা’র পবিত্র প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এই রূপান্তর শাস্ত্রীয় সত্যের ওপর নির্ভর করে নয়, বরং এটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যারা গোমাতার পবিত্রতার কথা বলেন, তারা গরুর মলমূত্রকে ঔষধি হিসেবে প্রচার করেন এবং গোমাংস রপ্তানি করে অর্থ উপার্জন করেন! ধর্মীয় আবেগকে উসকে দিয়ে গো-রক্ষা একরকম সুকৌশলী প্রতারণায় পরিণত হয়েছে, যার শিকার নিরপরাধ মুসলিম নাগরিকরা, আর লাভবান সেই হিন্দুত্ববাদী শ্রেণি, যারা শাস্ত্র, ধর্ম আর পণ্য—তিনটিকেই পুঁজিবাদী বুদ্ধিতে ভোগে পরিণত করেছে। এই সহিংসতা বন্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ ও সামাজিক সচেতনতা জরুরি, যাতে ধর্মের নামে এই প্রতারণা ও হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটে।
লেখক : প্রাবন্ধিক