চোরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের (Kleptocratic fascism) পতনের পর বাংলাদেশের জনপরিসরে সম্প্রতি একটি তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু বুদ্ধিজীবী প্রচার করছেন যে, দেশের ভবিষ্যৎ শুধু ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রেই’ নিরাপদ। একই সঙ্গে তারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে, যা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত-পুরোনো, দমনমূলক এবং ইরান, আফগানিস্তান, ভারত বা ইসরাইলের ব্যর্থতার সমার্থক হিসেবে তুলে ধরছেন। তাদের বর্ণনায় আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের সামনে এখন এক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে-প্রমাণিত উদার গণতান্ত্রিক পথ গ্রহণ করা, নাকি ব্যর্থ ধর্মভিত্তিক ব্যবস্থার ফাঁদে পতিত হওয়া।
তারা যুক্তি দেন-পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রগুলো, বিশেষ করে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকায় রাষ্ট্রকে ধর্মীয় কর্তৃত্ব থেকে আলাদা করায় স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও বহুত্ববাদ নিশ্চিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তারা ১৭৮৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ দেখান। পাল্টা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন—ভারতে হিন্দুত্ববাদী নিপীড়ন, ইসরাইলের দমননীতি, আফগানিস্তানে তালেবানের নারীবিদ্বেষী আইন, ইরানের কর্তৃত্ববাদী দমন ইত্যাদি ‘ধর্মভিত্তিক’ শাসন। তাদের ঘোষণা-‘বিভেদটা একেবারেই সাদা-কালো’। তাই উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ পথটা বেছে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।
কিন্তু বাস্তবতা অনেক জটিল। এই বয়ান ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস, মতাদর্শ ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে এক সরলীকৃত দ্বৈততায় (Simplistic binary) রূপ দেয়, যা শুধু রাজনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করে, বুদ্ধিবৃত্তিক বোধগম্যতাকে (Intellectual clarity) নয়। এতে ইসলামি রাজনৈতিক দর্শনের নৈতিক গভীরতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য এবং অন্তঃশূন্যতা ঢাকা পড়ে যায়।
বাংলাদেশ যদি এগোতে চায়, তবে ইতিহাস, রাজনীতি ও মুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতাভিত্তিক এক সৎ ও গভীর আলোচনা (Honest and rigorous discussion) জরুরি। আমি এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরছি।
১. ভ্রান্ত তুলনা
ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা আর হিন্দুত্ব, জায়নবাদ বা তালেবানবাদের শাসন এক নয়। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রবক্তারা প্রায়শই ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অন্যান্য দেশের ধর্মচালিত চরমপন্থার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু এ তুলনা তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল। হিন্দুত্ব ও জায়নবাদ ধর্মীয় নয়; বরং জাতিগত প্রকল্প। হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদ হলো আধুনিক জাতিগত বা কট্টর জাতীয়তাবাদী মতবাদ, যার ভিত্তি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, জনসংখ্যাগত প্রকৌশল (Demographic engineering), ভূখণ্ড সম্প্রসারণ, এবং সংখ্যালঘু দমন। এগুলো কখনোই ধর্মতত্ত্ব নয়; বরং জাতিগত বা কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ফল।
অন্যদিকে, সত্যিকার ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সভ্যতাগত নৈতিক ভিত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৪০০ বছরের ইসলামি রাজনৈতিক দর্শন জোর দিয়েছে-(ক) ন্যায়বিচার (আদল), (খ) পরামর্শমূলক শাসন (শূরা), (গ) আইনের শাসন, (ঘ) সংখ্যালঘু সুরক্ষা (জিম্মা/আমান), (ঙ) পুনর্বণ্টনমূলক কল্যাণনীতি (জাকাত, ওয়াক্ফ), এবং (চ) শাসকের নৈতিক জবাবদিহি। এ নীতিমালাগুলো আন্দালুসিয়া থেকে ইস্তানবুল পর্যন্ত বহুত্ববাদী, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলেছিল; যেখানে ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নিরাপদে বাস করতেন। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে হিন্দুত্ববাদী জনতা-নিয়ন্ত্রিত সহিংসতা বা জায়নবাদী বর্ণবৈষম্যের সঙ্গে তুলনা শুধু অজ্ঞতাই নয়; বরং সুস্পষ্ট ইতিহাস বিকৃতি।
২. মিথ্যা দ্বৈততা (False binary)
ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মভিত্তিক শাসন নিয়ে যে দ্বৈততা তৈরি করা হয়েছে, তা এক ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রকল্প। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে অনেকেই ‘নিরপেক্ষ’ কাঠামো হিসেবে উপস্থাপন করেন। আসলে বাস্তবে তা নয়। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র গঠিত হয়েছে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা, আলোকায়ন দর্শন (Enlightenment Philosophy), পুঁজিবাদ এবং আধুনিক জাতিরাষ্ট্র-এ বিশেষ ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে। যদিও পশ্চিমা গণতন্ত্র অনেক সুফল এনেছে, তবু তাদের দ্বারাই ঘটেছে ঔপনিবেশিক শোষণ ও গণহত্যা, দাসপ্রথা ও বর্ণবৈষম্য, হিরোশিমা-নাগাসাকির হত্যাযজ্ঞ, ভিয়েতনাম ও ইরাক যুদ্ধ, গুয়ানতানামোর টর্চার, বৈশ্বিক নজরদারি এবং গভীর শ্রেণি ও বর্ণবৈষম্য। ধর্মনিরপেক্ষতা নিজে কোনো নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে না, এটি শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো, যার সাফল্য-ব্যর্থতা দুইই রয়েছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর ব্যর্থতা রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয়। ইরান, আফগানিস্তান বা কিছু আরব রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে ‘ধর্মীয় শাসনের ব্যর্থতা’ বলা বিভ্রান্তিকর। এগুলোর ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে ঔপনিবেশিক বিভাজন, কর্তৃত্ববাদী এলিট, স্নায়ুযুদ্ধের রাজনীতি, বিদেশি আগ্রাসন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং
আঞ্চলিক পরাশক্তির প্রক্সি যুদ্ধ। এগুলো রাজনৈতিক বিপর্যয়, ইসলামের ব্যর্থতা নয়।
ইসলামকে দোষ দেওয়া ঠিক ততটাই অযৌক্তিক, যতটা ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদের জন্য খ্রিষ্ট ধর্মকে দোষ দেওয়া, মিয়ানমারের গণহত্যার জন্য বৌদ্ধ ধর্মকে দোষ দেওয়া, ভারতের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার জন্য হিন্দু ধর্মকে দায়ী করা। ধর্ম নয়; বরং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও দুর্নীতিই ব্যর্থতার মূল কারণ।
৩. ইসলামি শাসনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র : দ্বন্দ্ব নয়, সহাবস্থান
অনেকে ধারণা করেন, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা আসলে একটি স্বৈরতন্ত্র। এটি ইসলামি রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞানতার পরিচয় বৈ কিছু নয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের অবশ্যই কিছু নীতিগত পার্থক্য আছে। যেমন অধিকাংশ মানুষ যদি মদ, জিনা, বা চাঁদাবাজির পক্ষে ভোট দেয়, তাহলেই এগুলো হালাল হয়ে যাবে না। ইসলামের দুটি বিশেষ জায়গা রয়েছে-মৌলিকত্ব (Absolutism) এবং আপেক্ষিকতা (Relativism)। ইসলামের মৌলিক (Absolute) জায়গাগুলো ডিভাইন আইন দ্বারা সুরক্ষিত এবং সেখানে শুধু গণতন্ত্র কেন, দুনিয়ায় সব মানুষ মিলে এগুলোর বিরুদ্ধে একমত (Total consensus) হলেও সেগুলোর কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না। এই মৌলিক বিষয়ের সুরক্ষা ইসলামের কোনো দুর্বলতা নয়; বরং এক স্থায়ী ও অসাধারণ মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। এই মৌলিক বিষয়ের মধ্যে রয়েছে-আল্লাহর একাত্মবাদ, মৌলিক ইবাদত (Rituals), হালাল-হারামের মৌলিক সীমারেখা এবং মৌলিক আকিদা।
এই মৌলিক বিষয়ের বাইরে বাকি সবই আপেক্ষিক (Relative), যা স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে শুধু পরিবর্তনশীল এবং স্থানীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণই নয়; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং নানান সমাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এগুলোকে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, সেদিকে ইসলাম বারবার তাগিদ দিয়েছে। যেমন খাবারের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক সীমারেখা (হালাল-হারামের বিধান) থাকলেও কোন জাতি কী খাবে, সেটার ক্ষেত্রে ইসলাম একেবারেই উন্মুক্ত এবং স্থানীয় সংস্কৃতিবান্ধব। পোশাক-আশাকের ক্ষেত্রেও একই কথা।
ইসলামে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিষদ মূলনীতি থাকলেও ‘সরকার কাঠামো’ কেমন হবে সেটা ইসলামের মৌলিক জায়গাগুলোর (Areas of absolutism) মধ্যে পড়ে না। ফলে এ জায়গায় জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন জাতির সামাজিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সেরা এবং কার্যকরী মডেলগুলো গ্রহণের ক্ষেত্রে ইসলাম উন্মুক্ত।
আধুনিক সরকার কাঠামোগুলোর মধ্যে কিছু মৌলিক জায়গা ব্যতিরেকে গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সহাবস্থান রয়েছে। বস্তুত ইসলামি রাজনীতির অনেক মৌলিক নীতি গণতন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ :
(ক) শূরা : অংশগ্রহণমূলক শাসন
(খ) আদল : সাংবিধানিক ন্যায়বিচার
(গ) মাসলাহা : জনকল্যাণকেন্দ্রিক নীতি
(ঘ) হুররিয়্যাহ : ব্যক্তিস্বাধীনতা
(ঙ) লা ইকরাহা ফিদ্দিন : ধর্মীয় স্বাধীনতা।
ইসলামি শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হলো জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, নৈতিক নেতৃত্ব ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা। এ নীতিমালার বলেই মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তিউনিসিয়া (২০১১-পরবর্তী সময়), এমনকি তুরস্কের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলাম ও গণতন্ত্র একটি পরস্পর সমর্থনকারী কাঠামো হিসেবে কাজ করেছে। ফলে এটা খুব জোর দিয়েই বলা যায়, ইসলামের মৌলিক জায়গাগুলো (Areas of absolutism) ঠিক রেখে ইসলামি রাজনীতির মৌলিক রীতিনীতির সঙ্গে যদি আধুনিক গুড গভরন্যান্সসংবলিত গণতান্ত্রিক ধারা একত্রিত হয়, তাহলে সেটা একটি চমৎকার সরকার কাঠামোর মডেল হিসেবে কাজ করবে। আমার ধারণা, এ পথেই হাঁটছে জামায়াত।
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রবক্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্রের রেকর্ডে রয়েছে চার শতাব্দীর দাসপ্রথা ও বর্ণবিভাজন, পুলিশি সহিংসতা, গণকারাবাস, বৈশ্বিক সামরিক আগ্রাসন এবং তাতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়। যারা ‘ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রই একমাত্র সফল মডেল’ বলেন, তারা এ মানবতাবিধ্বংসী ইতিহাসগুলোকে আড়াল করেন। ইসলাম এবং গণতন্ত্রের ওপর গভীর স্টাডি থেকে বলা যায়, গণতন্ত্র যখন সেকুলারদের হাতে পড়ে, তখন সেটা শোষণ এবং মানবতাবিধ্বংসী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আবার একই গণতন্ত্র যখন ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে একীভূত হয়, তখন তা একটি মানবিক এবং বৈষম্যহীন সমাজ কাঠামো তৈরি করতে পারে।
৪. বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ
জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে আসল প্রশ্ন হলো-কীভাবে ন্যায়, জবাবদিহিতা ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়। এখানে ‘ইসলাম বনাম সেক্যুলারিজম’-এ বিভাজন সমস্যার সমাধান নয়। বাংলাদেশের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো : (ক) ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, (খ) জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়া, (গ) রাষ্ট্রকে দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট-নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা, (ঘ) মানবিক মর্যাদা ও সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করা এবং (ঙ) নৈতিক মূল্যবোধের শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।
এ সমস্যাগুলো সমাধানে ইসলামি নীতিমালা যেমন কার্যকর হতে পারে, তেমনি গণতান্ত্রিক কাঠামোও জরুরি। এ দুইয়ের সমন্বয়ই দিতে পারে একটি শক্তিশালী, মানবিক এবং বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ। আর এটাই ছিল জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন। রাষ্ট্র ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বা ‘ইসলামি’ এ বিতর্কে সমস্যার সমাধান নেই, সমাধান আছে নৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়।
বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক রূপান্তরের এক সন্ধিক্ষণে। তরুণ প্রজন্মের ন্যায়বিচারের দাবি, স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন এবং জবাবদিহিতার নতুন প্রত্যাশা দেশের রাজনীতিকে নতুন পথে অগ্রসর হওয়ার শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে। এ সময়ে পশ্চিমা বয়ানের সরলীকৃত দ্বৈততা (Simplistic binary) বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। আজ বাংলাদেশের জন্য দরকার ন্যায়, নৈতিকতা, অংশগ্রহণ ও কল্যাণকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ইসলামি রাজনৈতিক দর্শন এখানে গভীর নৈতিক ভিত্তি দিতে পারে। গণতন্ত্র দিতে পারে অংশগ্রহণ ও জবাবদিহির কাঠামো। এ দুয়ের মিলনেই সম্ভব একটি উত্তম রাষ্ট্রকাঠামো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দরকার আরো পরিণত, সুচিন্তিত এবং গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা। যুক্তি ছাড়া কোনো বর্ণনা নয়-এটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের চমৎকার ও কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য আমাদের প্রশ্ন করতে হবে-কোন নৈতিক ভিত্তি ন্যায় ও মানবমর্যাদা রক্ষা করতে পারে? কোন রাজনৈতিক কাঠামো দুর্নীতি ও এলিট-শাসন রোধ করবে? ইসলামি মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয় কীভাবে সম্ভব? কোন মডেল জনগণের কল্যাণ ও বহুত্ববাদ নিশ্চিত করবে?
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে স্লোগানে নয়; ন্যায়, কল্যাণ, সমতা ও নৈতিক নেতৃত্বে।
জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বাস্তব বিতর্ক ইসলাম বনাম সেক্যুলারিজম নয়। এটি ন্যায় বনাম অন্যায়, জবাবদিহিতা বনাম দায়হীনতা, নৈতিক নেতৃত্ব বনাম দুর্নীতি এবং মর্যাদা বনাম আধিপত্যের প্রশ্ন। ইসলামি রাজনৈতিক দর্শন সঠিকভাবে বোঝা হলে ন্যায়, বহুত্ববাদ ও মানবমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রও এসব মূল্যবোধ ধারণ করে, যদিও তারও ব্যর্থতা আছে।
বাংলাদেশের উচিত নয় একটি মিথ্যা দ্বৈততার ফাঁদে পড়া; বরং প্রয়োজন নিজস্ব ইতিহাস, মূল্যবোধ ও নৈতিক কল্পনার ভিত্তিতে এক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা স্বাধীনতা রক্ষা করবে, কল্যাণ বাড়াবে, দুর্নীতি প্রত্যাখ্যান করবে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। এটাই বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় আলাপ, এটাই দেশের সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের জন্য একান্ত দাবি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, নানইয়াং টেকনোলোজিক্যাল ইউনিভার্সিটি, সিঙ্গাপুর