জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও বিজিবি চাইনিজ রাইফেল দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ভূমিকা রাখায় পুলিশকে লাখ টাকা পুরস্কার দেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান।
মঙ্গলবার বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দিতে এ তথ্য তুলে ধরেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এসআই গোলাম কিবরিয়া। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় নির্মাণাধীন ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি ও দুজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি।
জবানবন্দিতে কিবরিয়া বলেন, গত বছর আন্দোলন চলাকালে তিনি রামপুরা থানায় কর্মরত ছিলেন। ১৮ জুলাই রামপুরা থানার বার্তা অপারেটর আব্দুর রহমানের মাধ্যমে জানতে পারেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান আন্দোলন দমনে নিলিং পজিশন ( হাঁটু গেঁড়ে ) চাইনিজ রাইফেল দিয়ে করে ফায়ার করার অনুমতি দিয়েছেন। ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর দুপুর ২টার দিকে রামপুরার বিটিভি ভবনের ৩নং গেটে তার নির্ধারিত ডিউটি ছিল। কিন্তু ওসি মশিউর রহমান সকলকে থানায় অবস্থান করার নির্দেশ দেন। সেদিন জুমার নামাজের পর থানার আশেপাশের এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা জমায়েত হতে থাকেন।
সাক্ষী বলেন, এরপর বেতার অপারেটর আব্দুর রহমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ওসি (অফিসার ইনচার্জ)মশিউর রহমানকে জানান। তিনি তখন বিটিভি ভবন এলাকায় ছিলেন। এরপর ওসি মশিউর রহমান ও তৎকালীন খিলগাঁও জোনের এডিসি মো: রাশেদুল ইসলাম ২টা ৩০ মিনিটের দিকে বিজিবির এপিসি নিয়ে রামপুরা থানায় আসেন। তখন এডিসি রাশেদুল ইসলামের নির্দেশে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার ওপর আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালানো হয়। এই ঘটনায় নাদিম নামের একজন নিহত হন বলে জানতে পারেন। পরবর্তীতে মায়া ইসলাম নামে একজন নিহত ও মুসা খান নামে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে জানতে পারেন।
জবানবন্দিতে সাক্ষী আরো জানান, গত বছরের ২১ বা ২২ জুলাই ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান রামপুরা থানায় এসে গুলি চালিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র জনতা দমনে ভূমিকা রাখায় ওসি মশিউর রহমানের হাতে নগদ এক লক্ষ টাকা পুরস্কার তুলে দেন।
কিবরিয়া বলেন, ঘটনার সময় ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর রামপুরা থানার পাশে একটি নির্মাণাধীন ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা এক ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি করার ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৯শে জুলাই এডিসি রাশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে রামপুরা থানায় মিটিং হয়। মিটিংয়ে ভিডিওটি সকলকে দেখানো হয়। উপস্থিত সকলেই ভিডিওটিতে এসআই তরিকুল ইসলাম ভুঁইয়া ও এসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার নির্মাণাধীন ভবনের কার্নিশে ঝুলন্ত ব্যক্তিকে গুলি করেছিল বলে নিশ্চিত করেন। এসময় সাক্ষী ট্রাইব্যুনাল ডকে এসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারকে শনাক্ত করেন।
এ মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার। সকালে তাকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। চার আসামি পলাতক রয়েছেন। হাবিবুর রহমান ছাড়া পলাতক অপর তিন আসামি হলেন- খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান ও রামপুরা থানার সাবেক এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী (সেস্ট ডিফেন্স) হিসেবে আমির হোসেনকে নিয়োগ করা হয়েছে।
এদিন দুইজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন। ৬ষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন কনস্টেবল মো. আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ান। এই মামলায় যাবতীয় নথিপত্র সংরক্ষণের তথ্য ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন তিনি।
জবানবন্দি দেওয়ার পর সাক্ষীদের জেরা করেন পলাতক তিন আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন ও গ্রেপ্তার চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান নিপ্পন। এদিন ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার, প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও সুলতান মাহমুদসহ অন্যরা।
এই নিয়ে ছয়জন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১০ নভেম্বর দিন দিন ঠিক করেছেন টাইব্যুনাল।
গত ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের মাধ্যমে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন কার্নিশে ঝুলে থাকা গুলিবিদ্ধ হওয়া আমির হোসেন।
১৮ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।