হোম > মতামত

এক দিনের মুক্তি ও চিরবঞ্চিত জনগণ

মেহেদী হাসান

৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো জাতি। আনন্দে উদ্বেলিত সারাদেশের কয়েক কোটি মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। কোনো স্বৈরশাসকের গদি ছেড়ে পলায়নের পর একসঙ্গে এত মানুষের রাজপথে নেমে বিজয়ের আনন্দে অংশগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অগণিত মানুষ সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়েছে আর উপভোগ করেছে মুক্তির এক অপূর্ব স্বাদ।

কিন্তু কে জানত ৪৭, ৭১, ৯০-এর মতো এবারও এই অতুলনীয় মুক্তির স্বাদ কয়েক দিনের বেশি স্থায়ী হবে না! কে জানত, মুক্তির এই আনন্দ রাজপথ থেকে ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যাবে আর বুকের ভেতর আবার বইতে শুরু করবে নতুন ঝড়। কে ভেবেছিল, এত দ্রুত আবার ক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকবে দেশপ্রেমিকদের মনে।

৮ আগস্ট নতুন সরকারের পথচলার পর থেকেই ম্লান হতে শুরু করে অগণিত মানুষের বুকভরা স্বপ্ন। ক্রমেই গ্রাস করতে থাকে হতাশা। কত আত্মত্যাগ আর বর্ণনাতীত কত বেদনাদায়ক ঘটনার বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে জন্ম নিয়েছিল স্বপ্নের পাকিস্তান। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মে মানুষ সেদিন এতই আনন্দিত হয়েছিল, কেউ কেউ পাকিস্তানকে আখ্যায়িত করেছিল ‘আল্লাহর ঘর’ হিসেবে। কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের মাথায় সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এ দেশের মানুষ। কারণ একটিই, স্বপ্নভঙ্গ। এই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের যাত্রার সঙ্গে সঙ্গেই। ফলে আবার নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল মানুষ। আবার যুদ্ধ। আবার অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হলো আরেক নতুন দেশ-বাংলাদেশ।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের মানুষ আবার নতুন করে মুক্তির স্বাদ নিয়েছিল বুকভরা আনন্দে। কিন্তু মুক্তি কি আসলে পেয়েছিল তারা? কত দিন স্থায়ী হয়েছিল সে মুক্তি আর মুক্তির আনন্দ? মাত্র চার বছরের মধ্যে দুর্ভিক্ষ। স্বাধীনতার পরপরই দেশে কায়েম হয়েছিল ভয়াবহ এক ত্রাসের রাজত্ব। রাষ্ট্রীয় মোড়কে পরিচালিত ব্যক্তিগত রক্ষীবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হলো হাজার হাজার প্রতিবাদী আর বিরোধী মতের মানুষ।

মানুষ নতুন করে পরিণত হলো দাসে। যে রাষ্ট্রের হাতে মানুষ দায়িত্ব অর্পণ করেছিল, তার জীবনের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান এবং দেখভালের সেই রাষ্ট্রযন্ত্র হয়ে উঠল মানুষের জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। রাষ্ট্র হয়ে উঠল গণমানুষের প্রতিপক্ষ, শত্রু তথা জানের দুশমন।

প্রতিটি রক্তাক্ত পরিবর্তনের পর ঘুরে-ফিরে কমবেশি সেই একই দৃশ্যের অবতারণা। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে বারবার? কেন এত দ্রুত চারদিক থেকে রব উঠল বিপ্লব বেহাত হওয়ার বিষয়ে। কেন মুক্তিপাগল মানুষ বারবার রাজপথে বুক পেতে রক্ত ঢেলে দেয় আর তার ফল ভোগ করে সুবিধাবাদী, বর্ণচোরার দল। আগস্ট বিপ্লবের পর কয়েক মাস ধরে এ প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে অগণিত মানুষের মনে।

এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তির আনন্দ রাজপথে এক দিনের উল্লাস প্রকাশের মধ্যেই যদি সীমাবদ্ধ থেকে যায় তাহলে বারবার প্রতারিত জনতা এক দিন হয়তো আর ঘরের বাইরে আসবে না। কারণ যে দেশ বীরের সম্মান করতে জানে না, সে দেশে বীরের জন্ম হয় না।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক নতুন একটি দেশ পেলেন এ অঞ্চলের মুসলমানরা। কিন্তু খুব কম সময়ে মানুষ বুঝতে পারল ক্ষমতার চেয়ারে বসা ব্যক্তির পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। শাসনের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ব্রিটিশের পরিবর্তে পাকিস্তানি। বিদেশি শোষকের পরিবর্তে দেশীয় শোষক। ব্রিটিশের রেখে যাওয়া সেই পুরোনো আইন ও পুরোনো সিস্টেম। পুলিশ, আর্মি, প্রশাসন, আইন, শিক্ষাব্যবস্থা-সবকিছু চলতে শুরু করল ঔপনিবেশিক কাঠামো আর পদ্ধতির অধীনে।

ঠিক এরই পুনরাবৃত্তি ঘটল ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর। আবার সেই স্বপ্নভঙ্গের পালা, চারদিকে হাহাকার। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি স্টাইলে এ দেশের শাসকরাও উদাহরণ সৃষ্টি করল ২০১৩ সালের শাপলা চত্বর, ২০২৪-এর জুলাই-আগস্ট গণহত্যার মতো আরো কত মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্বরতম অধ্যায়।

আমরা ১৯৪৭ সালে ব্যর্থ হয়েছিলাম শাসনব্যবস্থা ভেঙে নতুন একটি রাষ্ট্রগঠন করতে। যার পরিণতিতে ভাগ হয়ে গেল পাকিস্তান। আমরা ১৯৭১ সালেও ব্যর্থ হয়েছিলাম গণ-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রগঠনে যার ফল ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্ত পরিণতি। আমরা ১৯৯০ সালেও ব্যর্থ হয়েছি রাষ্ট্র নির্মাণে, যার ফলে আমরা দেখেছি কীভাবে একটি দেশ একটি পরিবার ও একটি দলের শোষণ, লুটপাট আর বিদেশে অর্থ পাচারের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।

কীভাবে একটি দেশ প্রতিবেশী দেশের কলোনিতে পরিণত হয়। কীভাবে একটি দেশের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে সমস্ত বাহিনী একটি পরিবার ও লুটেরাদের পাহারাদার এবং ভাগীদারে পরিণত হয়। কীভাবে গুম, খুন আর নির্যাতন চালিয়ে একটি দেশের ১৮ কোটি মানুষকে টানা দেড় দশক ধরে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ রাখা যায়।

যে কারণে ৪৭, ৭১, ৯০-এ এত আত্মত্যাগের পর মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল জুলাই বিপ্লবের পরও সেই একই পথে হাঁটছে দেশ। নতুন করে রাষ্ট্রগঠন এবং নতুন করে পথচলার এত বড় সুযোগও অবলীলায় হাতছাড়া করছে আমাদের বর্তমান রাজনীতিবীদরা।

যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিণত হয় জনগণের অধিকার হরণের হাতিয়ারে, যেখানে অগণিত মানুষের জীবন দেওয়া ছাড়া শাসক পরিবর্তন করা যায় না, সেই ব্যবস্থা বাতিল করে জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রগঠনের এক মহাসুযোগ হাজির হয়েছিল ৫ আগস্ট। এই মহাসুযোগ হাতছাড়া হওয়ার দায় বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের ও দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের।

যেখানে অপরিহার্য ছিল ফ্যাসিবাদের শিকড় উপড়ে ফেলে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা, সেটি করতে পারেননি ছাত্রনেতারা। এটি হলো তাদের সবচেয়ে বড় ভুল। তারা দ্বিতীয় বড় ভুল করেছে নতুন সরকারের উপদেষ্টা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। তাদের তৃতীয় আর আত্মঘাতী ভুল হলো ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেখে যাওয়া রাষ্ট্রপতির অধীনে শপথ নেওয়া এবং ফ্যাসিবাদী সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকার করা। ছাত্রনেতাদের আরেকটি বড় ভুল হলো উপদেষ্টাদের বেশিরভাগের পরিচয় সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হওয়ার পরও তাদের সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া। তাদের পঞ্চম বড় ভুল হলো ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটনের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারা।

পুরোনো গণবিরোধী ব্যবস্থা ভেঙে নতুন রাষ্ট্রগঠনের মহাসুযোগ হাতছাড়া হওয়ার দ্বিতীয় দায় এ দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর। গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে অবস্থান, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে সম্মতি প্রদান, আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দেওয়া ও ফ্যাসিস্ট বলার ক্ষেত্রেও আছে আপত্তি। এছাড়া সংবিধান বাতিল করার বিপক্ষে অবস্থান, ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাষ্ট্রপতিকে বহাল রাখার পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন অনেক রাজনীতিবিদ। পাশপাশি ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের দাবিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা এখন পর্যন্ত যা বলেছেন, তাতে পরিষ্কার, তারা নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ করত চান না। তারা সেই পুরোনো কাঠামোই বহাল রাখতে চান, যেখানে শাসকমাত্রই মনিব আর জনগণ মানে চিরবঞ্চিত গোলাম।

কোনো সন্দেহ নেই, দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের এ অবস্থান জুলাই-আগস্ট বিপ্লবী চেতনা ও গণ-আকাঙ্ক্ষার বিরোধী। পুরোনো কাটাছেঁড়া সংবিধান বাতিল করে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, একটি বিপ্লবী সরকার গঠন এবং নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর এই বিরুদ্ধ অবস্থান জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

অনেক ভুলভ্রান্তির পরও ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে, সংবিধান বাতিল করে একটি বিপ্লবী সরকার গঠনের দ্বিতীয় সুযোগ এসেছিল জাতির সামনে গত অক্টোবর মাসে। কিন্তু সেই সুযোগও কাজে লাগানো গেল না প্রধান রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার কারণে। ভবিষ্যতে যদি আবার এ জাতির ঘাড়ে কোনো ফ্যাসিবাদ চেপে বসে এবং আবার যদি ফ্যাসিবাদ, স্বৈরাচার পতনের জন্য রাজপথে রক্ত দিতে হয় বা এ ধরনের কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তবে তার দায় বহন করতে হবে বর্তমানে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের।

সংবিধান বাতিল করে, জনগণের জন্য নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ করতে না পারলে এ রাষ্ট্র বৃহত্তর জনগণের শত্রু আর প্রতিপক্ষ হিসেবেই থেকে যাবে। ক্ষমতা আলাদিনের চেরাগের মতো ভাগ্য পরিবর্তন করতে থাকবে শুধু গুটিকয়েক মানুষের আর জনগণ চিরকাল বঞ্চিতই থেকে যাবে। সে জন্য দরকার জুলাই-আগস্ট গণ-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা কিন্তু সে সম্ভাবনা আর আছে বলে মনে হয় না।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

কপ-৩০ সম্মেলন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

বন্দর ব্যবস্থাপনা : ভারতের বয়ানে সমালোচনা

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ফ্রন্ট মধ্য এশিয়া

জুলাই বিপ্লবের উচ্ছ্বাস ও সামনের কঠিন বাস্তবতা

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে কিছু প্রস্তাব

চক্রের ফাঁদে পড়েছে চীন আর ভারত

আসল বাউল নকল বাউল

অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শঙ্কা

মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি লবির প্রভাব

ভারত কেন শেখ হাসিনাকে রাখতে চায়?