হোম > মতামত

সুদানে আরেকটি গাজা তৈরি করছে ব্রিটেন

পিটার ওবোর্ন

সুদানে ক্ষমতা দখলে যুদ্ধরত সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) সংঘাত থামার কোনো লক্ষণ নেই। বরং দুই পক্ষের পেছনে থাকা কুশীলবদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী গোষ্ঠীগুলো বলছে, সহিংসতা তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরএসএফের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ব্রিটেনের অস্ত্র বিক্রিও বাড়ছে। দুই দশক আগে আমি দারফুরের তৎকালীন বিদ্রোহী নেতা মিন্নি মিন্নাভির সঙ্গে প্রথম দেখা করি। তখন খার্তুমে তৎকালীন সুদান সরকার সমর্থিত জানজাবিদ মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে দারফুরের জনগণকে রক্ষার চেষ্টাকারী অন্যতম বিদ্রোহী নেতা ছিলেন মিন্নি মিন্নাভি।

গত সপ্তাহে আমি আবার সুদান সফরকালে পোর্ট সুদানে মিন্নাভির সঙ্গে দেখা করি। খার্তুমের পতনের পর পোর্ট সুদান তখন সশস্ত্র বাহিনী এবং এর মিত্রদের প্রতিনিধিত্ব করা ডি-ফ্যাক্টো সরকারের অস্থায়ী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু মিন্নাভি এখন আর বিদ্রোহী নেতা নন, বরং দারফুরের গভর্নর হিসেবে তিনি এখন সরকারের পক্ষে কাজ করছেন।

তবে তার শত্রু এখনো একই রয়ে গেছে। অর্থাৎ মিন্নাভি এখনো জানজাবিদ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করছেন। দুই দশক আগেও এরাই তার মারাত্মক প্রতিপক্ষ ছিল। দারফুর সংঘাত স্তিমিত হওয়ার পর ২০১৩ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকার জানজাবিদ যোদ্ধাদের র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামে একটি আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে একীভূত করার চেষ্টা করে।

২০১৭ সালে সুদানের পার্লামেন্ট আরএসএফকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করার জন্য খসড়া আইন পাস করে। কিন্তু আরএসএফ ও রাষ্ট্রের মধ্যে এই সম্পর্ক টেকসই হয়নি। ২০১৯ সালে গণবিক্ষোভের মুখে ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সামরিক-বেসামরিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি নতুন সরকার গঠিত হয়। তবে দুই বছরের মাথায় সেই সরকারের পতন ঘটে। ২০২১ সালে সেনাবাহিনী ও আরএসএফ মিলে ক্ষমতা দখল করে। এতে নেতৃত্ব দেন সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগাল, যিনি হেমেদতি নামেই বেশি পরিচিত।

পরবর্তী মাসগুলোয় আরএসএফকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা নিয়ে দুজনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং এটি ২০২৩ সালের এপ্রিলে তা প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নেয়। দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর সেপ্টেম্বরে সেনাপ্রধান আল-বুরহান আরএসএফ ভেঙে দেওয়ার জন্য একটি ডিক্রি জারি করেন।

কিন্তু ততদিনে আরএসএফ একটি শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাধ্যমে তাদের সামরিকসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক গোষ্ঠী, যার অন্যতম দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য। সুদান তখন থেকেই একটি প্রক্সি যুদ্ধের কবলে পড়েছে। এই সংঘাতে এ পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি লোক নিহত এবং বহু আহত হয়েছেন। আনুমানিক ১ কোটি ২০ লাখ লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

আরএসএফসহ আধাসামরিক গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, অপহরণ, গণধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, নির্যাতন এবং জাতিগত নির্মূলের অভিযোগ রয়েছে। তারা তাদের এসব বর্বরতার কিছু চিত্র ধারণ করে সেগুলো অনলাইনে প্রকাশও করে। তারা সুদানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লুটপাট এবং ধ্বংস করেছে। রাজধানী খার্তুমের জাতীয় জাদুঘরকে কার্যত ধ্বংস করে ফেলা এর বড় উদাহরণ।

তারা তাদের শত্রুদের জাতিগত বা উপজাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা চুরি, হত্যাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে আরএসএফ রাজধানী খার্তুম দখলের পর হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়।

গত সপ্তাহে ওমদুরমানে নৈশভোজের সময় সুদানি সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াসের আল-আত্তা আরএসএফকে চেঙ্গিস খানের মোগল সেনাবাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, যারা মধ্যযুগে এশিয়া মহাদেশজুড়ে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এই তুলনা কুবই যুক্তিসংগত।

সুদানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও নগর এলাকায় নির্বিচার বিমান হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু তা আরএসএফের মতো একই মাত্রায় নয়। সম্প্রতি আরএসএফ পশ্চিম সুদানের উত্তর দারফুরের রাজধানী এল-ফাশারে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রয়শিবিরসহ সর্বত্র নির্বিচার হামলা চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের তাণ্ডবে এল-ফাশার একটি রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা তাদের নৃশংসতার ভিডিওগুলো যেকোনো মানুষকে দুঃস্বপ্ন দেখানোর জন্য যথেষ্ট। জাতিসংঘ এখন সুদানকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি বলে অভিহিত করেছে। এই নৃশংসতাগুলো দুই দশক আগে দারফুরে পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকা একই ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। জানা গেছে, আরএসএফ সদস্যদের মধ্যে চাদ, মালি এবং লিবিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর ভাড়াটে সৈন্য রয়েছে। বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, তাদের নির্যাতনকারীদের অনেকেই এমন ভাষায় কথা বলত, যা তারা বুঝতে পারতেন না।

‘নীরবতা কেনা হয়েছিল’

দুই দশক আগে হেমেদতি ছিলেন দারফুরে নৃশংসতা চালানো জানজাবিদ যুদ্ধবাজদের একজন। আরএসএফের সামরিক প্রধান হিসেবে তিনি এখন শুধু দারফুর নয়, সমগ্র সুদানকে ধ্বংস করছেন। সুদানের অনেক মানুষের চোখে বর্তমানের এই পরিস্থিতি এলোমেলো সহিংসতার চেয়েও খারাপ। উপ-সেনাপ্রধান আত্তা বলেন, হেমেদতির নেতৃত্বাধীন আরএসএফ যোদ্ধারা জাতিগত স্থানচ্যুতি এবং বর্ণগত কৌশলের একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে ‘জাতিগত এবং বর্ণঅনুসারে’ পরিচয় নির্ধারণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে টার্গেটে পরিণত করছে।

তবে, এ কথাটা স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত যে, এই গৃহযুদ্ধ মূলত দেশটিতে থাকা স্বর্ণ ও তেলের খনিসহ মূল্যবান সম্পদ নিয়ে যেখানে বেসামরিক মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। জেনারেল আত্তা আরএসএফকে সুদানে ‘আমিরাতের স্বার্থ হাসিলের একটি হাতিয়ার’ হিসেবে অভিহিত করে এখানের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ববাসীর নীরবতার নিন্দা জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘এই নীরবতা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থের জোরে কেনা হয়েছে’। তিনি সুদানের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। কারণ দেশটি আরব আমিরাতের মাধ্যমে আরএসএফকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। আর সেই অস্ত্র দিয়ে সুদানে গণহত্যা চালাচ্ছে আরএসএফ। ব্রিটেন একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমালোচনা করা বা দেশটির বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণের বিরুদ্ধেও সক্রিয় রয়েছে।

২০২৪ সালের জুনে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ‘যুক্তরাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা’ সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমালোচনা এবং সুদানে জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনাকারী একটি কুখ্যাত মিলিশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহে তাদের ভূমিকা থাকার অভিযোগ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর অস্বীকার করেছে।

ব্রিটিশ সামরিক সরঞ্জাম আরএসএফের হাতে চলে গেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট আর্মস ট্রেড নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধির অনুমতি দিয়েছে ব্রিটেন। যদিও তারা জানে, আরব আমিরাত আরএসএফের কাছে সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে এবং গ্রুপের যোদ্ধাদের ব্যবহৃত আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ারগুলোতে যুক্তরাজ্যের তৈরি ইঞ্জিন পাওয়া গেছে।

দারফুরে চলমান গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগের জবাবে ব্রিটিশ মন্ত্রীরা শুধু সুদানে আরব আমিরাতের জড়িত থাকার নিন্দা করতেই অস্বীকৃতি জানাননি, তারা এ প্রসঙ্গে আমিরাতের নামও বলতে চান না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সদস্যদের বিতর্কগুলো পরীক্ষা করে এ বিষয়টি দেখা গেছে। কেন তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান, তা অনুমান করা সহজ, কঠিন কিছু নয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটেনের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং ব্রিটেনে বিশাল বিনিয়োগকারী একটি দেশ। ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির মালিক আরব আমিরাতের রাজপরিবারের সদস্যরা।

সুদানে আমাদের ভ্রমণের সময় সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের সঙ্গে এমন গাইড ছিলেন, যারা সুদান সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সুদানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্যও প্রস্তুত ছিলেন তারা। তবে আমরা বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরএসএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা এড়িয়ে চলেছি ভ্রমণের সময়। অন্যদিকে, লন্ডনে সংযুক্ত আরব আমিরাত দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাইনি।

সুদানে বেসামরিক নাগরিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আরএসএফের বর্বর আক্রমণের প্রমাণ যত বাড়ছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত সমর্থিত এবং যুক্তরাজ্যের নীরবে পরিচালিত চলমান গণহত্যার চিত্র ততই স্পষ্ট উঠে আসছে।

মিডল ইস্ট আই থেকে ভাষান্তর :

মোতালেব জামালী

সরকারের মধ্যে একমাত্র সেনাপ্রধানের সাথে সুসম্পর্ক চুপ্পুর

নতুন মুক্তি ও বিজয়

নির্বাচন-পূর্ব শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনের উপায়

ইনকিলাব মঞ্চ ও ইতিহাসের দায়

বিপ্লবী হাদি আমার পরমাত্মীয়

বাংলার মুক্তিযুদ্ধ

বিজয়ের কৃতিত্ব ছিনতাই

বিজয় ও পরাজয়ের সমীক্ষা

বাংলাদেশ বেতারের ৮৫ বছর : মুক্তিযুদ্ধ থেকে গণঅভ্যুত্থান

আ.লীগ ও র-এর এজেন্ডায় পা দিল বিএনপি-জামায়াত