হোম > মতামত

খালেদা জিয়া ও মর্যাদার রাজনীতি

ড. সিরাজুল আই. ভূঁইয়া

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকালে ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর হোটেল পূর্বাণী থেকে গ্রেপ্তার হন খালেদা জিয়া

ইতিহাস প্রায়ই নেতাদের স্মরণ করে তারা কোন যুদ্ধ জিতেছেন, কিংবা কোন কোন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেনÑএসব কিছুর জন্য। বিরল কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের স্থায়ী গুরুত্ব ক্ষমতা প্রয়োগে নয়, বরং ক্ষমতা প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই নিহিত। খালেদা জিয়া নিঃসন্দেহে এই দ্বিতীয় ধারার অন্তর্ভুক্ত। তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছিল এমন এক প্রেক্ষাপটে, কর্তৃত্ববাদী সংহতি, প্রাতিষ্ঠানিক শূন্যীকরণ এবং ভয়ের স্বাভাবিকীকরণের দিকে একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল। এমন পরিবেশে মর্যাদাই হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের এক কর্ম।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে শুধু নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি বা দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার চশমা দিয়ে বোঝা যায় না। এটি পড়তে হবে গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ক্ষয়ের বিরুদ্ধে বারবার নেওয়া এক নৈতিক অবস্থান হিসেবে। তিনি কুৎসা, কারাবাস, একাকিত্ব ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন; তবু আপস বা নীরবতার মাধ্যমে দমন-পীড়নকে বৈধতা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে প্রবেশ ছিল না কোনো পরিকল্পিত উদ্যোগ কিংবা সুযোগসন্ধানী পদক্ষেপ। এটি গড়ে উঠেছিল তার স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ও জাতীয় অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে। তবু ইতিহাস প্রায়ই তার নিজস্ব নেতৃত্ব-যাত্রা গঠনে তার যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তা খাটো করে দেখে। প্রতীকী এক স্থানধারক হয়ে থাকার বদলে তিনি গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক ও অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করা, জনসমর্থন জোগাড় করা এবং তা টিকিয়ে রাখার কঠিন দায়িত্ব নিজেই কাঁধে নেন।

তার নেতৃত্বের শুরুর বছরগুলোয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের পাশাপাশি নিজ দলের ভেতর থেকেও সংশয় ছিল প্রবল। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি ক্যারিশমা বা জবরদস্তির মাধ্যমে নয়, বরং ধারাবাহিকতা ও দৃঢ়তার মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাংবিধানিক বৈধতা, বহুদলীয় প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বে প্রোথিত এক শাসন-দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। এই নৈতিক অভিমুখই পরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন দীর্ঘমেয়াদি চাপে পড়ে, তখন কর্তৃত্ববাদী চর্চার বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধকে সংজ্ঞায়িত করে।

খালেদা জিয়ার কাছে মর্যাদা কোনো স্লোগান ছিল না, এটি ছিল এক পদ্ধতি। তিনি রাজনীতিকে শুধু পদলাভের সংগ্রাম হিসেবে দেখেননি; বরং ক্ষমতা ও নীতির মধ্যকার এক অবিরাম দরকষাকষি হিসেবে বুঝেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও তিনি এমন এক কাঠামোর মধ্যে কাজ করেছেন, যা বিরোধিতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, ভিন্নমতকে সহ্য করেছে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহির মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানগুলো সংরক্ষণ করেছে।

তবে তার মর্যাদার প্রকৃত পরীক্ষা আসে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরাজয়ের পর শুরু হয় আইনি হয়রানি, গণমাধ্যমের কুৎসা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্জনের মাধ্যমে। খালেদা জিয়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। কর্তৃত্ববাদী চর্চাকে স্বাভাবিক করে তোলার বিরুদ্ধে অটল অস্বীকৃতি তার মর্যাদাকে ব্যক্তিগত গুণ থেকে উত্তীর্ণ করে এক সমষ্টিগত রাজনৈতিক মানদণ্ডে রূপ দেয়।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের সবচেয়ে গুরুত্ব দিক ছিল তিনি যাকে কর্তৃত্ববাদী বাড়াবাড়ি বলে মনে করেছেন, তাকে বৈধতা দিতে তার স্পষ্ট অস্বীকৃতি। যে নির্বাচনগুলো তিনি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাতে অংশ নিতে তিনি অস্বীকার করেছেন। পূর্বনির্ধারিত ফল উৎপাদনের জন্য সাজানো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রতীকী অন্তর্ভুক্তিও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।

খালেদা জিয়া বুঝেছিলেন যে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কেবল জবরদস্তির ওপর নির্ভর করে না; এটি অংশগ্রহণের মাধ্যমে উৎপাদিত সম্মতির ওপরও নির্ভরশীল। সেই সম্মতি প্রত্যাহার করে তিনি এমন ক্ষমতা-কাঠামোর ভঙ্গুরতা উন্মোচন করেন।

খালেদা জিয়ার কারাবাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মোড়বদলের মুহূর্ত চিহ্নিত করে। এটি শুধু একটি আইনি অধ্যায় ছিল না; এটি ছিল এক নৈতিক অবস্থান। কঠোর শর্তে আটক, সময়মতো চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এবং রাজনৈতিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন—তিনি হয়ে ওঠেন ক্ষমতা কীভাবে ভিন্নমতকে শাসন করে তার এক জীবন্ত প্রতীক।

তবে কারাবাসের প্রতি তার প্রতিক্রিয়াই প্রতিরোধকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। তিনি প্রদর্শনীর মাধ্যমে সহানুভূতি আহ্বান করেননি, আবার স্বস্তির বিনিময়ে নীতির সঙ্গে দরকষাকষিও করেননি। তার সহনশীলতা—নীরব, মর্যাদাপূর্ণ ও অবিচল—যন্ত্রণাকে রূপান্তরিত করেছে নৈতিক সাক্ষ্যে। কর্তৃত্ববাদী প্রেক্ষাপটে, যেখানে ক্ষমতা প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে ভাঙতে চায়, সেখানে আত্মসমর্পণ করতে তার অস্বীকৃতি জবরদস্তির সীমাবদ্ধতাকেই উন্মোচন করেছে।

দমন-পীড়নের মধ্যে কাজ করা বহু বিরোধী নেতার বিপরীতে, খালেদা জিয়া জনতুষ্টিবাদের প্রলোভন প্রতিরোধ করেছিলেন। তিনি বিশৃঙ্খলা উসকে দেননি কিংবা রাষ্ট্রের ধারণাকেই অবৈধ করার চেষ্টা করেননি। তার সমালোচনা কেন্দ্রীভূত ছিল রাজনৈতিক চর্চার ওপর, প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নয়; কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে, জাতীয় পরিচয়ের ওপর নয়। এই সংযম তাকে এক নৈতিক উচ্চতায় নিয়েছিল।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক গুরুত্ব দলীয় সীমানা অতিক্রম করেছে। তার নীতির সঙ্গে যারা একমত ছিলেন না, তারাও তাকে গণতান্ত্রিক বিবেকের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেন। দীর্ঘস্থায়ী প্রান্তিকীকরণ এই উপলব্ধিকেই আরো দৃঢ় করেছে। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্মৃতি মুছে ফেলতে চায়; খালেদা জিয়ার অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতা সেই অভিলাষকে অস্বীকার করেছে।

তিনি দৃশ্যমানতা ছাড়াই প্রভাবশালী, অংশগ্রহণ ছাড়াই উপস্থিত এবং পদ ছাড়াই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন।

আগামী বছরগুলোয় বাংলাদেশ খালেদা জিয়াকে শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা দলীয় নেতা হিসেবে স্মরণ করবে না। তাকে স্মরণ করা হবে এমন এক নারী হিসেবে, যিনি সহজতর পথ থাকা সত্ত্বেও নতজানু হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন; এমন এক নেতা হিসেবে, যিনি অন্যায়কে বৈধতা দেওয়ার বদলে যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন; এমন এক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে, যখন মর্যাদাই ছিল অবরুদ্ধ।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তার জীবন রাজনৈতিক নির্দেশিকার চেয়ে নৈতিক পাঠ হিসেবেই প্রতিভাত হবে। শিক্ষার্থীরা তাঁকে শুধু পাঠ্যবইয়ে নয়, প্রতিরোধ, বিবেক এবং নীতির মূল্য নিয়ে বিতর্কে আবিষ্কার করবে। সাধারণ নাগরিকরা তাকে স্মরণ করবে এমন একজন হিসেবে, যিনি ভুগেছিলেন, যাতে গণতান্ত্রিক আদর্শ জনজীবন থেকে পুরোপুরি মুছে না যায়। খালেদা জিয়া স্মরণীয় হবেন স্বস্তির চেয়ে মর্যাদা এবং আপসের চেয়ে নীতিকে বেছে নেওয়ার জন্য।

কর্তৃত্ববাদী বাড়াবাড়িকে বৈধতা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে, আত্মসমর্পণ ছাড়াই দমন-পীড়ন সহ্য করে এবং রাজনৈতিক অন্ধকারের মধ্যেও নৈতিক স্পষ্টতা সংরক্ষণ করে, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের জন্য পদমর্যাদার চেয়েও মূল্যবান এক উত্তরাধিকার রেখে গেছেন।

খালেদা জিয়া : বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি

ক্ষমা করবেন ম্যাডাম

আপসহীন দুই প্রজন্মের দুই প্রতিনিধির বিদায়

বেগম খালেদা জিয়া: এক হার না মানা জীবনের প্রতিচ্ছবি

গৃহবধূ থেকে দেশনেত্রী: এক সংগ্রামমুখর জীবনের আলেখ্য

নতুন বছরে যেসব ইস্যু মধ্যপ্রাচ্যকে চ্যালেঞ্জে ফেলবে

উত্তরবঙ্গের তাঁতপল্লি : নীরব অর্থনৈতিক বিপ্লব

ওসমান হাদি হত্যা ও আজাদির লড়াই

মব, গণআদালত থেকে পোস্ট-শাহবাগ

জাতীয় ঐক্যের এক অনন্য সুযোগ ও আমাদের দায়বদ্ধতা