একটি জাতির জীবনে সংস্কৃতি কেবল শিল্প, সাহিত্য, সংগীত বা পোশাকের বিষয় নয়—এটি তার আত্মার প্রতিফলন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা যদি হয় দেহের মুক্তি, তবে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা হলো সেই দেহে প্রাণের সঞ্চার। বাঙালি মুসলমান সমাজ এই সত্যটি বুঝতে বুঝতেই পেরিয়েছে কত দীর্ঘ সময়। আজকের বাংলাদেশ যে স্বাধীন রাষ্ট্র, তার পেছনে শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামই নয়, ছিল সংস্কৃতিগত আত্মপরিচয়ের এক দীর্ঘ লড়াই। এই দেশের মুসলমানরা যখন ইতিহাসের ভাঁজে নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেতে শুরু করল, তখন তারা আবিষ্কার করল তাদের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, উৎসব, ভাষা ও শিল্পকলা সবকিছুতেই রয়েছে এক স্বতন্ত্র সত্তা, যা অন্য কারো অনুকরণ নয়, বরং নিজস্ব মাটির গন্ধে গড়া। এই উপলব্ধিই ছিল এক নতুন জাগরণের সূচনা, যার মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল স্বাধীন সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত।
সংস্কৃতি শব্দটি আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি, কিন্তু এর গভীরতা অনুধাবন করি না। সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে আমরা এক করে ফেলি, অথচ দুটির মধ্যে আছে মৌলিক পার্থক্য। সভ্যতা হলো মানুষের বাইরের অর্জন যেমন- বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা, বাণিজ্য ও শাসনব্যবস্থা। আর সংস্কৃতি হলো মানুষের অন্তরের বিকাশ—যা প্রকাশ পায় আচরণে, অনুভবে, জীবনযাত্রায় ও নান্দনিকতায়। সভ্যতা ধার করা যায়, সংস্কৃতি নয়। কারণ সভ্যতা স্থানান্তরযোগ্য, কিন্তু সংস্কৃতি মাটির সন্তান। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সেই অর্থে কোনো ধার করা সংস্কৃতি নয়। এটি এ অঞ্চলের আবহাওয়া, প্রকৃতি ও মানুষের প্রাণশক্তি থেকে উৎসারিত। এই সংস্কৃতির মূলে আছে নদীনালা, কৃষিজীবন, উৎসব-অনুষ্ঠান, ভাষা ও সংগীত, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক অদৃশ্য বন্ধনে মানুষকে যুক্ত রেখেছে।
বাঙালির এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্র ছিল গ্রাম। গ্রামের মানুষের জীবন একরৈখিক, সহজ ও প্রকৃতিনির্ভর। তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আচার-আচরণ সবকিছুই মাটির ঘ্রাণে মিশে আছে। শহুরে সংস্কৃতি এসেছে অনেক পরে এবং শহুরে সংস্কৃতি এনেছে নতুন বুদ্ধি, শিক্ষা, চিন্তা ও যোগাযোগের রূপ। কিন্তু শহর কখনো সংস্কৃতির উৎস নয়, বরং তার বিকাশের একটি ক্ষেত্র মাত্র। সংস্কৃতির জন্ম হয় মাটিতে, বিকাশ ঘটে শহরে। তাই গ্রামকে অবহেলা করা মানে সংস্কৃতির শিকড় ছেঁটে ফেলা। একটি সমাজ তখনই পূর্ণাঙ্গ হয়, যখন গ্রামীণ মানবিকতা ও শহুরে প্রজ্ঞা মিলেমিশে এক স্রোতে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতই বাঙালির সংস্কৃতিকে দিয়েছে এক ভারসাম্য—যেখানে আছে মাটির ঘ্রাণ, আবার আছে আধুনিকতার স্পর্শ। ধর্ম ও সংস্কৃতি বাঙালি জীবনের দুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে ধর্মকে কখনো সংস্কৃতির শাসক হতে দেওয়া উচিত নয়। ধর্ম মানুষকে নৈতিকতা ও মানবতার শিক্ষা দেয়, কিন্তু সংস্কৃতি সেই শিক্ষাকে সৌন্দর্যে পরিণত করে। একে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। যখন ধর্ম সংস্কৃতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সমাজে জড়তা আসে; আর যখন সংস্কৃতি ধর্মের শুদ্ধ মূল্যবোধকে ধারণ করে, তখন সমাজে আসে আলোকিত মানবতা। বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছিল বলেই তাদের সংস্কৃতি একদিকে ধর্মীয় মূল্যবোধে দৃঢ়, অন্যদিকে মানবিক অনুভবে উজ্জ্বল।
বাংলার ইতিহাসে মুসলমান সমাজের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এক দীর্ঘ মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই অঞ্চলের আদিবাসী, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান—সব ধর্ম, ভাষা ও ঐতিহ্য এখানে মিলেমিশে এক অনন্য সুর সৃষ্টি করেছে। এ অঞ্চলের বৌদ্ধ সংস্কৃতি যেমন মানবতাকে শিখিয়েছে, তেমনি ইসলামি সংস্কৃতি দিয়েছে শৃঙ্খলা ও সাম্যবোধ। ফলে এখানে যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তা কোনো একক ধর্ম বা জাতির নয়; এটি একটি মিশ্র কিন্তু স্বতন্ত্র মানবিক সংস্কৃতি। এই মিলনের কারণেই বাঙালি মুসলমান কখনো আরবের প্রতিরূপ হয়নি, হয়নি ভারতের অনুকরণও। তারা গড়ে তুলেছে নিজেদের এক মাটির গন্ধযুক্ত জীবনধারা যেখানে ইসলামি মূল্যবোধ ও স্থানীয় ঐতিহ্য মিলেমিশে এক আত্মিক ঐক্যে রূপ নিয়েছে।
ঔপনিবেশিক যুগে এই সাংস্কৃতিক ধারা চরম আঘাতের মুখে পড়ে। বিদেশি শাসকরা ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করে সমাজকে দুটি বিপরীত মেরুতে ভাগ করে দেয়। একদিকে হিন্দু অভিজাত সমাজের সংস্কৃতিকে ‘মূলধারা’ ঘোষণা করা হয়, অন্যদিকে মুসলমান সমাজকে করা হয় উপেক্ষিত ও অশিক্ষিত শ্রেণি। বাংলা ভাষাকেও একপেশে রূপে গড়ে তোলা হয়, যেখানে ইসলামি ও আরবি-ফারসি প্রভাবকে অগ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। ফলে মুসলমান সমাজ তাদের ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্র হারিয়ে ফেলে। তাদের উৎসব, পোশাক, সংগীত সবকিছুই ‘অভিজাত নয়’ বলে চিহ্নিত হয়। এই মানসিক দাসত্বের অবসান ঘটানোই পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়।
সংস্কৃতির প্রাণ থাকে উৎসবে। উৎসবের মধ্য দিয়েই জাতি তার আনন্দ ও সংহতির প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু উৎসব যখন কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন হয়, তখন সংস্কৃতিও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। একসময় ঈদ ছিল পারস্পরিক মিলনের উৎসব, আজ তা অনেকাংশে ভোগবাদী আনন্দে পরিণত হয়েছে। সামাজিক সংহতির বদলে দেখা যায় কৃত্রিম প্রতিযোগিতা ও অতি ভোগের প্রদর্শনী।
একইভাবে ধর্মীয় অনুশোচনার প্রতীক মহররমও একসময় ছিল বীরত্ব ও ত্যাগের উৎসব, কিন্তু আজ তা অনেকাংশে কুসংস্কার ও আনুষ্ঠানিকতার ভেতর হারিয়ে গেছে। সমাজের এই পরিবর্তন আমাদের মনে করিয়ে দেয় সংস্কৃতি তখনই বাঁচে, যখন তাতে থাকে প্রাণের উচ্ছ্বাস ও মানুষের অংশগ্রহণ; শুধুই অনুষ্ঠান নয়, জীবনের প্রকাশ। ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমান শাসকেরা শিল্প-সংগীতকে উৎসাহ দিয়েছেন, সভ্যতার অলংকার হিসেবে লালন করেছেন।
শিল্পকলা মানুষের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। যে সমাজ শিল্পকে ভয় পায়, সে সমাজ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। একসময় বাংলাদেশের চিত্রশিল্প ও সংগীত এই অন্ধকার ভেদ করে আবার নবজাগরণের আলোর মুখ দেখে। শিল্পীরা বুঝিয়েছেন সংগীত কোনো পাপ নয়, বরং মানুষের আনন্দ, প্রেম ও মানবিকতার ভাষা।
ভাষা হলো সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন। জাতির আত্মপরিচয় ভাষার ভেতরেই বাস করে। বাঙালি মুসলমান সমাজ দীর্ঘদিন অন্যের ভাষা, অন্যের উচ্চারণ ও অন্যের রুচিকে অনুসরণ করে চলেছে। এই অনুকরণ ছিল মানসিক পরাধীনতারই আরেক রূপ। ভাষা তখনই জীবন্ত, যখন তা জনগণের মুখে জন্ম নেয়। পূর্ব বাংলার মানুষের মুখের ভাষা ছিল সহজ, প্রাণবন্ত ও প্রাকৃতিক। কিন্তু সাহিত্য ও মিডিয়ার ভাষা হয়ে উঠেছিল কৃত্রিম ও পাণ্ডিত্যপ্রধান। ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাহিত্যিকদের দূরত্ব বাড়ে। এই ব্যবধান দূর করা দরকার ছিল। সাহিত্য ও ভাষায় ফিরে আসতে হতো মানুষের মুখের সুরে, তাদের হাসি-কান্নার ছন্দে। জনগণের ভাষাকেই হতে হবে সাহিত্যের ভাষা, কারণ জাতির আত্মা সেখানে জেগে থাকে। ভাষা আন্দোলন ছিল এই আত্মমর্যাদারই এক বিস্ফোরণ। এটি কেবল ভাষার অধিকারের আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল সংস্কৃতির মুক্তির সংগ্রাম। মানুষ বুঝেছিল—যে ভাষায় তারা স্বপ্ন দেখে, গান গায়, ভালোবাসে, সেই ভাষাকে অস্বীকার করা মানে নিজের অস্তিত্ব অস্বীকার করা। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা মানে নিজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা।
একটি জাতি তার পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, বিনোদন ও জীবনযাত্রার মধ্য দিয়েই নিজের পরিচয় প্রকাশ করে। কিন্তু যখন আমরা দেখি, বিদেশি পোশাক, খাবার ও জীবনধারা আমাদের সমাজের মানদণ্ড হয়ে উঠছে, তখন বোঝা যায়—আমরা এখনো পরাধীনতার বেড়াজাল পুরোপুরি ছিন্ন করতে পারিনি। আধুনিকতার মানে বিদেশি অনুকরণ নয়; আধুনিকতা মানে নিজের ঐতিহ্যকে সময়ের সঙ্গে নতুনভাবে উপস্থাপন করা। আমরা যদি আমাদের পোশাকে, সংস্কৃতিতে ও আচরণে নিজের মাটির গন্ধ ধরে রাখতে পারি, তবে সেটাই হবে প্রকৃত আধুনিকতা।
একটি জাতির নবজাগরণ কখনো কেবল অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়। নবজাগরণ মানে নতুন করে জেগে ওঠা, নতুন করে নিজের সামর্থ্য আবিষ্কার করা। তাই সংস্কৃতির রেনেসাঁ হতে হবে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও গণভিত্তিক। অতীতের ঐতিহ্য আমাদের গর্বের বিষয় হতে পারে, কিন্তু অনুকরণের নয়। আমরা যদি কেবল পুরোনো গৌরব পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন দেখি, তবে আমরা স্থবির হয়ে পড়ব। প্রয়োজন এমন এক নবজাগরণ, যা অতীতকে শ্রদ্ধা করবে কিন্তু ভবিষ্যৎকে গড়বে নিজের মেধা ও যুক্তির আলোয়।
আমাদের সমাজে আজও এক ধরনের মানসিক দাসত্ব কাজ করে আমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে কম মূল্য দিই, বিদেশি সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করি। এই আত্মবিস্মৃতি থেকেই জন্ম নেয় পরনির্ভরতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ও সাংস্কৃতিক শূন্যতা। এই রোগের প্রতিষেধক একটাই, নিজেকে চিনে নেওয়া। আমরা কে, আমাদের ঐতিহ্য কী, আমাদের ভাষা ও ইতিহাস কোথায় এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই লুকিয়ে আছে মুক্তির পথ। যখন জাতি নিজের অতীতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় এবং ভবিষ্যৎ গড়তে আত্মবিশ্বাসী হয়, তখনই প্রকৃত স্বাধীনতা আসে।
আজকের বাংলাদেশ সেই সাংস্কৃতিক সংগ্রামেরই ফসল। রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি এই দেশ অর্জন করেছে এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় যেখানে আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, ভাষার গর্ব, শিল্পকলার বিকাশ ও মানবিক সহাবস্থানের ঐতিহ্য। তবে এই অর্জনকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনো অনেক পথ বাকি। বিশ্বায়নের এই যুগে যখন বিদেশি সংস্কৃতি প্রতিদিন আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ছে, তখন প্রয়োজন আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ভীতকে আরো মজবুত করা। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, গণমাধ্যম সবখানে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সচেতনতা, যা আমাদের শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেবে।
সংস্কৃতি কোনো একদিনে গড়ে ওঠে না, আবার কোনো একদিনে ধ্বংসও হয় না। এটি মানুষের হৃদয়ে, সমাজের অভ্যাসে, শিল্পের সুরে এবং ভাষার ছন্দে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।
বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ যে সংস্কৃতির ধারা নির্মাণ করেছে, তা এসেছে দীর্ঘ ইতিহাসের মাটি ছুঁয়ে, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক বোধের মিশ্রণে। এই সংস্কৃতির মূলমন্ত্র হলো—নিজেকে জানো, নিজের প্রতি গর্ববোধ করো, অন্যের ভালো গ্রহণ করো, কিন্তু নিজের পরিচয় হারিয়ো না।
এই মাটির গান, এই নদীর সুর, এই মানুষের মুখের ভাষাই আমাদের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য। যতদিন আমরা এই ঐশ্বর্য লালন করব, ততদিন বাঙালি মুসলমান সমাজ থাকবে তার নিজের আলোকিত পরিচয়ে স্বাধীন, গর্বিত, প্রাণবন্ত।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zahid.ss.du@gmail.com