হোম > রাজনীতি

খালেদা জিয়া: গণতন্ত্রের সংগ্রামে অনির্বাণ শিখা

সৈয়দ আবদাল আহমদ

১৯৯১-৯৬ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তৎকালীন উপ-প্রেস সচিব সৈয়দ আবদাল আহমেদ (লেখক) ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের কিংবদন্তি রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়া আর নেই। কোটি কোটি মানুষকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংগ্রামমুখর এক চরিত্রÑখালেদা জিয়া। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে আশির দশকে রাজনীতিতে পদার্পণ করে রাজপথের সংগ্রাম ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা, ষড়যন্ত্র ও প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাবাস ও পরবর্তী সময়ে অসুস্থতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে তার জীবন ।

গত চার দশক ধরে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি আলোকিত ও আলোড়িত করে রেখেছিলেন। দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন ছিলেন তিনি। দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলে পঞ্চমবারের মতো তিনি এ পদে নির্বাচিত হন। খালেদা জিয়ার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব, দেশ ও জনগণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং সহানুভূতি তাকে অতুলনীয় করে তোলে।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে যেমন জেল-জুলুম, নির্যাতন সহ্য ও অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছেন, তেমনি নির্বাচনে দলকে বিজয়ী করেছেন, পূর্ণ মেয়াদে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও দেশের প্রধান নির্বাহী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরবও তিনি অর্জন করেন। অলংকৃত করেন সংসদ নেতার পদ, পার্লামেন্টারি পার্টির সভাপতি, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সার্ক চেয়ারপারসনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের সম্মানজনক আসন। তেমনি দলীয় প্রধানের উচ্চাসন তাকে জাতীয় রাজনীতিতে একচ্ছত্র ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেয়। দেশের মানুষের কাছে তিনি ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি জনগণ তাকে ‘দেশনেত্রী’ সম্বোধনে সম্মান করে। রাজনৈতিক জীবনের খুব কঠিন সময় তিনি পার করেছেন অত্যন্ত ধৈর্যধারণ করে।

খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম, স্বতঃস্ফূর্ত এবং অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। এটা তিনি অর্জন করেছিলেন দেশের প্রতি তার কমিটমেন্ট, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও সহানুভূতি, সামাজিক গুণাবলি এবং মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে খালেদা জিয়া অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে ছিলেন একাত্তরের বন্দিশিবিরে। রাজনীতিতে আসার পর জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সাতবার গৃহবন্দি ছিলেন। ১/১১-এর জরুরি সরকারের সময় কারাবন্দি ছিলেন। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী আমলে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দীন রোডের নির্জন কারাগারে বন্দিত্বের দিনগুলো অবর্ণনীয় নির্যাতনে কাটিয়েছিলেন।

প্রথম জীবন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অভিজ্ঞতা

খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়ি জেলায় (বর্তমান দিনাজপুর) একটি সম্ভ্রান্ত ও সচ্ছল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন ইস্কান্দার মজুমদার। মাতা ছিলেন তৈয়বা মজুমদার। এই পরিবারের আদি বাড়ি ছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ফেনী জেলায়। খালেদা জিয়ার ডাকনাম পুতুল। তার বড় দুই বোন এবং ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বোন ও এক ভাই বেঁচে নেই। পিতা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। ভাইবোনের জীবন আনন্দ ও সুখের ছিল। খালেদা জিয়া লেখাপড়া করেন দিনাজপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। ১৯৬০ সালে তৎকালীন সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাদের দুই ছেলে তারেক রহমান পিনো ও আরাফাত রহমান কোকো। ২০১৫ সালে কোকোর অকাল মৃত্যু হয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি জনগণের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি আর্মি অতর্কিত হামলা শুরু করে। ওই সময়ে মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে কর্মরত। ওই রাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। সে লক্ষ্যে তিনি তার অধীনস্থ এবং অনুগত বাঙালি সামরিক অফিসার ও জওয়ানদের একত্রিত করেন এবং বলেন, ‘উই রিভোল্ট (We revolt)- আমরা বিদ্রোহ করলাম।’ এরপর কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই ভাবে দেশের অন্যান্য অংশে কর্মরত আর্মি, ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস), পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও একযোগে বিদ্রোহ করেন। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। জিয়াউর রহমান ছিলেন এক নম্বর রণাঙ্গনের অধিনায়ক ও জেড ফোর্সের প্রধান।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের অংশগ্রহণ করার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামে স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন খালেদা জিয়া। সেখানে ছিল এক ধরনের নিরুপদ্রব জীবন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তার সে জীবন পাল্টে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ তার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখা দেয়। এ সময় দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি দিন কাটিয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত আত্মগোপনে থেকেছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকার আনাচে-কানাচে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন নিরাপদ জীবনের লক্ষ্যে। কিন্তু পাকিস্তানিদের শ্যেন দৃষ্টি এড়াতে পারেননি। গ্রেপ্তার হয়ে বন্দিশিবিরে যাওয়ার পর নতুন শঙ্কা দেখা দেয়। তিনি জানতেন না, তাকে অন্য বন্দিদের মতো মেরে ফেলা হবে বা স্বামীকে জীবনে আর কোনোদিন দেখতে পাবেন কি না? প্রায় ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ চলার পর অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়।

একাত্তরের বন্দিশিবির থেকে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। স্বামী জিয়াউর রহমানও মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফেরেন বীরের বেশে। স্বাধীনতা পাওয়ার সেই মুহূর্তটি ছিল খালেদা জিয়ার জীবনে এক বিরল অভিজ্ঞতা। সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তির সেই স্বাদই ছিল আলাদা। স্বামী-সংসার নিয়ে আবার আনন্দের পথচলা। সুখেই কাটতে থাকে তাদের জীবন।

১৯৭২ সালের জুন মাসে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একটি সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন এবং তার একদলীয় বাকশাল সরকারের পতন ঘটে। নতুন প্রেসিডেন্ট হন আওয়ামী লীগেরই নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ আগস্ট সেনাপ্রধান হন। একই বছরের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে গিয়ে দেশে এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করেন। তারই ইন্ধনে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে সেনানিবাসের বাসভবনে বন্দি করা হয়। বলা যায় কয়েকদিন দেশ চলে সরকারবিহীন অবস্থায়। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয় সিপাহী-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গনমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। এ লক্ষ্যপূরণে সহায়ক রূপে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯ দফা বৈপ্লবিক কর্মসূচির ভিত্তিতে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির স্লোগান নিয়ে দেশব্যাপী শুরু হয় দলটির যাত্রা। এরপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিয়াউর রহমান বিপুল ভোটে দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হন। তার বহু সাফল্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল বাংলাদেশের তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করা। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ ও বাকশাল শাসনামলে বাংলাদেশ মাসের পর মাস যে দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে তিনি দেশকে মুক্ত করেন। সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে চালু করেন বহুদলীয় গণতন্ত্র।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম

১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হলেও খালেদা জিয়া একজন সাধারণ গৃহবধূ হিসেবে তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে সাংসারিক কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হলেও আড়ালে থাকতেই তিনি ভালোবাসতেন। সেই তাকেই একদিন গৃহকোণ থেকে রাজপথে এসে দাঁড়াতে হলো। সে এক করুণ এবং একই সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস। প্রেসিডেন্ট জিয়া দুদিনের সফরে সাংগঠনিক কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। তিনি অবস্থান করছিলেন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। খালেদা জিয়া দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে ছিলেন। সেটি ছিল এক কালো রাত। ১৯৮১ সালের ৩০ মের সেই কালো রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সেনাবাহিনীর একটি কুচক্রী মহলের হাতে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জিয়া মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। এই করুণ মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া তার প্রেমময়ী স্বামীকে চিরতরে হারালেন। এই মৃত্যু তার মনে গভীর দাগ সৃষ্টি করে। হৃদয়ে সৃষ্টি করে চির তাজা এক ক্ষত ও দুঃখ। তবে এই করুণ মৃত্যু তাকে এনে দেয় প্রবল এক শক্তি এবং সসম্মানে ও সাহসিকতার সঙ্গে বেঁচে থাকার এক অনন্য প্রেরণা এবং প্রত্যয়। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে তার তেজোদীপ্ত নেতৃত্ব থেকে বিএনপি যখন বঞ্চিত হয়েছে, তখন দলের নির্ভরযোগ্য কোনো উত্তরাধিকারী নির্ধারিত ছিল না। ফলে খালেদা জিয়াকে একরকম বিএনপির নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর দলের নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের প্রবল আগ্রহ ও চাপে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আসেন। রাজনীতিতে অভিসিক্ত হয়ে তিনি দলের সব সারির নেতৃত্বকে সুসংঘবদ্ধ করেন এবং দলকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করে সর্বসম্মতভাবে দলের প্রধান নির্বাচিত হন। স্বামীর মৃত্যুতে শোকার্ত অবস্থায় খালেদা জিয়া এভাবেই বিএনপির হাল ধরেন।

১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এরপর ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৪ সলের ১০ মে দলীয় নির্বাচনে হন পার্টির প্রথম নির্বাচিত চেয়ারপারসন।

রাজনীতিতে পদার্পণের পরপরই তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বন্দুকের নলের মুখে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন জারি করেন। এরশাদের সামরিক সরকার বিএনপি নেতাদের ঢালাও গ্রেপ্তার করে দলে একের পর এক ভাঙনের অপচেষ্টা চালান। এ অবস্থায় একদিকে দল রক্ষা ও দল পুর্নগঠন, অন্যদিকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কঠিন দায়িত্ব এসে পড়ে নতুন নেত্রী খালেদা জিয়ার ওপর। স্বৈরশাসন অবসানের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে তার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। এ জোট গঠন করে খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ৯ বছরব্যাপী আন্দোলনে এরশাদের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে আপস করেননি। অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এরশাদের সঙ্গে সমঝোতা করলেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি কোনো সমঝোতায় যায়নি। তাই তখন তার উপাধি হয় ‘আপসহীন নেত্রী’। তিনি তার নীতিতে অবিচল থাকেন।

এরশাদ সরকার তখন বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞামূলক আইন প্রয়োগ করে খালেদা জিয়ার গতিবিধি সীমাবদ্ধ রাখে। এতে তিনি দমে যাননি। স্বৈরাচার এরশাদের সরকার উৎখাত আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে যেতে থাকেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগসহ অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় জেনারেল এরশাদ তার শাসনকে একটি বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার শাসনামলে সব নির্বাচন বয়কট করেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেনÑ‘যারা এরশাদের নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা হবে জাতীয় বেঈমান।’ ওই ঘোষণার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে স্বঘোষিত জাতীয় বেঈমান হিসেবে দেশবাসীর কাছে চিহ্নিত হয়। খালেদা জিয়ার দাবির যথার্থতা ক্রমেই মানুষ বুঝতে পারে। দেশের স্বার্থে অত্যন্ত সততার সঙ্গে খালেদা জিয়া এমন আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার ফলে শেখ হাসিনা এবং তার দলও বুঝতে পারে এরশাদ সরকারের সঙ্গে নৈকট্যের দরুণ তাদের জনবিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। ফলে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগও সংসদ ছেড়ে এরশাদ হটাও আন্দোলনে যোগ দিতে বাধ্য হয়। দেশব্যাপী তুমুল গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং দুদিন পর ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি নির্দলীয় অন্তবর্তী সরকারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এরশাদ আমলে এভাবেই খালেদা জিয়া রাজনীতি ও সংগ্রামে ওই যে এলেন আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাননি। এগিয়েই গেছেন রাজনীতির মহাসড়ক ধরে। এরশাদ স্বৈরাচারের পতনই ছিল ওই মহাসড়কের পাশে একটি গন্তব্য। আবার শেখ হাসিনা সরকারের (১৯৯৬-২০০১) দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে চারদলীয় ঐক্যজেট গঠিত হয় তারই নেতৃত্বে। খালেদা জিয়া ও চারদলীয় জোটের বক্তব্য ছিলÑআওয়ামী লীগ সরকার দেশে দুঃশাসন চালাচ্ছে ও দুর্নীতি করছে, তাই ভোটের মাধ্যমে তাদের সরাতে হবে। ২০০১ সালে ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করেন তিনি। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তার দল যেমন জনগণের ভোটে বিস্ময়করভাবে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তেমনি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর চারদলীয় ঐক্যজোট নীরব ভোট বিপ্লবে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। ২০০৭ সালে ১/১১-এর জরুরি সরকার দেশকে রাজনীতিশূন্য করতে যে পদক্ষেপ নেয়, ওই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ করে দেন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদ এবং বর্তমান অবৈধ সময়ের ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেখ হাসিনার ধূর্ত কর্তৃত্ববাদী শাসন তাকে রাজনীতি থেকে একেবারে সরিয়ে দেওয়ার নীল নকশা বাস্তবায়ন করে। এরই অংশ হিসেবে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দিয়ে তাকে জেলে বন্দি ও নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। জেলে যাওয়ার আগে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষকে শরিক হওয়ার ডাক দিয়ে যান তিনি।

দেশ পরিচালনায় খালেদা জিয়া

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাকে শপথ পাঠ করান। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ষষ্ঠ সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হিসেবে ১৯৯৬ সালের মার্চে দ্বিতীয় দফায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তার ওই সরকারটি ছিল সংক্ষিপ্ত সময়ের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে পাস করার জন্য সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে একটি নিয়মরক্ষার নির্বাচন হিসেবে ওই নির্বাচন করা হয়। আর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হওয়ার পর ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

১৯৯১-৯৬ মেয়াদে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ওই সময় দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার সংবিধানে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনে। যমুনা সেতুর মতো বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় খালেদা জিয়া সরকারের হাতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বহুদলীয় গণতন্ত্র, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সমাজ বিকাশ বিশেষত শিক্ষা তথা নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ওই সরকারের সাফল্য অনন্য। একই ভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার ওই সরকার ছিল অগ্রগণ্য। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়ার সরকার সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে।

২০০১ থেকে ২০০৬Ñওই পাঁচ বছরে খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের উন্নয়নমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশ-বিদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়। শিক্ষা, বিশেষত নারীশিক্ষার অভূতপূর্ব প্রসার, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, গ্রামের মানুষের হাতে মোবাইল ফোন, শহরে গার্মেন্ট এবং অন্য ছোট ও মাঝারি সাইজের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষত আবাসনশিল্পে মানুষের কর্মসংস্থান, বিদেশে কর্মসংস্থান, বৈদেশিক বিনিয়োগÑএসবের ফলে বাংলাদেশের নতুন পরিচিতি হয় ইমার্জিং টাইগার বা উদীয়মান বাঘ।

এরশাদ জান্তা ও শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের নির্যাতন-নিষ্পেষণ

জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। ওই সংগ্রামে তাকে সইতে হয় নির্মম অত্যাচার। সাতবার তাকে গৃহবন্দি করা হয়। রাজপথে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ বাহিনীর লাঠিচার্জের শিকার হন। কাঁদানেগ্যাসের শেল তার শরীরে আঘাত করে। গ্যাসের ঝাঁজালো ধোঁয়া ছুড়ে মারা হয় তার চোখ-মুখে। সে সময় তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়।

স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ঘোষণা দেনÑ‘এক মুহূর্তের জন্যও খালেদা জিয়াকে শান্তিতে থাকতে দেব না।’ কথা অনুযায়ী কাজও করেন শেখ হাসিনা। তার ডাকা ১৭৩ দিনের হরতাল-অবরোধ, অসহযোগ এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ে খালেদা জিয়া শেষের দিকে ঠিকই শান্তিতে আর দেশ চালাতে পারেননি। তার সরকারকে পদে পদে বিপর্যস্ত করা হয়। দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেওয়া হয়। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীলও করা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বিরোধী দল বিএনপির ওপর প্রচণ্ড দমনপীড়ন চালান। হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলা দেওয়ার পাশাপাশি বিএনপির ৬০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুলি ও টিয়ারশেল মেরে পল্টনে খালেদা জিয়াকে গুরুতর আহত ও তার জনসভা পণ্ড করে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক আক্রোশে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলাও দেওয়া হয়।

খালেদা জিয়াকে ১/১১-এর আঁতাতের সরকারের ভয়াবহ নির্যাতন

আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জেনারেল মইন-মাসুদ গংদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের অশুভ প্রক্রিয়ায় ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে বলেন, এ সরকার তার আন্দোলনের ফসল। ওই জরুরি সরকারের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। কুচক্রীরা প্রথমে তাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য বিদেশে সপরিবারে নির্বাসনে পাঠানোর অপচেষ্টা চালায়। ওই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে তাকে বিনা অপরাধে ছয় মাস ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দি রাখা হয়। পরে গ্রেপ্তার করে এক বছর নির্জন কারাগারে বন্দি রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে চারটি মামলা দেওয়া হয় এবং চালানো হয় সীমাহীন কুৎসা ও অপপ্রচার। শুধু খালেদা জিয়াই নন, তার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তারেক রহমানের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়। বন্দি থাকার কারণে মা তৈয়বা মজুমদারের মৃত্যুর সময়ও পাশে থাকতে পারেননি তিনি। তাকে গুরুতর অসুস্থ দিই সন্তানকে দেখতেও দেওয়া হয়নি। এক বছর পর প্যারোলে মুক্তি পেলেও পরিবার থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখন পর্যন্ত তিনি ছেলে, ছেলের বউ ও নাতনিদের নিয়ে একত্রে থাকতে পারছেন না। নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনই করতে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে।

জরুরি সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে বলপূর্বক খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে এক কাপড়ে উচ্ছেদ করা হয়। বাড়িটি ছিল স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ঠিকানা। বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সারা দিন তিনি অভুক্ত ছিলেন। অথচ খালেদা জিয়ার নামে তৎকালীন সংসদ বাড়িটি বরাদ্দ দিয়েছিল। এ দেশের জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ডিওএইচএস বা সামরিক আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে অনেক কর্মকর্তাকে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন। নিজে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েও ডিওএইচএসে কোনো প্লট বরাদ্দ নেননি। অন্য কোথাও তার নিজের নামে একখণ্ড জমিও ছিল না। তাই শাহাদাতের পর রাষ্ট্র তার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করেছিল এবং সেটা সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে। ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগও ছিল। কিন্তু প্রতিহিংসার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বাড়ির বরাদ্দও বাতিলের ব্যবস্থা করেন। মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাধীন থাকাকালে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর অকাল মৃত্যু হয়। সে সময় মা খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। তার লাশ দেশে আসে। লাশ জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না মায়ের। তবে কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষ শরিক হয়ে এ কথাই জানিয়ে দেয়Ñজিয়া পরিবারের পাশে বরাবরের মতোই তারা আছেন। কোকোর লাশ বনানীর সামরিক কবরস্থানে দাফনের জন্য আবেদন করা হলে সেখানে সাড়ে তিন হাত জায়গাও তার ভাগ্যে জোটেনি। অথচ কোকোর পিতা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক, সাবেক সেনাপ্রধান এবং নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। দেশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই তিনি শাহাদাতবরণ করেন। সেনা পরিবারের সদস্য হিসেবে কোকোর বনানী সামরিক কবরস্থানে দাফনের অধিকার ছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার তাকে প্রাপ্য সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে।

অবৈধ শেখ হাসিনার সরকারের নির্যাতন ও প্রতিহিংসা

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করেন। এর অংশ হিসেবেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন খালেদা জিয়া। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তিনি নির্বাচন চান। কিন্তু বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যায়। নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়া জনগণকে জাতীয় পতাকা হাতে ঢাকায় মার্চ করার কর্মসূচি আহ্বান করেন। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ওই কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দেয়। খালেদা জিয়ার বাসভবনের সামনে বালুর ট্রাক রেখে তাঁকে অবরুদ্ধ করা হয়। ওই দিন বাসভবন থেকে তিনি বেরিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে বেরোতে দেওয়া হয়নি। ফলে গেটে দাঁড়িয়েই তিনি বক্তৃতা দেন। তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ রেখেই ৫ জানুয়ারি অস্ত্র ও গুলির মুখে একতরফাভাবে প্রহসনের নির্বাচনি তামাশা করা হয়।

৫ জানুয়ারির ভুয়া নির্বাচনের পর ওই সরকারকে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচনের জন্য এক বছর সময় দেন খালেদা জিয়া। সে সময় তিনি কোনো কর্মসূচি দেননি। কিন্তু সরকার নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যায়। ২০১৫ সালে গণতন্ত্র হত্যা দিবসকে সামনে রেখে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি দেন খালেদা জিয়া। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা হয়। ডজনখানেক ইট ও বালুর ট্রাক রেখে এবং গেট তালাবদ্ধ করে প্রথমে তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। বের হতে চাইলে তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পিপার স্প্রে বা মরিচের গুঁড়া। এরপর তাকে দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। বিচ্ছিন্ন করা হয় তার অফিসের বিদ্যুৎলাইন, ডিশলাইন, ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক । তার ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনের নামে কখনো ভাড়া করা লোক, কখনো দলীয় ক্যাডার ও স্কুলের শিশুদের জোরপূর্বক এনে উৎপীড়ন করা হয়। নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বে তথাকথিত শ্রমিক-পেশাজীবীদের নামে দলীয় লোক দিয়ে কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি, গুলশান অফিস লক্ষ্য করে ইট-ককেটল নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে তাকে হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা করা হয়। সরকার কতটা অমানবিক, তার নিষ্ঠুর উদাহরণ দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ও তার সঙ্গের লোকদের অভুক্ত রাখার জন্য গুলশান অফিসে খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়। শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী খালেদা জিয়াকে ‘খুনি, ‘জঙ্গি, সন্ত্রাসী, দানব, আঁততায়ী, আলকায়েদা, আইএস’Ñমুখে যখন যা এসেছে তাই বলেছে। তার মতো একজন বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে এ ধরনের গালমন্দ ও বাক্য উচ্চারণে তাদের এতটুকু বুক কাঁপেনি কিংবা বিবেকে বাধেনি।

সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে খালেদা জিয়ার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি সরকারই নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের পথে নিয়ে যায়। একই ভাবে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম ও দমনপীড়ন চালিয়ে স্তব্ধ করে দেয় আন্দোলন। রাজপথে নামার চেষ্টা করলেই গুলি চালিয়ে কিংবা ধরে নিয়ে দৈহিক নির্যাতন করা হয়। এভাবে বহু নেতাকর্মীকে পঙ্গু করা হয়। পুলিশ-র‌্যাব ও বিজিবির পাহারায় সরকার একদিকে যানবাহন নামায়, অন্যদিকে যানবহনে আগুন ও পেট্রোল বোমা মেরে সাধারণ মানুষকে নিহত এবং দগ্ধ করে। রাজারবাগে কর্মকর্তাদের একটি গোপন বৈঠকে পুলিশের এক বড় কর্মকর্তা নাশকতায় পুলিশের জড়িত থাকার কথা নিজেই স্বীকার করেন, যা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমেও প্রচার হয়। ওই সময় নাশকতার সঙ্গে অস্ত্র-গুলি ও বোমাসহ শাসক দলের ক্যাডাররা ধরা পড়লেও উপরের নির্দেশে ছাড়া পেয়ে যায়।

অবশেষে দীর্ঘ ৯২ দিন পর গুলশান অফিসের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত হন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘোষণা করলে ওই নির্বাচনে তার সমর্থক প্রার্থীরা অংশ নেন। খালেদা জিয়া তাদের সমর্থনে জনসংযোগে বের হলে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, ফকিরেরপুল ও উত্তরা এলাকায় সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। ওই নির্বাচনকেও প্রহসনে পরিণত করা হয়।

নীল নকশার অংশ হিসেবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ভিত্তিহীন মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের হাস্যকর সংসদ নির্বাচনটি সম্পন্ন করা হয়। ওই নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট প্রদান প্রায় সম্পন্ন করা হয় ব্যালট বাক্স দলীয় ক্যাডার ও পুলিশ দিয়ে ভর্তি করার মাধ্যমে। এটা ছিল খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে চিরতরে মাইনাস করার নীল নকশারই অংশ। নাজিমুদ্দিন রোডের নির্জন কারাগারের স্যাঁতসেঁতে কক্ষে তাকে বন্দি রাখা হয়। দুই বছরের বেশি সময় বন্দি রাখার পর করোনা মহামারির কারণে তার সাজা স্থগিত রেখে শর্তযুক্ত অস্থায়ী জামিন দেওয়া হয়। তিনি এখন গুরুতর অসুস্থ। ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, উচ্চরক্তচাপ, চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। দুবার হাঁটুতে এবং একবার চোখে অপরাশেন হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর ফুসফুস এবং জটিল কিডনি সমস্যায়ও তিনি জর্জরিত। কিন্তু তাকে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেয়নি সরকার।

রাজনৈতিক জীবনের অসামান্য রেকর্ড

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন খালেদা জিয়া। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বেশ কয়েকটি রেকর্ড গড়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি একমাত্র প্রার্থী হিসেবে পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন থেকে অষ্টম নির্বাচন পর্যন্ত চারটি নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে প্রার্থী হয়ে চারবারই পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন। নবম সংসদ নির্বাচনে তিনটি আসনে দাঁড়িয়ে তিনটিতেই জয়লাভ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার বাইরে বিরোধীদলীয় নেত্রী থেকে আবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রথম রেকর্ডটি তিনিই সৃষ্টি করেন। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরবও তিনি অর্জন করেন। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়াই সর্বোচ্চ ভোট পান। বগুড়া-৬ আসনে দুই লাখ ২৭ হাজার ৩৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মাহবুব আলম ভোট পান ৫৪ হাজার ৭৭৭। অর্থাৎ এক লাখ ৭২ হাজার ৫৭৩ ভোটের ব্যবধানে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর সর্বোচ্চ ভোটের মাধ্যমে রেকর্ড স্থাপনের এমন নজির অতীতে দেখা যায়নি।

দেশ সম্পর্কে অনুভূতি

তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আলোকিত করে আছেন খালেদা জিয়া। রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র ঘুরেছেন। বাংলাদেশকে অসম্ভব ভালোবাসেন তিনি। এই লেখকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ আমার মা জননী জন্মভূমি। এই দেশ সবদিক থেকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক, মনেপ্রাণে আমি চাই। আর আমিইবা কেন, নিজের দেশের মঙ্গল কে না চায় বলুন।’ ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে তাকে যখন জেলে নেওয়া হয়, তার ঠিক আগে আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশই আমার ঠিকানা। বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরতে চাই।’ ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জেল থেকে বেরিয়ে আবার বললেন, ‘গত দেড় বছর আমার দেশ ও আমার জনগণের দুঃখ-কষ্ট আমাকে ভীষণ পীড়া দিয়েছে। নিশ্চয়ই এই দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। আবার আমরা উঠে দাঁড়াব। ঐক্যবদ্ধভাবেই দেশকে গড়ে তুলব।’

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ

২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর সংবাদ জানার পর ওই দিন সন্ধ্যায় খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু গেট বন্ধ থাকায় তিনি সেখানে ঢুকতে পারেননি। নিঃসন্দেহে সেটি ছিল ভুল। গুলশান অফিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছোট ছেলের মৃত্যুতে খালেদা জিয়া এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে, ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। ওই কথা প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে আগেই জানানো হয়েছিল। তবুও প্রধানমন্ত্রী যখন এসে পড়েছেন, খালেদা জিয়া অচেতন থাকলেও তার কর্মকর্তা কিংবা দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো প্রয়োজন ছিল। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য পরদিন এজন্য ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বিবৃতির মাধ্যমে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানান।

নিজের অজান্তে ভুলটি হলেও ওই একটি উদাহরণ ছাড়া রাজনীতির ৩৩ বছরে খালেদা জিয়ারই আছে বিনয় আর উদারতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি হয়েছিল। এর প্রতিবাদে সাত দল ও ১৫ দলের কর্মসূচি ছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বে শোক মিছিল। কিন্তু শোক মিছিলে সেদিন শেখ হাসিনা আসেননি, খালেদা জিয়া ঠিকই এসেছিলেন। তেমনি ১৯৮৬ সালের ২০ মার্চ বায়তুল মোকাররম থেকে সাত দল ও ১৫ দলের এরশাদবিরোধী কর্মসূচি ছিল দুই নেত্রীর নেতৃত্বে বায়তুল মোকাররম থেকে যৌথ গণমিছিল। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে ওই মিছিলেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৬ সালে এরশাদের পাতানো নির্বাচনের পর সাত দল ও ১৫ দলের ঐক্য ভেঙে যায়। ১৯৮৮ সালে আবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ খালেদা জিয়াই নিয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি শেখ হাসিনাকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে পহেলা বৈশাখে ছুটে গিয়েছিলেন ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে। শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিয়েতে যোগ দিতে এমপি হোস্টেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। শেখ হাসিনা তাকে রিসিভ করেননি কিন্তু সেনাকুঞ্জে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের বিয়েতে শেখ হাসিনা এলে গাড়ি থেকে নামার পর খালেদা জিয়া দুবারই সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে তাকে স্বাগত জানান এবং একসঙ্গে পাশাপাশি বসে খাবার খান ও ছেলের বউকে দেখাতে নিয়ে যান। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে হজ করে এসে শেখ হাসিনাকে জায়নামাজ, তসবিহ, আতর ও খেজুর পাঠান। আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সমবেদনা জানাতে সুধা সদনে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের প্রবল আপত্তির মুখে যেতে পারেননি। এক-এগারোর জরুরি সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে তোলার সময় কোর্ট প্রাঙ্গণে তার যে দুর্ভোগ হয়, পুলিশ তাকে যেভাবে হেনস্তা করে, বিবৃতি দিয়ে তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। তেমনি শেরেবাংলা নগরের সাব-জেলে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার চোখের অসুখ বেড়ে গেলে কোর্টে হাজিরা দিতে গিয়ে খালেদা জিয়া তার বক্তৃতায় তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সরকারকে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। জরুরি শাসনের অবসানের পর অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। সে সময় শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর সংবাদে খালেদা জিয়া গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং শোক জানাতে ছুটে যান ধানমন্ডির সুধা সদনে। সেখানে তিনি শেখ হাসিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সমবেদনা জানান। রাজনীতিতে এ ধরনের সৌজন্যবোধ এবং সংস্কৃতিতেই বিশ্বাসী খালেদা জিয়া।

নতুন সংগ্রামেও বিজয় অনিবার্য

নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন ও ১/১১-এর মইন-মাসুদ চক্রের সেনাসমর্থিত সরকারের বিরাজনীতিকরণের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অসামান্য নারী খালেদা জিয়া হিমালয়সম দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই দৃঢ়তাই অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত হতে শক্তি জুগিয়েছিল। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন। অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সব ‍দুর্যোগ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে খালেদা জিয়া নিজেকে অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বালন করে রেখেছিলেন। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সাজানো মিথ্যা মামলায় তাকে দণ্ড দেওয়া হলে জেলে যাওয়ার আগে তিনি দেশবাসীকে বলে যান, বিপদে ভেঙে পড়তে নেই। বিপর্যয় কেটে যাবে। দেশের ছাত্র-জনতা কখনোই অন্যায় মেনে নেয়নি এবং নেবে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেই। গণতন্ত্রের বিজয় আসবেই। তার সে কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। খালেদা জিয়া মুক্ত হয়েছেন, গণতন্ত্রের বিজয় এসেছে। খালেদা জিয়া মাদার অব ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের মাতার সম্মান পেয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। মহান আল্লাহ অসামান্য এই মানুষকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন।

তথ্য নির্দেশ:

সৈয়দ আবদাল আহমদ, নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া, দিব্য প্রকাশ ২০১৩।

মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশে গনতন্ত্র (১৯৯১-২০০৬),ইউপিএল ২০১৫

শফিক রেহমান, খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবন, অন্য দিগন্ত, ২০১৫

মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি-সময় অসময়, প্রথমা প্রকাশন ২০১৬

সৈয়দ আবদাল আহমদ, লুৎফর রহমান বীনু, গনতন্ত্রের সংগ্রাম ১৯৯২

সিরাজুর রহমান, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২০১৩

দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক প্রথম আলো (বিভিন্ন সংখ্যা)

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও দৈনিক আমার দেশ এর নির্বাহী সম্পাদক।

খালেদা জিয়ার জানাজা পড়াবেন বায়তুল মোকাররমের খতিব

খালেদা জিয়াকে আল্লাহ জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন: জামায়াত আমির

স্লো পয়জনিং করা হয়েছিল খালেদা জিয়াকে

খালেদা জিয়ার আপসহীন ভূমিকা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে

মাকে নিয়ে আবেগঘন পোস্ট তারেক রহমানের

বিএনপির বৈঠকে নির্বাক তারেক রহমান

মিথ্যা মামলায় ২৫ মাসের কারাবাসে বিপন্ন হয় খালেদা জিয়ার জীবন

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দায় আছে: আইন উপদেষ্টা

বাংলাদেশ একজন দরদি অভিভাবক হারাল : ইনকিলাব মঞ্চ

আল্লাহ সব আপসহীনদের নিয়ে যাচ্ছেন : জুমা