হোম > মতামত

তারুণ্যের হাতেই দুর্নীতিবিরোধী যুদ্ধের মশাল

ড. মো. খালেদ হোসেন

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই দিবস বা এই স্লোগান অতি তাৎপর্যপূর্ণ। যেখানে দুর্নীতি মহামারির মতো এই দেশকে আক্রান্ত করেছে । বাংলাদেশের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে দুর্নীতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রবেশ করেছে; অনিয়ম, ঘুস, তদবির, অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার সাধারণ ঘটনা। এতে সাধারণ মানুষ ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত এবং সমাজে অসাম্য ও অসুস্থ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২৪ সালের করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্সের (CPI) সমীক্ষা প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ২৩ (১০০-এর মধ্যে), যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এতে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। টিআইবি জানিয়েছে, এই ফল প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষমতার অপব্যবহার ও এবং স্বচ্ছতার অভাবের জন্য দায়ী। অর্থাৎ, শুধু কঠোর আইন বা নীতিমালা প্রণয়ন করাই যথেষ্ট নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজন বাস্তব ও নিরপেক্ষ বাস্তবায়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও কঠোর জবাবদিহি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখন আর শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব নয়; এটি একটি সমাজভিত্তিক নৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিশেষ করে যুবসমাজকে কেন্দ্রে রেখে একটি টেকসই সংস্কৃতি গড়ে তোলা অপরিহার্য।

প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতি শুধু একটি আইনভঙ্গ তাই নয়, এটি এক ধরনের গভীর নৈতিক বিকৃতি ও অপরাধ যেখানে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি সমগ্র সমাজ, সততা ও ন্যায়ের পথ ছেড়ে স্বার্থ, সুবিধা, অর্থ ও ক্ষমতার মোহে নিজেকে সঁপে দেয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দুর্নীতির জন্ম তখনই, যখন মানুষের ভেতরের ‘বিবেক’ রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং মানুষের নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ আর তার আচরণকে পথ দেখায় না। কিন্তু ২৪-এর অভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলাদেশের তরুণদের অন্তরে এখনো ন্যায় ও সততার স্পন্দন নিভে যায়নি। ওই স্পন্দনই তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, ভয়কে অতিক্রম করতে এবং সত্যের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ হতে সাহস জুগিয়েছে। আর সেখানেই নিহিত রয়েছে দেশে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে জীবন্ত আশার উৎস।

নতুন বাংলাদেশে তরুণদের দুর্নীতিবিরোধী নেতৃত্ব

তারুণ্য কোনো জন্ম-তারিখের ফল নয়; এটি মূলত এক ধরনের জাগ্রত বিবেক তথা একটি নৈতিক অবস্থান। নতুন বাংলাদেশের বাস্তবতা প্রমাণ করেছে, আমাদের তরুণরা শুধু প্রতিবাদ করতে জানে না, তারা জানে অন্যায়ের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিতে। ফ্যাসিবাদের পতন তারা ঘটিয়েছে শুধু রাস্তায় নেমে নয়, বরং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে, ভয়কে অতিক্রম করে, সত্যকে উচ্চারণ করে। আজ, কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম ছাড়া, তারুণ্যই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের নৈতিক ভবিষ্যতের প্রধান বাহক। তারা রাষ্ট্র ও সমাজকে নিঃশর্ত গ্রহণ না করে প্রশ্ন করতে শিখেছে; তারা শুধু সমাজ বা আমলাতন্ত্র কী বলে তা না দেখে, আইন কী বলে, সেটা এবং ন্যায় কী দাবি করে সেই প্রশ্নটিকে সামনে আনছে। একসময় মানুষ জানতে চাইত, ‘এটা কি নিরাপদ?’ আজ তরুণরা জিজ্ঞেস করে, ‘এটা কি নৈতিক?’ আর এই একটি মাত্র প্রশ্ন দুর্নীতির শিকড়ে কুঠারাঘাতের মতো নেমে আসে। কারণ বিপ্লব জন্ম নেয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে নয়, জন্ম নেয় অন্যায় ও অসততার বিরুদ্ধে। ২৪-এর আন্দোলনও তাই শুধু সরকার পরিবর্তনের জন্য ছিল না; এটি ছিল মিথ্যা, দখল, ঘুস, লুটপাট, পাচার ও স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে এক নৈতিক ও সাহসী অভ্যুত্থান। দার্শনিকরা বলেছেন, পৃথিবী বদলায় তখনই, যখন মানুষ মিথ্যার সঙ্গে আপস করতে অস্বীকার করে। বাংলাদেশের তরুণরা আজ ঠিক সেটাই করেছে, মিথ্যার সঙ্গে আপসের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়েছে। আর সে মুহূর্তেই জেগে উঠেছে একটি নতুন শক্তি : প্রতিকারমূলক বিবেক, যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে পথ দেখাবে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়, আমরা একে বহুবার দেখেছি, বহুবার শুনেছি। কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হলো, আমরা কি কখনো আন্তরিকভাবে তরুণদের স্বপ্ন, দায়বদ্ধতা, তাদের মনন ও অপরিসীম শক্তিকে একত্র করে একটি সুসংগঠিত সামাজিক আন্দোলনের কথা ভেবেছি? আজ আমরা জানি, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও আধাসরকারি দপ্তর সবখানেই সঠিক কর্মসংস্থান ও ন্যায্য সুযোগের পথে অসংখ্য অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই দেয়ালগুলোর সবচেয়ে মজবুত উপাদান হলো দুর্নীতি। যদি আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাই, তবে তরুণদের সক্রিয়, সচেতন ও সংগঠিত অংশগ্রহণ ছাড়া তা কখনোই সম্ভব নয়। কারণ পরিবর্তনের ইতিহাস বলে, যেখানে তারুণ্যের নৈতিক ও সাহসী শক্তি যুক্ত হয়, সেখানেই জন্ম নেয় স্থায়ী ও অর্থবহ রূপান্তর।

তরুণদের সঙ্গে নিয়ে সুসংগঠিত পরিকল্পনার অপরিহার্যতা

যদি আমরা সত্যিই আগামীর দিনে একটি স্বচ্ছ, ন্যায়নিষ্ঠ ও জবাবদিহিমূলক বাংলাদেশ গড়তে চাই, তবে তা শুধু আবেগ, স্লোগান বা প্রতীকী কর্মসূচির মাধ্যমে সম্ভব নয়। প্রয়োজন সচেতন, দীর্ঘমেয়াদি, পরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপ, যেখানে নেতৃত্বে থাকবে তরুণ সমাজ।

প্রথমত. জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি নৈতিক ও নাগরিক ‘জিহাদ’ ঘোষণা করতে হবে, যেখানে আইন, সংবিধান, প্রশাসনিক কাঠামো ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় ঘটিয়ে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। দুর্নীতিকে সামাজিকভাবে লজ্জাজনক ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, যেন তা আর ‘স্বাভাবিক’ আচরণ হিসেবে দেখা না হয়।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার আনতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে সততা, ন্যায়, জবাবদিহি ও দুর্নীতির পরিণতি সম্পর্কে পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামসহ প্রতিটি ধর্মের এই সম্পর্কিত কঠোর নীতিকে তুলে ধরে সামাজিকতার পাশাপাশি ধর্মীয়ভাবেও সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ব্লগ, ডকুমেন্টারি, শর্ট ভিডিও, আর্ট এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী জনসচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার বার্তা ছড়িয়ে পড়বে সমাজের সর্বস্তরে। দুর্নীতি কী, এর আইনি প্রভাব কী, কোথায় ও কীভাবে অভিযোগ জানাতে হয়, এই তথ্যগুলো সহজ, গ্রহণযোগ্য ও ডিজিটাল ফরম্যাটে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

তৃতীয়ত. সাংগঠনিক সমন্বয় ও নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যুব সংগঠন, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ, যারা দুর্নীতিবিরোধী কাজে আগ্রহী তাদের একটি জাতীয় নেটওয়ার্কে যুক্ত করতে হবে। স্থানীয় স্তর থেকেই (ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, ক্যাম্পাস ও কমিউনিটি)। ‘নাগরিক পর্যবেক্ষক দল গঠন করে মনিটরিং ও সচেতনতার কাজ শুরু করা যেতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইন রিপোর্টিং, অভিযোগ দাখিল ও তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা করলে তা পরিবর্তনের গতিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে।

চতুর্থত. সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে একটি শক্তিশালী স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিভিত্তিক সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ডিজিটাল ও ম্যানুয়াল উভয় পদ্ধতির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে এবং তদারকি কার্যকর হবে।

পঞ্চমত. যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে বা সত্য প্রকাশ করবে, তাদের জন্য আইনগত ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। একই সঙ্গে সততা, নৈতিকতা ও সাহসিকতার জন্য প্রণোদনা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে, যাতে তরুণরা ভয় নয়, অনুপ্রেরণায় এগিয়ে আসে।

ষষ্ঠত. ধর্মীয় শিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক মর্যাদার কাঠামোর মধ্যেও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে সুস্পষ্ট করতে হবে। পরিবারে, বন্ধুদের আড্ডায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং সামাজিক পরিসরে খোলামেলা আলোচনা, অভিযোগ জানাতে উৎসাহ এবং ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়ানোর মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। কারণ একটি সমাজ তখনই সত্যিকার অর্থে পরিবর্তিত হয়, যখন নৈতিকতা হয়ে ওঠে তার সংস্কৃতির অংশ।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও একাডেমিক ডিরেক্টর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সিভিলাইজেশনাল স্টাডিজ (সিজিসিএস)

khaled.du502@gmail.com

বাংলাদেশের মুসলমানদের সংস্কৃতি

‘ইতিহাসের সেরা নির্বাচন’ করতে ‘শর্ত প্রযোজ্য’

হাদি কেন দিল্লির টার্গেট

সরকারের মধ্যে একমাত্র সেনাপ্রধানের সাথে সুসম্পর্ক চুপ্পুর

নতুন মুক্তি ও বিজয়

নির্বাচন-পূর্ব শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের উপায়

সুদানে আরেকটি গাজা তৈরি করছে ব্রিটেন

ইনকিলাব মঞ্চ ও ইতিহাসের দায়

বিপ্লবী হাদি আমার পরমাত্মীয়

বাংলার মুক্তিযুদ্ধ