হোম > মতামত

অধীনতাবিরোধী নতুন শক্তির উত্থান : লড়াই ও বিভাজন

আমীর খসরু

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি ও পরিবেশ বিবেচনায় এ কথাটি বলা অযৌক্তিক হবে না যে, বর্তমানে বড় ধরনের একটি লড়াই চলছে। সঙ্গে সঙ্গে এও বলা যায়, এমন রাজনৈতিক এবং এর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও এর আগে আর কখনো লক্ষণীয় ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটি বড় মাত্রায় বিভাজন এবং বিভাজনটির স্থায়ী নিষ্পত্তি ও মীমাংসার বন্দোবস্তের এমন প্রস্তুতিও আগে কখনো দেখা যায়নি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং বিভাজন—এ সবকিছুরই স্থায়ী নিষ্পত্তির সঙ্গে বর্তমান সময়, রাজনীতির সামগ্রিক অবস্থা, পরিস্থিতি, কাঠামো, যাকে একটি অমীমাংসিত রাজনৈতিক লক্ষ্যসহ সব মতাদর্শিক লক্ষ্য এবং ক্ষমতার বিন্যাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবেই দেখতে হবে।

বর্তমান লড়াই প্রস্তুতি থেকে বলা যায়, এটি দ্বিমাত্রিক। অর্থাৎ, এক. বাংলাদেশের প্রকৃতার্থেই স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন; দুই, আধিপত্যবাদহীন নতুন বন্দোবস্ত। আন্তোনিও গ্রামশির ভাষায় হেজেমনি বলতে রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রসহ সামগ্রিক অধীনতা বা আধিপত্যকে বোঝায়। বিভাজন হচ্ছে ওই আধিপত্য ও অধীনতা থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায়, সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে এমন এক রাষ্ট্রকাঠামো এবং সমাজ বিনির্মাণ, যা ওই পরাধীনতা ও আধিপত্যের বিপক্ষে দাঁড়ানোর পক্ষে এবং বিপক্ষের বিভাজন। ‘স্থায়ী রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ বিষয়টি জড়িত রয়েছে এর সঙ্গে। খুব সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন, বর্তমান সময়ের স্থায়ী রাজনীতি ব্যবস্থা, নীতি ও প্রবিধানগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে, আর প্রকৃত অর্থেই সম্পদ ও ক্ষমতার বণ্টনের ওপর রাষ্ট্রটি কোন চরিত্রের তা নির্ভর করে। বর্তমানে শুধু পুরোনো বা ঔপনিবেশিক মানসিকতায় আচ্ছন্ন আইনের বদল বা প্রয়োগের চেষ্টা করার প্রবণতা বিদ্যমান রয়েছে। এখানে মনে রাখতে হবে, শুধু সংবিধান বদল, কথিত সংস্কার অথবা বিদ্যমান কাঠামোগত বিষয়াবলির চুনকামের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। নতুন কাঠামো বিনির্মাণ, যেখানে জনঅংশীদারিত্ব থাকবে, তেমন ক্ষমতাবান রাষ্ট্রকাঠামো এবং রাজনৈতিক কাঠামোই হচ্ছে স্থায়ী বিরোধ নিষ্পত্তি। এই স্থায়ী রাজনৈতিক নিষ্পত্তি বা বন্দোবস্ত ছাড়া কোনো বদলে স্থায়ী বোঝাপড়া সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক এককেন্দ্রিকতার বদলে বহুদলের জনঅংশীদারত্বের নতুন প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণই হচ্ছে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। বর্তমানের লড়াই এই বিভাজনকে কেন্দ্র করে। লড়াইয়ের কারণ হচ্ছে মোদ্দা কথা, অলিগার্কি বা ক্ষমতার উপরিতলার গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীতন্ত্রের শাসন থাকবে কিনা? না এর বদলে জনঅংশীদারত্বমূলক বহুমাত্রিক প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন কায়েম হবে। আর বিভাজনের কারণ হচ্ছে—সামাজিক, সাংস্কৃতিক জাল ও ভুয়া বয়ান এবং সাংস্কৃতিক হেজেমনি বা অধীনতার বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই সঠিক অবস্থানকে চিহ্নিত করে এর পক্ষে পাল্টা সঠিক পথ নির্ধারণ।

এখন বিভাজনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে দেখতে হবে ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যা বয়ান অর্থাৎ ন্যারেটিভ তৈরি এবং এর পক্ষে সম্মতি উৎপাদন (manufacturing consent) সম্পর্কে। ইতিহাসকে বিকৃত করা যায় সহজেই। আর এটা করা হচ্ছে সুকৌশলে; ইতিহাস বিকৃতি এবং জাল বা ভুয়া বয়ান তৈরি করে বিশ্বাসযোগ্য করা। সম্ভব হলে জাতীয় পরিচয়সহ সবকিছু ওলটপালট সম্ভব। আমি পুরো আলোচনায় নিজের মতামত না দিয়ে দার্শনিক, ইতিহাসবিদ এবং পণ্ডিতদের ধারণার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে চাই।

প্রখ্যাত জনইতিহাসবিদ (পিপলস হিস্টোরিয়ান) হাওয়ার্ড জিন বলেন, ‘অতীত বা ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার করা তেমন একটা কঠিন কাজ নয়। আবার অপছন্দের মন্তব্য না শোনার জন্য সত্যিকে আড়াল করাও সহজ। …দেখতে চাই না বলে আড়াল করে রেখেছি। এজন্যই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারিনি আমরা। ন্যক্কারজনক ইতিহাসগুলোয় ইতিহাসবিদদের কম মনোযোগ দেওয়া বা কম গুরুত্ব দেওয়ার কুফল এটাই। …আগ্রাসন, যুদ্ধ, গণহত্যার নাম দেওয়া হয়েছে প্রগতি।’ (তথ্যসূত্র: এ পিপলস হিস্ট্রি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, পৃষ্ঠা: ৩৪-৩৫)

হেনরি কিসিঞ্জার তার প্রথম বই ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড রিস্টোর্ড’-এ বলেন, ‘ইতিহাস হলো একটা পুরো দেশের স্মৃতি; কোনো ব্যক্তিবিশেষের স্মৃতি নয়।’

মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন ১৩ শতকের শেষের দিকে রচিত বিখ্যাত বই ‘আল-মুকাদ্দিমা’-য় বলেন, ‘অনেকেই ঘটনাবলির সঙ্গে মিথ্যা কাহিনি এবং কল্পিত বর্ণনার সংযোজন করেছেন ধারণা ও কল্পনানির্ভর অতিরঞ্জিত বিবরণ দিয়ে। মানুষ এটা বিশ্বাস করেছে। তবে এর মাধ্যমে অন্ধ বিশ্বাস এবং এতে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। কিন্তু ইতিহাস কখনো লুক্কায়িত থাকে না। সুতরাং ওইসব ইতিহাস রচকদের বর্ণনা যতই রসঘন ও মুখরোচক হোক না কেন তাদের মিথ্যার মুখোশ খসে পড়তে দেরি হয় না। অন্তর্নিহিত অসারতা সহজেই আবিষ্কার করে সত্যকে উদ্ধারে সমর্থ হয়।’ (তথ্যসূত্র : আল-মুকাদ্দিমা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৬৭-৬৮)

এই ইতিহাস বিকৃতির ব্যর্থ চেষ্টাই জন্ম দেয় ‘সাংস্কৃতিক হেজেমনি’ বা cultural hegemony বা সাংস্কৃতিক অধীনতা বা আধিপত্য বিস্তার। এটা শুধু সাংস্কৃতিক নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ সর্বব্যাপী। ইতালীয় মার্কসীয় তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশি যেটিকে বলেছেন, অধীনতা তত্ত্ব। গ্রামশি বলছেন, শাসকশ্রেণি শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং জনগণের সম্মতি আদায় করে রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। নোয়াম চমস্কি একে বলেছেন ‘সম্মতি উৎপাদন’ হিসেবে (manufacturing consent)। আর এর জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রচালক এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিদেশি-দেশি সাম্রাজ্যবাদী অথবা অগণতান্ত্রিক শক্তিকাঠামো এবং দেশি, বিশেষত বিদেশি অধীনতাকামী অ্যাক্টররা কীভাবে সংবাদপত্র, সংবাদমাধ্যম, সংবাদ সূত্রগুলোসহ রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোকে ব্যবহার করে।

পাঠকদের কাছে এ কারণে ক্ষমা চেয়ে নিবেদন যে, বাংলাদেশের যে লড়াইটি বর্তমানে চলছে, তা ঘটছে স্বাধীন-সার্বভৌম রক্ষা এবং আধিপত্যবাদবিরোধী হিসেবে টিকে থাকার জন্য। এ কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে কুমতলবে যে বিভাজনটি তৈরি করা হয়েছে এবং আগে থেকেই ঘটেছে, তার সঙ্গে এই বিষয়গুলোকে একটু মিলিয়ে নিন। সব প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট হয়ে যাবে—কোনো বোধগম্যতাহীনতা থাকবে না, থাকবে না কোনো অস্পষ্টতা।

আমরা আলোচনা করছি বর্তমান লড়াই এবং বিভাজনের বিষয়ে। এ বিষয়ে ফরাসি দার্শনিক ফ্রান্তজ ফানো যে ধারণা দিয়েছেন, তা হলো—এক. রাজনৈতিক আধিপত্য, অর্থাৎ যেখানে একটি শক্তিশালী দেশ অন্য দেশ থেকে দুর্বল বলে ভাবা হচ্ছে—তার ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই দেশের সম্পদ ও শ্রমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। আর এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করে একটি স্থায়ী অধীনস্থ শ্রেণির জন্ম দেওয়া। আর এই শ্রেণিটির কাজ হচ্ছে অধীনতাকামী ও আধিপত্যপিপাসু শক্তিমান দেশটির কথিত ‘সভ্যতা মিলন’-এর মতো ধারণাকে ন্যায়সংগত করার চেষ্টা করা। এই তত্ত্বকে রাজনৈতিক-সামজিক আধিপত্য ও অধীনতা তত্ত্ব হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। এই যে অধীন বা অনুগত পরাধীন শ্রেণি তাদের সম্পর্ক হয়—যাকে রাজনীতি বিজ্ঞানে বলা হয়, patron-client relationship, অর্থাৎ পৃষ্ঠপোষক ও অধীনস্থ শ্রেণিতত্ত্ব। শক্তিশালী দেশ পৃষ্ঠপোষক এবং অধীনস্থ শ্রেণি (দালাল বা মক্কেল) দুর্বল থাকবে—এটাই হচ্ছে নিয়ম।

বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বুঝতে হলে এসব বিষয় আমাদের জানা এবং বোঝার প্রয়োজন আছে।

এখন প্রশ্ন আসবেই—এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রটি আসলে কার এবং রাষ্ট্রটি প্রকৃতার্থে কে চালায়? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ‘অলিগার্কি’ শব্দটির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমার আগের লেখায় (বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের গোড়ার কথা—আমার দেশ, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫) বলেছি, বাংলাদেশে ব্রিটিশ ভারতে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশদের অধীনস্থ দেশীয় দালাল শ্রেণি গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরে পাকিস্তান পয়দা করে অভিজাত ও ধনিক শ্রেণির। এটি একটি কতিপয়ের শাসন বা গোষ্ঠীতন্ত্রের শাসন। কালক্রমে এরাই হয়ে উঠেছে ‘অলিগার্কি’। এই গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতার অননুমোদিত অংশীদার। তাদের প্রভুদের নিজস্ব স্থানে তারা বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামো বজায় রেখে মূলত সরাসরি রাষ্ট্রীয় ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদ ভাগাভাগি অথবা লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার অংশীদার। অলিগার্কি গঠিত হয় রাষ্ট্রকাঠামো, এর প্রশাসনিক এবং নীতি-কৌশলকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে। নিজ স্থানে এদের অধিকাংশই শক্তিশালী রাষ্ট্রের ক্লায়েন্ট বা অধীনস্থ মক্কেল বা খদ্দের। এই অলিগার্কি আলোচিত ‘ডিপ-স্টেট’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

দুর্বল গণতন্ত্র এবং জন-অংশীদারিত্ববিহীন অবস্থায় রাষ্ট্রক্ষমতার সরকারের সমান্তরাল ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে। একে ইংরেজিতে বলা হয়, ‘Informal center of power,’ অর্থাৎ ক্ষমতার অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্র। ক্ষমতার এই অনানুষ্ঠানিক কেন্দ্রসমূহ নীতি-কৌশল, রাজনৈতিক বন্দোবস্তসহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের কাজ করত। এই কেন্দ্র দৃশ্যমান না হলেও তার অস্তিত্ব বোঝা যায়। এটি ডিপ-স্টেটের চাইতেও বয়স্ক; অক্টোপাসের মতো। ডিপ-স্টেট হচ্ছে এমন, যার অস্তিত্বও বোঝা যায় না, যারা জড়িত তাও জানা-বোঝা যায় না। ছায়াহীন কায়া। ডিপ-স্টেটকে অনেকে ‘সরকারের মধ্যে সরকার’ বলে মনে করে থাকেন। এ সম্পর্কে অন্য কোনো এক সময়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল। তবে এটুকু বলা প্রয়োজন—ডিপ-স্টেট এমন একটি গোপন নেটওয়ার্ক, যা শুধু দেশীয় নয়, বরং বহিঃশক্তি বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে জড়িত।

যেহেতু ডিপ-স্টেট সরকার অনুমোদিত নয় বা তারা তার তোয়াক্কাও করে না, সেক্ষেত্রে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশল গ্রহণকারী সংস্থার শক্তিমান ব্যক্তিবর্গ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ রাষ্ট্র কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যেমন—সংবাদপত্র বা মাধ্যম, গবেষণা সংস্থা, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবীসহ মতামত ও অভিমত সৃষ্টি বা উৎপাদনকারীরা এর সঙ্গে জড়িত। দেশীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও, অর্থনৈতিক এবং দাতা সংস্থাও এর বাইরে নয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে—জাতীয় প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের নীতি-কৌশল নির্ধারণ করে। ডিপ-স্টেট এইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অথবা সরাসরি নানা কৌশলে ইনফরমাল অংশীদার বা অংশজনে পরিণত হয়। ডিপ-স্টেটের এই বিদেশি শক্তি সম্পর্কে সবার আগে উল্লেখ করা দরকার যে, কাউকে যে কোনো উপায়ে তারা প্রভাবিত করে থাকে। কখনো কখনো কোনো দেশ নিজে না পারলে অন্য এক বা একাধিক দেশকে তাদের কার্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করে।

নতুন শক্তির উত্থান

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব এখন স্তিমিত। বলতে গেলে এর প্রধান কুশীলবরা বিপ্লব ভুলে সংস্কার ও নির্বাচনি ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণবাদের প্রান্তিকের কাছাকাছি। যাদের পেটিবুর্জোয়া এবং মার্জিনালাইজড বলা হয়, তারা এবং তরুণ সমাজের মনে প্রশ্ন জেগেছিল—কী পেলাম চব্বিশের বিপ্লবে? শুধু পেটিবুর্জোয়া অর্থাৎ শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুরসহ এই শ্রেণি এবং তরুণসমাজ যখন তাদের নেতাদের কার্যক্রমে হতাশ, তখন নীরবে ঘটে গেল একটি ঘটনা। চব্বিশের বিপ্লবীরা ন্যায়, ন্যায্যতা ও ইনসাফের নীতির ভিত্তিতে ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সত্য; তবে এসব কেতাবি ভাষায় রূপান্তর করে যখন তারা নির্বাচন আর সংস্কার ও ঐক্যমত্য কমিশনে ব্যস্ত—তখন চব্বিশের বিপ্লব বুকে ধারণকারীরা বিষণ্ণ, বিপন্ন, অসহায়। যারা বা যে চক্র এ সময় অর্থাৎ ৫ আগস্টের বিপ্লবকে ব্যর্থ দেখে আনন্দিত তাদের ‘প্রভুদের নামে’, আর যে বড় রাজনৈতিক দলটি প্রথম থেকেই চব্বিশের বিপ্লবকে অস্বীকার ও তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে বিপ্লবকারীদের ‘নাবালক’ বা ‘বয়স হয়নি’ বলে গণনার মধ্যেই আনেনি—সেই তারাই চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের বৈধতা দেবে না বলে রাজনৈতিক দেনদরবার ও দরকষাকষি করছিল। জুলাই জাতীয় সনদকে একখণ্ড অকার্যকর কাগজে পরিণত করতে যে মতলব বা কর্মকাণ্ড করেছে কথিত ঐক্যমত্য কমিশনের সঙ্গে—তখন ফ্যাসিবাদী শক্তি আনন্দিত হয়েছে এবং তাদের কর্মকাণ্ড আবার শুরু করেছে মাত্র।

তখন একটি ঘটনা বিপ্লবকে আরো বেগবান ও শক্তিশালী করেছে। ওসমান হাদির মৃত্যুতে ‘ফ্যাসিবাদের নতুন বন্ধুরা’ নড়েচড়ে বসেছে। ওসমান হাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পরে বড় আরেকটি বিপ্লবের জন্ম নিয়েছে। একটি কণ্ঠস্বর পরিণত হয়েছে অযুত-নিযুত কণ্ঠস্বরে। সাধারণ মানুষ যে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন-সার্বভৌম ও ন্যায়নীতির নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায়, তার সামান্য প্রকৃত নমুনা দেখা গেছে ওই ঘটনায়। মানুষ এবার বুঝতে পারছে বিপ্লবের মৃত্যু নেই। মানুষ চলে যায়, কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো যে জনতার এবং বিপ্লব একজনের মৃত্যুতে বিনাশ হলো না। অঙ্গীকার ও প্রত্যয় নিয়ে একজনের বদলে বহুজনে কথা বলে, তা বাস্তবায়ন করে। বিপ্লব এখনো অসমাপ্ত—the unfinished revolution.

শেষ কথাটি হচ্ছে, পুরো দেশ অর্থাৎ দেশের মানুষ যদি তৈরি থাকে, তাহলে কোনো আধিপত্যবাদী বয়ান এবং প্রকল্প স্থায়ী নয়। তিনি এও জানান দিয়ে গেছেন, যতক্ষণ না সত্যিকারের বিপ্লব সম্পন্ন হবে, রাজনৈতিক ন্যায্যতার বন্দোবস্ত সম্পন্ন হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বিপ্লব বারে বারে ঘটতে থাকবে। হাদির মৃত্যুর অর্থ বিদায় নয়, নতুন শক্তির উত্থান। আর এই নতুন শক্তির নাম আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনবিরোধী ভিন্ন এক বাংলাদেশ।

লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক

বাংলাদেশের গণতন্ত্র : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

নির্বাচনি ইশতেহারে শিক্ষা কতটা গুরুত্ব পাবে?

চট্টগ্রাম বন্দর : লাভ না ক্ষতি

খৃস্টের সম্মান

মাতুয়া অভিবাসন : হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের মিথ্যা বয়ান

শেষ হয়নি আরব বসন্ত

চিরকালের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে গেলেন ওসমান হাদি

আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার লড়াই

মিডিয়ার ভালোবাসায় দিশাহারা বিএনপি

গণমাধ্যমের বয়ান নির্মাণ এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান