হোম > ধর্ম ও ইসলাম

ইসলাম ও বাউল দর্শন

ইব্রাহীম খলিল সবুজ

বাংলাদেশে বাউলবাদ শব্দটি একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। দীর্ঘ সময় ধরে তারা গান, বৈরাগ্য ও আধ্যাত্মিক সাধনার নামে গ্রামীণ সমাজে একটি স্বতন্ত্র স্থান দখল করে এসেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানদের একাংশ, বাউলসম্প্রদায় সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় তাদেরকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত বা সুফিবাদের কোনো ব্যতিক্রমধর্মী শাখা বলে মনে করে। বাস্তবে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঐতিহাসিক গবেষণা এবং তাদের তত্ত্ব-দর্শনের গভীর বিশ্লেষণে এই ভুল ধারণা ভেঙে যায়। বাউলরা প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রচলিত শাস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারী নন। এটি একটি মিশ্র ধর্মীয় বিশ্বদর্শন। যা হিন্দু সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া, নাথধর্মের যোগ, তান্ত্রিক কায়াসাধনা এবং বৈষ্ণব ভাবধারা–সবকিছুর সমন্বয়ে গঠিত একটি মিলিত আধ্যাত্মিক ধারণা। লালন ফকিরের মতো বাউল শ্রেষ্ঠরা হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজের গোঁড়া রক্ষণশীলতা দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার পরই প্রচলিত প্রথাগত অনুশাসন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা থেকে এই স্বতন্ত্র মানবধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলেন।

তারা ঘোষণা করেছেন, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তি ইসলামের বেড়া ভেঙে তারা নিজেদের মনের মতো করে পথ তৈরি করে নিয়েছেন। এই নিজস্ব পথে তারা মসজিদ বা মন্দিরে উপাসনা করেন না, ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্রের বিধান মানেন না, এমনকি সামাজিক বিবাহবন্ধন ও মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতিতে দাফন বা দাহ কার্যও সম্পন্ন করেন না। বাউল দর্শনের মূল কথা হলো শরিয়তকে অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান করা। তাদের শিক্ষায় আল্লাহ, নবী, কুরআন বা শরিয়ত-কানুনের বাধ্যতামূলক আনুগত্য নেই। অথচ ইসলামের মূল কথা হলো আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং তাঁর প্রেরিত বিধান তথা শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণ। শরিয়তের এই প্রত্যাখ্যানই বাউল মতকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

এই ধর্মের মূল ভিত্তি হলো 'দেহতত্ত্ব', অর্থাৎ দেহকেন্দ্রিক দর্শন । তাদের মতে, দেহের বাইরে আলাদা কোনো পরমসত্তা নেই; বরং দেহের মধ্যেই আল্লাহ, কৃষ্ণ, ব্রহ্মা, পরমাত্মা—সব সত্তার মিলন ঘটে। তাই দেহকে বলা হয় 'দেউল' বা 'ভাণ্ড-ব্রহ্মাণ্ড'। এভাবেই ‘আনাল হক’ বা নিজেকে ঈশ্বরতুল্য ভাবার চিন্তাধারার জন্ম হয়। যদিও তারা আরবি ও ইসলামি পরিভাষা ব্যবহার করেন, জীবনাচরণে তারা মূলত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। ইসলামে আল্লাহ্ অদ্বিতীয়, অনাদি এবং সৃষ্টির ঊর্ধ্বে। স্রষ্টার সত্তাকে সৃষ্টির সঙ্গে একীভূত মনে করা বা নিজেকে ঈশ্বরতুল্য ভাবা ইসলামের মৌলিক আকিদার সঙ্গে চূড়ান্তভাবে সাংঘর্ষিক। এটি সরাসরি শিরক, যা ইসলামে সর্বোচ্চ অপরাধ। এই দর্শনে ইসলামের তাওহিদ ও রিসালাত এই দুটি স্তম্ভই বাতিল হয়ে যায়। কারণ যদি স্রষ্টা দেহের মধ্যেই নিহিত থাকেন, তবে বাইরের কোনো শরিয়ত বা নবীর বিধানের প্রয়োজন থাকে না। দেহসাধনাই তখন একমাত্র ইবাদত হয়ে ওঠে।

বাউলদের সাধনা পদ্ধতিও বিতর্কের জন্ম দেয়, যা মূলত গুহ্য এবং গুরু-নির্ভর বা ‘গুরুমুখী বিদ্যা’। তারা বিশ্বাস করেন, গুরুর নির্দেশ ছাড়া আত্মজ্ঞান লাভ কঠিন। ইসলামে যেখানে চূড়ান্ত মানদণ্ড কুরআন ও সুন্নাহ, সেখানে বাউল গুরুবাদ গুরুর হাতেই পরিত্রাণের চাবি তুলে দেয়। অধিকন্তু, একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে, যাদের সঙ্গে সহবাস ছাড়া সাধনা অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। বাউল সাধনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ‘যুগল গুপ্ত সাধনা’। এতে নারী অপরিহার্য ‘সাধন সঙ্গিনী’ হিসেবে বিবেচিত।

তাদের লক্ষ্য হলো প্রাকৃত কাম বা জাগতিক যৌন বাসনাকে অতিক্রম করে অপ্রাকৃত প্রেম বা রস অর্জন করা, যাকে তারা 'আরোপ-তত্ত্ব' বা 'রসসাধন' নামে অভিহিত করেন। এই সাধন প্রক্রিয়ায় তন্ত্র-নির্ভর বামাচারী যোগ-ক্রিয়ার আশ্রয় নেওয়া হয়, যার মধ্যে 'চারিচন্দ্র ভেদ' বা 'লতা সিদ্ধি'র মতো গুহ্য আচার অন্তর্ভুক্ত। গবেষকরা স্পষ্ট করেছেন, বাউল বা তান্ত্রিক সাহিত্যে 'লতা' শব্দটি নারীর যৌনাঙ্গের পারিভাষিক অর্থ বহন করে। বাউলরা এই ধরনের যৌনাচারকে ভক্তি ও উপাসনার একটি পবিত্র অনুষ্ঠান বললেও, প্রচলিত ধর্মশাস্ত্র এবং ইসলামের নৈতিকতা ও শরিয়তি বিধানের সঙ্গে এটি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। ইসলামের কঠোর নৈতিক কাঠামো বিবাহ-বহির্ভূত বা গোপন যৌনাচারকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না।

বাউলগানের কথায় অনেক সময় ‘আত্মা’, ‘মনের মানুষ’, ‘ভালবাসা’, ‘রহস্য’, ‘দেহের সাধনা’—এসব আধ্যাত্মিক শব্দ ব্যবহার হয়। কিন্তু সেগুলো ইসলামি আধ্যাত্মিকতার (তাযকিয়া, ইহসান, তাওবা, জিকির) সঙ্গে সম্পর্কহীন। বরং এগুলো তন্ত্র, দেহসাধনা ও সর্বেশ্বরবাদী উপমার ওপর ভিত্তি করে রচিত।

তারা মদ্যপানকে উশৃঙ্খলতার কারণ মনে করলেও গাঁজা ও তামাক সেবনকে ধ্যানের সহায়ক বলে গ্রহণ করে। বৈরাগ্যবাদী জীবনযাপনের অংশ হিসেবে তারা সাধারণত অগোছালো, জটাধারী ও সাদাসিধে পোশাকে চলাফেরা করে। এমনকি কিছু বাউল রোগমুক্তির জন্য নিজ মূত্র পান করে এবং এক ধরনের ‘প্রেমভাজা’ নামক পদার্থ (যা মানবদেহের নিষ্কাশিত পদার্থ দ্বারা প্রস্তুত) সেবন করে থাকে। সুতরাং, বাউলরা একটি স্বতন্ত্র ও জটিল তত্ত্বভিত্তিক সম্প্রদায়, যাদের বিশ্বাস ও আচরণ প্রচলিত ইসলামি আকিদা ও আমল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের জীবনাচরণ, উপাসনাপদ্ধতি ও দর্শন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

বাউলরা তাদের এই গুহ্য সাধন-পদ্ধতি ও বিতর্কিত জীবনাচরণকে আড়াল করতে একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের গানে 'আল্লাহ', 'রাসূল', 'আদম-হাওয়া', 'আনাল হক' ইত্যাদি আরবি ও ইসলামি পরিভাষা প্রতীক বা রূপক অর্থে ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে সুফী সাধক বা মরমী পথের অনুসারী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, যাতে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বিভ্রান্ত হন এবং তাদের বিকৃত দর্শনকে আধ্যাত্মিকতা বলে ভুল করেন। এই কৌশলটি সরল বিশ্বাসী মানুষের ঈমানকে লক্ষ্য করে তৈরি হওয়া একটি ফিতনা।

বাংলার মাটি বৈচিত্র্যে ভরপুর। বাউলরা আমাদের ইতিহাসের অংশ, কিন্তু তারা ইসলামের অংশ নয়। বাউলগান আমাদের লোকসংস্কৃতির অংশ হতে পারে। তাদের সুর, তাদের ভাষা, তাদের আবেগ—সবই সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু ধর্মীয় সত্যের প্রশ্নে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট ও আপসহীন।

ইসলামের দৃষ্টিতে ঈমান ও আকিদাই মুসলমান হওয়ার মানদণ্ড। কেউ যদি আল্লাহ, রিসালাত, পরকাল, শরিয়ত ও ইসলামের মৌলিক বিধান অস্বীকার করে, তার মুসলিম নাম বা পারিবারিক পরিচয় ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো মূল্য বহন করে না। তাই মুসলমানদের জন্য তাদের আকিদা, আচার ও গান–গজল থেকে বিরত থাকা এবং সমাজকে সঠিক জ্ঞান দিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া, তাওহিদের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা– ঈমানি দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ভূমিকম্প আল্লাহর সতর্কবার্তা

নারী সাহাবির ঐতিহাসিক বিয়ে ও মোহর

মসজিদুল হারাম ও নববীতে একমাসে ৬ কোটি মুসল্লি

শুক্রবার ঢাকায় শুরু হচ্ছে ২৪তম আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলন

কোরআন হিফজ করলেন ৭০ বছরের সৌদি নারী

ভূমিকম্পের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে যে সূরায়

ভূমিকম্প নিয়ে কোরআন ও হাদিসে কী সতর্কতা এসেছে

সারা দেশে ভূমিকম্প, যা বললেন আজহারী

ভূমিকম্প হলে যে দোয়া পড়বেন

অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতে ইসলামের তাগিদ