গত ১৩ জুন ভোর রাতে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইলে সেনাবাহিনী ‘আইডিএফ’ এবং গোয়েন্দা বাহিনী ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন প্রদেশে অতর্কিত ভয়াবহ হামলা চালায়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুই দফা হামলায় ইরানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন ও মজুতাগার এবং দুটি পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইরানের যুদ্ধ পরিচালনা প্রক্রিয়া। \
সশস্ত্র বাহিনীপ্রধান এবং বিপ্লবী গার্ড বাহিনীপ্রধানসহ ২০ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডার নিহত হন। ইরান তার প্রাথমিক বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে প্রথমে ২০০ ড্রোন ইসরাইলের দিকে নিক্ষেপ করে এবং ১৪ জুন রাতে ৭৫টি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ব্যাপক হামলা চালায় ইসরাইলে। এতে ইসরাইলেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। এভাবে প্রতিদিনই ইসরাইলের বিমান ও ড্রোন হামলা আর ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছেই।
শাহ-ডাইনেস্টি আমলে ইরান খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল মার্কিন-ইসরাইলের। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর এই বন্ধুত্ব শত্রুতে রূপ নেয়। ইসরাইল রাষ্ট্রটি জন্মের পর থেকেই তিন তিনটি যুদ্ধে আমেরিকার সহযোগিতায় আরব বাহিনীকে পরাজিত করে। সর্বশেষ ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিসরের নেতৃত্বাধীন আরব বাহিনীকে পরাজিত করার পর ইসরাইলের আঞ্চলিক আধিপত্য দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এদিকে আমেরিকা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় এবং আর্থিক সহযোগিতার টোপ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলো পদানত করে ফেলে। সৌদি আরবসহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরাইলের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে ইসরাইল একাই ফিলিস্তিনিদের মোকাবিলা করে তাদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দখল করার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায়। তা ছাড়া গত দেড় বছরে যুদ্ধে ইসরাইল ধ্বংস করেছে হামাস, হিজবুল্লার মতো শক্তিশালী বাহিনীকে। এ অবস্থায় ইরান একমাত্র চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ইসরাইলের জন্য। ইরান বিপ্লবের পর থেকেই তেহরান ও তেল আবিব পরস্পর চিরশত্রুতে পরিণত হয়। এর মধ্যে ২০০৫ সালে ইরানি প্রেসিডেন্ট আহমদ নিজাদ ইসরাইল রাষ্ট্রটিকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার কামনা করেন।
এতে দুই রাষ্ট্রের চিরশত্রুতা মরণপণ শত্রুতায় রূপ নেয়। ইসরাইল মরিয়া হয়ে ওঠে ইরান বা এ অঞ্চলে অন্য কোনো রাষ্ট্রের শক্তিশালী হয়ে ওঠার পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। কৌশল হিসেবে দ্রুত ইসরাইল পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে। সেই সঙ্গে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তি যেন পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে না পারে। ফলে ইরাক পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করলে ১৯৮১ সালে ইসরাইল তা বোমা হামলা করে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে সিরিয়াও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিলে ইসরাইল সেটাও ২০০৭ সালে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়।
ইরান নিজেদের অবস্থান ও হুমকি অনুধাবন করে তিনটি কৌশল হাতে নেয়। প্রথমত, তারা ইসরাইলের চারপাশে বিভিন্ন প্রক্সি বাহিনী সৃষ্টি করে। লেবাননের ‘হিজবুল্লাহ’, ফিলিস্তিনের ‘হামাস’ ইরাকের ‘শিয়া মিলিশিয়া’ এবং ইয়েমেনের ‘হুতি’ গোষ্ঠী। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
এ ছাড়া সিরিয়ার বাসার আল-আসাদের শিয়া সরকার সরাসরি ইরানের সহযোগী শক্তি হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে মনোযোগ দেয়। তারা পারমাণবিক শক্তি অর্জনের প্রয়াস পায়। মার্কিন মদতে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের চাপিয়ে দেওয়া দীর্ঘ যুদ্ধ এবং আমেরিকার আজন্ম-অবরোধ উপেক্ষা করে ইরান দ্রুতই মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সামরিক শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। তারা পারমাণবিক শক্তি অর্জনের দ্বারপ্রান্তে চলে আসে।
মার্কিন-ইসরাইলি গোয়েন্দারা টের পেয়ে যায় এবং বারাক ওবামা প্রশাসন ইরানকে পারমাণবিক চুক্তির আওতায় নিয়ে আসে, যেন ইরানের এই শক্তি অর্জনের প্রক্রিয়ার গতিতে ধীরতা আসে। কিন্তু অস্থির চিত্তের অপরিণামদর্শী ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম পর্বের ক্ষমতায় এসে ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে বের হয়ে আসে। ফলে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প গতি পায় এবং তা অর্জনের খুব কাছাকাছি চলে আসে। এ সময়টিই ছিল ইসরাইলের সবচেয়ে ভয়ংকর সময়।
ইরান আক্রমণের ইসরাইলের স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি উদ্দেশ্যগুলো হলোÑ১. ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া ধ্বংস করা, ২. গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ থেকে বিশ্ব দৃষ্টি সরানো, ৩. নেতানিয়াহুর ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা, ৪. যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান যুদ্ধে জড়িত করা এবং ৫. দীর্ঘ দেড় বছরের যুদ্ধেও ‘হামাস’কে পরাজিত করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকা। অন্যদিকে তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলোÑ১. ইরানের শাসকদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা এবং ২. ইরানকে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু হতে বাধ্য করা।
আসলে ইরান আক্রমণটি যুক্তরাষ্ট্রই ইসরাইলের মাধ্যমে প্রক্সি হিসেবে করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিবৃতি, কথা বা হুমকি ইত্যাদিতে স্পষ্ট বোঝা যায় মার্কিন ইঙ্গিতেই ইসরাইল এই হামলা চালিয়েছে। কারণ এ কথা সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সাহায্য ছাড়া ইসরাইলকে আসলেই ইরান পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে সক্ষম। ইসরাইলের হামলায় ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা ইত্যাদি সবই যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরবরাহ করা। সপ্তাহ দুয়েক আগেই ৩০০ ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্রের চালান গোপনে ইসরাইলে পৌঁছে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এফ-৩৫ বিমান থেকেই এসব ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রথম রাতে ইরানে নিক্ষেপ করেছে। গত ১২ মে ট্রাম্প খামেনিকে চিঠি পাঠিয়ে চুক্তিতে আসার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। অন্যথায় ইসরাইলের হুমলার হুমকি দেওয়া হয়েছিল চিঠিতে। এরপর ১২ জুন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়, ইরান পরমাণু বিস্তার রোধে তার কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আর ১৩ জুন এই ভয়াবহ হামলা করে ইসরাইল। এই আক্রমণের পরপরই ট্রাম্প বিবৃতি দেন, ‘ইরানকে চুক্তিতে সম্মত হতে হবে। অন্যথায় ইরানের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।’
১৫ জুন ওমানের মাস্কাটে ষষ্ঠ দফা ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার দিন ধার্য ছিল। হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান সেটা বাতিল করেছে। মার্কিন সৈন্য সরাসরি জড়িত না থাকলেও ইসরাইলের এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্র নিবিড়ভাবে জড়িত রয়েছে বলে অনুমান করা যায়। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য থাকার অর্থ হলো পৃথিবীর অর্ধেক এনার্জি ও অস্ত্রবাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় থাকা।
ইসরাইল এই আক্রমণের নাম দেয় ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। এই প্রথম আক্রমণ তারা ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ’ আক্রমণ বলে ঘোষণা দিয়েছে। যদিও যুদ্ধের ঘোষণা ছাড়াই ইসরাইল এই যুদ্ধ শুরু করেছে। এই যুদ্ধটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। যে পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
দীর্ঘ ২০ মাসের যুদ্ধে প্রথমে তারা ইরানের প্রক্সি বাহিনীÑহামাস এবং হিজবুল্লাহকে কাবু করে ফেলেছে। সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে ট্রাম্প সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। হুতি গোষ্ঠীর ওপর কিছুদিন ধরে মার্কিনিরা বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। এভাবে একটি দুর্বল সময় সৃষ্টি করা হয়েছে ইরানে আক্রমণ পরিচালনার জন্য। সময় এবং আবহ তৈরির পর ইসরাইল দুই কাঁটাবিশিষ্ট আক্রমণ রচনা করেছে।
বাইরে থেকে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আর ভেতর থেকে মোসাদ এজেন্ট দ্বারা গোয়েন্দা হামলা। ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানের সামরিক এবং পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় আঘাত করেছে। আর ইরানের ভেতর থেকে গোয়েন্দারা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অকেজো করেছে এবং ইরানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের হত্যা করেছে। প্রথম হামলাতেই ইসরাইল ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। এরপর থেকে দফায় দফায় প্রতিদিনই হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরাইলের প্রিঅ্যাম্পটিভ আক্রমণে ইরান কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তবে দ্রুতই তারা সামলে নেয়। মৃত কমান্ডারদের স্থলে নতুনদের দায়িত্ব দেয় এবং পরবর্তী ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ভয়াবহ পাল্টা আক্রমণ রচনা করে। এখানে তাদের রণকৌশল ছিল চমৎকার! প্রথমে তারা ২০০ ড্রোন পাঠায় ইসরাইলের দিকে। এটা ছিল তাদের ডাইভারশনারি অ্যাটাক। ধীরগতিসম্পন্ন এসব ‘শাহেদ’ ড্রোন ইসরাইলের ‘আইরন ডোম’কে আকর্ষণ করে।
ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এসব ড্রোন ধ্বংস করে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ইরান তার শতাধিক সুপারসনিক ব্যালাস্টিক মিসাইল একই সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে নিক্ষেপ করে। ‘আয়রন ডোম’ বিভ্রান্ত হয় এবং তেল আবিব, হাইফা ইত্যাদি ইসরাইলের হৃদয়ভূমিতে ভয়াবহ আঘাত হেনে ইসরাইলের পিলে চমকিয়ে দেয়। নেতানিয়াহুর পালায়ন অথবা লুকিয়ে থাকার খবর বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে! এরপর থেকে ইসরাইলের প্রতিটি হামলার জবাবে ইরান সফলভাবেই পাল্টা সুপারসনিক মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করেছে।
সেনাবাহিনীর আকার এবং স্থলযুদ্ধ সরঞ্জামে ইরান ইসরাইলের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকলেও আধুনিক যুদ্ধের জন্য তা মোটেও ভারসাম্যপূর্ণ নয়। অথচ ‘আকাশ যুদ্ধের’ শক্তিতে ইরান অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাদের ‘আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা’ এবং ‘আকাশ আক্রমণ’ সক্ষমতা অত্যন্ত দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। ইরানের গোয়েন্দা ব্যর্থতা চরমে পৌঁছেছে।
এখন তাদের একই সঙ্গে বাইরের শত্রু এবং ভেতরের মীরজাফরদের বিরুদ্ধে লড়তে হিমশিম খেতে হচ্ছে! দীর্ঘদিন ধরে ইরানের নেতারা গুপ্তহত্যার শিকার হলেও এ বিষয়টি প্রতিহত করার দক্ষতা অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছে। ইরান অতিমাত্রায় ‘প্রক্সি’ বাহিনীর ওপর নির্ভর করেছিল। ফলে মার্কিন-ইসরাইলের কৌশলের কাছে হার মানতে হচ্ছে। এখন এক ‘সুপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্রই ভরসা। কূটনৈতিকভাবে মার্কিন প্রভাবে ইরান আঞ্চলিকভাবে একা। সরকার পরিবর্তনে সিরিয়াও এখন ইরানের হাতছাড়া। পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, তুরস্ক দৃশ্যত পাশে দাঁড়ানোর কথা বললেও তারা কতটুকু এগিয়ে আসবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
ইসরাইলের স্থলবাহিনী তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও তারা ৭৫ বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তারা ‘আকাশ আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা’ শক্তিতে ইরানের তুলনায় অনেক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তাদের গোয়েন্দা ‘মোসাদ’ ও ‘সিনবেথ’ বিশ্বে সবচেয়ে ধূর্ততা এবং নৃশংসতার জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে। মূলত তাদের রাষ্ট্রের জন্মই হয়েছিল এসব গোয়েন্দা সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে। খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে থেকেই তাদের ‘সিকারি’ নামক গুপ্তহত্যা বাহিনী সক্রিয় ছিল।
বর্তমানে ইসরাইলের শক্তির মূল উৎস হলো যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের অন্যান্য শক্তিধর দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি তাদের সহায়ক শক্তি। এমনকি সীমান্তবর্তী মুসলিম দেশ জর্ডানও ইসরাইলের সহায়তাকারী দেশ। অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ইসরাইলের সমর্থক না হলেও আমেরিকার পদলেহনকারী। তবে এই যুদ্ধে ইসরাইলের শক্তির গর্ব আয়রন ডোম যথেষ্ট দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং আপামর জনতা ইসরাইলের এই জঘন্য অপকর্মগুলোকে নিন্দা জানাচ্ছে।
ইসরাইল দীর্ঘ ২০ মাসের গাজা যুদ্ধে ক্লান্ত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা ইরানের এমন দুর্ধর্ষ প্রতিক্রিয়া চিন্তাও করতে পারেনি! হিসাব ছিল যুদ্ধের নেতৃত্ব হত্যায় এবং পারমাণবিক কেন্দ্রে আক্রমণে ইরান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু ইরানের পাল্টা হামলায় তারা এখন পর্যুদস্ত। তারা হয়তোবা আরো কয়েক দিন কঠিন-কঠোর আক্রমণ চালিয়ে ইরানকে ভয়ার্ত করে তুলার চেষ্টা করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়ানোর সব চেষ্টাই করবে।
অন্যথায় ট্রাম্পের সহযোগিতায় যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করবে। অন্যদিকে ইরানের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তবে ইসরাইল আক্রমণ বন্ধ করলে তারাও হয়তো শান্ত হবে। ইরান প্রতিটি আক্রমণই ইসরাইলের আক্রমণের জবাব হিসেবে পরিচালনা করছে। কাজেই অভ্যন্তরীণ মুখরক্ষা এবং প্রতিশোধ প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য ইরান পাল্টা আক্রমণ কৌশল জারি রাখবে বলে মনে হয়।
এই যুদ্ধের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ইতোমধ্যেই তেলের মূল্য বিশ্ববাজারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা শক্তিগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ‘আকাশ শক্তি’ এবং ‘ক্ষেপণাস্ত্র’ শক্তি অর্জনের দিকে ঝুঁকে পড়লে বিশ্ব অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং মার্কিন অস্ত্রবাজার চাঙা হয়ে উঠবে। যুদ্ধ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে আবার দ্বিমেরু পৃথিবীর উদ্ভব হতে পারে। মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা ও অমুসলিম বিশ্ব এবং চীন-রাশিয়ার নেতৃত্বে মুসলিম বিশ্ব একত্র হতে পারে। অথবা ইসরাইলকেন্দ্রিক এবং ইরানকেন্দ্রিক দুটি অক্ষশক্তির উদ্ভব ঘটতে পারে।
কী হতে পারে তা অনেকটা নির্ভর করছে ট্রাম্পের ওপর। ক্ষ্যাপাটে এই প্রেসিডেন্ট যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। ইরানকে চুক্তিতে বাধ্য করার হুমকি ব্যর্থ প্রমাণিত হলে এবং ইসরাইলের বিপর্যস্ত অবস্থা বৃদ্ধি পেতে থাকলে হয়তোবা ট্রাম্প যেকোনো সময় যুদ্ধবিরতি ঘটিয়ে দিতে পারেন। তবে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থনের বিষয়ে দ্বিমত উচ্চকিত হচ্ছে। বিবেকবান মার্কিনিরা এ রকম তৎপর থাকলে ট্রাম্প যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারেন। তবে প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের মতো অস্থির ব্যক্তিত্ব যে দেশের প্রেসিডেন্ট সেই দেশে বিবেকবান লোকদের কোনো প্রভাব থাকতে পারে কি না? সুতরাং যুদ্ধের শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে বলার অবকাশ নেই যে, এটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু কি না!
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক