রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আমলাতন্ত্রকে বিবেচনা করা হয়। এজন্য একটি দক্ষ, নিরপেক্ষ, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও পেশাদারিত্বমূলক আমলাতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্র এখনো নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও সেবা প্রদানের মূল চালিকাশক্তি। তবে মূল চালিকাশক্তি হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতা ও অনৈতিক চাপ এবং অতিরিক্ত কেন্দ্রীয়করণের কারণে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিহীন এক ক্ষমতা কাঠামোয় রূপ নিয়েছে। দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিবেদন ও বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, আমলাদের দুর্নীতি ও অদক্ষতা এবং তাদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে বিকলাঙ্গ করে ফেলেছে। তদুপরি, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য জনসেবাকে ব্যাহত করছে। ফলে আমলাতন্ত্র উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হওয়ার বদলে বহুলাংশেই এর প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। বিগত ৫৪ বছরেও এর কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধিত হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বভিত্তিক আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই আমলাতন্ত্র হবে দলনিরপেক্ষ, দক্ষ, জবাবদিহিমূলক এবং নাগরিক-সেবামুখী। অর্থাৎ নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও নীতিনির্ধারণ—সব ক্ষেত্রেই যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা ও নৈতিক মানকে প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে অনৈতিক আনুগত্যের জায়গা সংকুচিত হবে। সর্বোপরি, যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং প্রাকৃতিক ও জাতীয় জরুরি অবস্থায় দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ ও জরুরি নাগরিক সেবা অব্যাহত রাখার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
২. বর্তমান সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টা
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা, পুলিশ ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন খাতে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের কাজের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্র কাঠামোকে গণতন্ত্রীকরণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রশাসনিক দক্ষতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির জন্য সমন্বিত সুপারিশ প্রদান। বিশেষ করে ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে বাংলাদেশের প্রশাসনকে অধিকতর কার্যকর করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো—এসব সংস্কারের মাধ্যমে একটি পেশাদার, নিরপেক্ষ ও নাগরিকমুখী আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা।
৩. প্রশাসনিক সংস্কার : কমিটি, লক্ষ্য ও সুপারিশ
প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে গঠিত কমিটি ও কমিশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’। এই কমিশন বাংলাদেশের মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা কমানো, কাঠামোগত পুনর্গঠন এবং উচ্চপর্যায়ের আমলাতন্ত্রের পেশাদারীকরণ নিয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। পাশাপাশি সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন খাতে পৃথক কমিশন গঠন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানে সমন্বিত সংস্কারের একটি সার্বিক কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এই সংস্কার প্রচেষ্টার মূল লক্ষ্য হলো কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র থেকে ধীরে ধীরে বিকেন্দ্রীভূত ও সেবামুখী প্রশাসনে রূপান্তর করা। যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত ও দক্ষ হয় এবং জনগণের নিকট জবাবদিহি বৃদ্ধি পায়। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় ও ক্যাডারের সংখ্যা যৌক্তিকীকরণ, পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব পরিহার এবং নীতি বাস্তবায়নের গতি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিতে মেধা, পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ নীতি প্রণয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে—বিদ্যমান ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১টি বিভাগকে ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে নামিয়ে আসার সুপারিশÑ যা পাঁচটি সমপ্রকৃতির ক্লাস্টারে বিভক্ত করা হবে। যথাÑ (ক) বিধিবদ্ধ প্রশাসন, (খ) অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য, (গ) ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ, (ঘ) কৃষি ও পরিবেশ ও (ঙ) মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন। চারটি পুরোনো বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তরেরও প্রস্তাব করা হয়। যাতে প্রশাসনের স্তরসংখ্যা কমে কার্যকারিতা বাড়ে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের চারটি পুরোনো বিভাগকে প্রদেশে রূপান্তর করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত হয়নি বলে অভিজ্ঞমহল মনে করেন। এটি করা হলে ভবিষ্যতে দেশ নানা রকম সংকটে পড়বে। সংস্কার প্রস্তাবনায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা এবং জেলা পরিষদকে বিলুপ্ত বা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। উচ্চপদে পৌঁছানোর জন্য ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ গঠন করে ডেপুটি সেক্রেটারি থেকে অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি পর্যন্ত পদোন্নতিকে পরীক্ষাভিত্তিক ও প্রতিযোগিতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে নিয়োজিতদের দায়িত্ব ও জবাবদিহি আরো স্পষ্ট করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে অনেক ক্ষেত্রে সুন্দর বা বাস্তবভিত্তিক কিছু সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু সংস্কার প্রস্তাব দেশের প্রেক্ষাপটে অতিরঞ্জিত বা উচ্চাভিলাষী হয়েছে বলেও সচেতন মহল মনে করেন। আবার কিছু কিছু সংস্কার প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে পড়ে না। এগুলোকে কম্পলায়েন্স ইস্যু হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা যায়। যেমনটি হাইওয়ে তেল/পেট্রোল পাম্পগুলোর টয়লেটগুলো স্বাস্থ্যসম্মত বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং মহিলাদের জন্য আলাদা টয়লেট রাখার সুপারিশ।
৪. সংস্কার যেভাবে লক্ষ্যচ্যুত হলো
বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর একটি হলো প্রশাসন ক্যাডার বনাম অন্যান্য ক্যাডারের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব, যা ডেপুটি সেক্রেটারি পদে পদোন্নতির কোটাকে কেন্দ্র করে তীব্র আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে ডেপুটি সেক্রেটারি পদে ৭৫% কোটা প্রশাসন ক্যাডারের জন্য, বাকি ২৫% অন্যান্য ২৪টি ক্যাডারের জন্য। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল এটিকে ৫০:৫০ করা। যা প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
এই প্রস্তাবের পর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, বিবৃতি এবং কমিশন প্রধানের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অন্যদিকে অন্যান্য ক্যাডারের বড় অংশ এই প্রস্তাবকে সমতায়নের পথে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে। ফলে প্রশাসন ব্যবস্থায় এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের এ ধরনের পরস্পরবিরোধী দাবির সমন্বিত কোনো রাজনৈতিক রূপরেখা না থাকায় এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার-স্ট্রাকচার রিফর্মের উপর জাতীয় ঐকমত্য না হওয়ায় সংস্কার এজেন্ডা অনেকাংশে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়েছে। অপরদিকে প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষণ দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে নীতিগত অঙ্গীকার প্রদান করলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনসহ প্রতিনিয়ত নিউজ পেপারে আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের খবর দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রভাব নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেই শুরু হয়। আর এর বিস্তৃতি ঘটে পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নসহ নানা স্তরে। এর বাইরে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পুনঃর্নিয়োগেও রাজনৈতিক বিবেচনার প্রাধান্য দেখা যায়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, পুনঃনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে বিভিন্ন গবেষণা ছাড়াও এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত খবরের কাগজের খোরাক জুটিয়ে চলছে। এ কারণে সংস্কারকে অনেক সময় প্রশাসনিক আধিপত্যবাদী গোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। আরো লক্ষণীয় যে, সংস্কার কমিশনগুলোর চেয়ারম্যানদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি ঐকমত্য কমিশন গঠন করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সরকারের অন্যতম অঙ্গ জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য কমিশনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যদিও নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, জনসেবা প্রদান ছাড়াও দেশে সুষ্ঠু-অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে নির্বাচনই দেশের মুখ্য আলোচনার এজেন্ডা। এজন্য নিরপেক্ষ, দক্ষ ও পেশাদারিত্বপূর্ণ জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন নিশ্চিত করা সব সময় আলোচনার শীর্ষে থাকে। অপরদিকে, রাজনৈতিক আলোচনার ক্ষেত্রে জাতীয় এজেন্ডায় প্রশাসনিক কাঠামো-সংস্কার মুখ্য এজেন্ডা বা অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে অগ্রাধিকার হিসেবে ঠাঁই পায়নি। ফলে সংবিধান বা নির্বাচন সংস্কারের তুলনায় আমলাতন্ত্রের কাঠামোগত সংস্কার বারবার প্রান্তিক অবস্থায় চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোও জনপ্রশাসন সংস্কারকে অতীতেও যেমন গুরুত্ব দেয়নি বর্তমানেও সমভাবে অবহেলিতই রয়েছে। কিন্তু দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটি কাম্য ছিল না। ফলে কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত রোডম্যাপ, সময়সীমা ও আইন সংশোধনের ধারাবাহিকতা গড়ে না তোলায়, মাঠ প্রশাসন থেকে সচিবালয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে বিভ্রান্তি ও প্রতিরোধ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে আমলাতান্ত্রিক সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য দলনিরপেক্ষ, পেশাদার ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন মাঠপর্যায়ে নানা ক্যাডার-স্বার্থ, রাজনৈতিক অভিপ্রায় ও দুর্বল সমন্বয়ের মধ্যে আটকে রয়েছে।
৫. আমলাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?
বর্তমান বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, একদিকে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা, আরেকদিকে ক্যাডারভিত্তিক ক্ষমতা ও সুবিধা বণ্টনের টানাপোড়েন। এই দ্বৈত বাস্তবতা মোকাবিলা করতে না পারলে পেশাদারিত্বভিত্তিক আমলাতন্ত্র গঠনের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তবে সাম্প্রতিক গণআন্দোলন, নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞ মহলের আলোচনায় আমলাতান্ত্রিক জবাবদিহি, বিকেন্দ্রীকরণ ও মেধাভিত্তিক নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের প্রশ্নটি সামনে আসায় ভবিষ্যৎ সংস্কারের জন্য একটি অনুকূল রাজনৈতিক আবহ ও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে, সংস্কারের পথ মোটেই বাধাহীন নয়। কারণ, দীর্ঘ পনের বছরের ফ্যাসিবাদী আমলে আমলাতন্ত্রের নৈতিকতা, সততা, দক্ষতা, জবাবদিহিতা ধ্বংসপ্রায় এবং আমলাতন্ত্রের অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ সংস্কারের এই পথকে আরো পিচ্ছিল ও জটিলতর করে ফেলেছে।
বাধা যতই হোক, বাংলাদেশে টেকসই প্রশাসনিক সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। আর শুধু সংস্কারের প্রস্তাবই যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন সব পক্ষের বিশেষ করে রাজনৈতিক দলসমূহের সদিচ্ছা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা। সর্বোপরি, আমলারাই এখানে মূল নিয়ামক। আমলাতন্ত্রের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির দায় আমলারা কিছুতেই এড়াতে পারেন না। কারণ ফ্যাসিবাদী আমলে বিগত তিনটি নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) প্রহসনের নির্বাচনে আমলারা যদি তাদের আইনসম্মতভাবে ও নৈতিকতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতেন, তাহলে অবস্থা হয়তো ভিন্ন হতে পারত। তাহলে এখন তাদের জেল-জরিমানার সম্মুখীন হতে হতো না এবং জনগণের সামনে তাদের মর্যাদা, ভাবমূর্তি ও প্রাসঙ্গিতা ক্ষুণ্ণ হতো না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের পরিবর্তে নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের জন্য দেশের একটি বড় দলসহ ৩৬টি দলের মধ্যে ৩২টি দলই এই প্রস্তাব করেছে। উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহের সংলাপের সময় এবং পরবর্তী সময়ে লিখিতভাবে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এমনকি নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও এমন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমলাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অবস্থা নাজুক।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ভবিষ্যতে একটি কার্যকর পথনকশা হতে পারে। এগুলো হচ্ছে—(১) সাংবিধানিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এমন গ্যারান্টি সৃষ্টি করা যে, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কঠোরভাবে সীমিত থাকবে এবং নিরপেক্ষ পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও রিফর্ম কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার বাধ্য থাকবে (২) দুর্নীতির সঙ্গে অভিযুক্তদের তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত ও অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকুরিচ্যুত করার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ (৩) বিকেন্দ্রীকরণ জোরদার করে স্থানীয় সরকার ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে ভূমিকা ও কার্যাবলির বণ্টন পরিষ্কার করা, যাতে আমলাতন্ত্র জনগণের কাছাকাছি গিয়ে সেবা দিতে বাধ্য হয় এবং জবাবদিহির চাপ বাড়ে। (৪) সংস্কার কমিশনের সুপারিশে গুচ্ছভিত্তিক মন্ত্রণালয় পুনঃগঠনের পাশাপাশি পেশাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ (৫) বিদ্যমান ঢাউস সাইজের আমলাতন্ত্রকে যৌক্তিকভাবে কমানো ও সুযোগ সুবিধা বাড়ানো। ৬. আমলাতন্ত্র শুধুমাত্র নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, সমন্বয়, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়নে যুক্ত থাকবে এবং সেবা প্রদানে লাইন ডিপার্টমেন্ট, স্থানীয় সরকার, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য খাতে সহায়তা করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং ৭. বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে আমলাতন্ত্র রেফারির ভূমিকা পালন করার বন্দোবস্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ।
উপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র এখন একযুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। চব্বিশের জুলাই বিপ্লব পরবর্তী প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনো পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার ছাপ আমলাতন্ত্রে দেখা যাচ্ছে না। সঠিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার, সমন্বিত রোডম্যাপ এবং আন্তঃক্যাডার ন্যায্যতার ভিত্তিতে যদি বর্তমান সংস্কার উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে পেশাদারিত্বভিত্তিক আমলাতন্ত্র গঠনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং প্রেসিডেন্ট, সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি।