হোম > মতামত

সৌদির এফ-৩৫ কেনা মধ্যপ্রাচ্যে কি প্রভাব ফেলবে?

বেহরুজ আয়াজ

ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান আঞ্চলিক উত্তেজনার মধ্যেই সৌদি আরবের কাছে ৪৮টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি করছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র দুই মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করল রিয়াদ। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তিটি হয়।

১৪২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একসঙ্গে যুদ্ধবিমান কেনা রিয়াদ-ওয়াশিংটন সামরিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। একই সঙ্গে এই চুক্তি শুধু পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই নিরাপত্তা ভারসাম্যে পরিবর্তন আনবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও পরোক্ষ প্রভাব ফেলবে।

স্ট্র্যাটেটিক মিউচুয়াল ডিফেন্স অ্যাক্ট (এসএমডিএ) এবং রিয়াদের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি থেকে পাকিস্তান যে রাজনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করছে, তা বিবেচনা করে ইসলামাবাদ এই অঞ্চলে ‘সিকিউরিটি ব্রোকার’ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি পারস্য উপসাগর ছাড়াও চীন এবং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে।

গত ১৮ নভেম্বর মোহাম্মদ বিন সালমানের সফরটি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েছে সৌদি-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও। সফরকালে যুবরাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে ইরানি কর্মকর্তাদের একটি চিঠিও পৌঁছে দিয়েছেন। বৈঠককালে তিনি আঞ্চলিক উন্নয়ন এবং গাজা সংকট নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং গৃহযুদ্ধকবলিত সুদানে মার্কিন হস্তক্ষেপেরও অনুরোধ জানিয়েছেন।

আঞ্চলিক নিরাপত্তাব্যবস্থায় সৌদি আরব নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। তারই অংশ হিসেবে ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যস্থতা করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে রিয়াদ। আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নিজের অবস্থান সংহত করার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সৌদি আরব, তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হলো ইরান-মার্কিন বৈরিতায় মধ্যস্থতা করা।

তবে, ইসলামাবাদ এবং রিয়াদের মধ্যে গভীর রাজনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরাসরি এফ-৩৫ প্রযুক্তিতে প্রবেশের সুযোগ পাবে না। এই সিস্টেমটি কঠোরভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। কারণ এটি মার্কিন কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারই অংশ। যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত সেই দেশগুলোকে এফ-৩৫ সরবরাহ করে, যারা তার নিরাপত্তা শাসন নেটওয়ার্কে একীভূত হতে পারে।

এ কারণে সৌদিতে পাকিস্তানের ভূমিকা প্রশিক্ষণ ও কর্মী সহায়তার মতো কর্মসূচিতে সীমিত থাকবে এবং তারা মার্কিন বাহিনীকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। ওয়াশিংটন যদি সৌদি আরবের ওপর শর্ত বা বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাহলে পাকিস্তান সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা নাও পেতে পারে। তবে, রাজনৈতিক এবং প্রতিরোধমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, এটি আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে প্রতিরোধমূলক ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের কৌশলগত ওজন ও প্রভাব বৃদ্ধি করবে।

সৌদি আরবের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান থাকলে তার জন্য দক্ষ কর্মী, প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়বে। পাকিস্তান ১৯৬৭ সাল থেকেই সৌদি আরবের বিমানবাহিনীসহ পুরো সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ফলে ব্যাপক সামরিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশ হিসেবে পাকিস্তান সৌদি আরবের ঐতিহ্যবাহী অংশীদার। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সৌদির এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বহরের জন্য পাকিস্তান সীমিত ধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

কৌশলগতভাবে, রিয়াদ পাকিস্তানকে তার ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সহযোগী হিসেবে দেখে এবং প্রয়োজনে কাজে লাগায়। সুন্নি মুসলমানদের এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। রিয়াদ-ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক চীনের দিকে পাকিস্তানের আরো ঝুঁকে পড়ার আগ্রহও কমাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় তার কৌশলগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের আরো বেশি সংশ্লিষ্টতা চায়। সেদিক থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদির এই সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

ভারতের সঙ্গে পাকিস্তনের বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি এই বার্তা দেয়, পাকিস্তান এখন ‘উপসাগরীয় নিরাপত্তা অক্ষ’ বা কাঠামোতে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লিরও হয়তো উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার প্রতিরক্ষা সম্পর্ক পর্যালোচনা করার প্রয়োজন হতে পারে।

তবে, এ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে, ভারত উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ককে পাকিস্তানের চেয়ে বরং চীন ইস্যু এবং জ্বালানি অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখে। ২০২৪-২৫ সালে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের ১৭৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বাণিজ্য হয়েছে।

চীনকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন এই কারণে যে, তারা মনে করে রিয়াদ-ইসলামাবাদ সহযোগিতা বা অন্যান্য চ্যানেলের মাধ্যমে বেইজিং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের স্পর্শকাতর প্রযুক্তি হাতিয়ে নিতে পারে। মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিআইএ) দেওয়া তথ্য অনুসারে, যদিও এ ধরনের প্রযুক্তি স্থানান্তর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু তারপরও এটি হস্তগত করা সম্ভব।

একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করে মার্কিন বাহিনীর ইউরোপীয় কমান্ডের (ইউকম) সাবেক ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল চার্লস ওয়ার্ল্ড বলেছেন, সৌদি আরবের দিক থেকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের তথ্য প্রকাশ করার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তারপরও চীন যেকোনো পন্থায় এই প্রযুক্তি হস্তগত করে তাদের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, অন্যান্য মহাকাশযান বা প্রতিরক্ষা কর্মসূচিতে সেগুলো ব্যবহার করতে পারে।

উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ ২৮৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ৭৭ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় চার গুণ। এছাড়া জ্বালানি, অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিতে আঞ্চলিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলে চীন তার ব্যাপক প্রভাব বজায় রেখেছে। সৌদি আরবে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের উপস্থিতির মাধ্যমে চীনের এই প্রভাব হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

‘যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের সমন্বয়ে নতুন একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তাব্যবস্থাও গড়ে উঠতে পারে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র হবে এর প্রধান স্থপতি ও অংশীদার এবং পাকিস্তান এখানে কৌশলগত প্রতিরোধকের ভূমিকা পালন করবে। নতুন এই কাঠামোটি সম্ভবত চীন ও ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য হবে। এর মাধ্যমে একটি সাধারণ সামরিক জোটের পরিবর্তে বিমান প্রতিরক্ষা এবং অংশীদারত্বের মাধ্যমে সমন্বিত নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হবে।

সৌদি-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তির পাশাপাশি ওয়াশিংটন ও রিয়াদের মধ্যে এফ-৩৫ চুক্তি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে। এ বিষয়টির গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই ধারণা থেকে, সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তিটি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্যই করা হয়েছে। আব্রাহাম চুক্তি যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হাসিলে কাজ করেছে, সেই চুক্তির মতো একই ধরনের কাজ দেবে সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তিও। এই চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে ‘সিকিউরিটি ব্রোকার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চুক্তিটি চীনের জন্য কোনো অর্থনৈতিক হুমকি তৈরি না করলেও উল্লেখযোগ্য সামরিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

সৌদির এফ-৩৫ চুক্তির প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার ওপর হবে পরোক্ষ। ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের আচরণকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকছে সৌদি আরবের সামনে। তবে তা দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা ভারসাম্যে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আনবে না, বরং হালকা কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। অন্যদিকে, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দেওয়ার চুক্তি করে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সৌদি আরবের ওপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ কাজে লাগাবে।

সৌদির কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রি শুধু অস্ত্রের একটি লেনদেন নয়, বরং তা সৌদি-মার্কিন সম্পর্কে গভীর সমন্বয়ের একটি প্রদর্শন। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে মার্কিন বিমান শক্তি বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক মিশনে সৌদি আরবকে কার্যকর অংশীদার হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। একই সঙ্গে এই চুক্তি সৌদি আরবের চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া রোধেও কাজ করবে।

মডার্ন ডিপ্লোমেসি থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

ভারতের মুখোশ খুলে পড়ছে

‘আমার জীবন, আমার সংগ্রাম’ : জাতীয় অগ্রযাত্রার বাতিঘর

বেগম জিয়ার অসুস্থতা ও বাংলাদেশের সংকট

সমাজে নারীমুক্তির সংগ্রাম, চিন্তা ও দর্শনে বেগম রোকেয়া

আসাদ-পরবর্তী সিরিয়ার জন্য বড় হুমকি ইসরাইল

বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের ক্ষয়

জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও খালেদা জিয়া

ঐতিহাসিক এক তদন্ত রিপোর্ট

রপ্তানিতে দরকার বৈচিত্র্য

নির্বাচনের সংস্কৃতি ও জনগণের আস্থাসংকট