হোম > বিশ্ব

বেনজির ভুট্টোর আমলে আইএসআই-তালেবানের সম্পর্কের শুরু যেভাবে

আমার দেশ অনলাইন

প্রায় ৩০ বছর আগে পাকিস্তানের একজন প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো একটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। সম্পর্কটি ছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের খুবই ছোট একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে।

ওই সময় সীমান্তের দুই পাশের কেউই ধারণা করতে পারেননি, পরের তিন বছরের মধ্যে তালেবান নামে পরিচিত ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানের প্রায় পুরোটায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে।

পাকিস্তান সরকার কী এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার ফলে আইএসআই ও তালেবানের মধ্যে প্রথমবার যোগাযোগ হয়েছিল? তালেবান সম্পর্কে আইএসআইয়ের তখনকার প্রধানের ধারণা কী ছিল?

সম্প্রতি সীমান্ত সংঘর্ষ, কথার লড়াই এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের মধ্যে একাধিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্লেষকদের অনেকেই এ উত্তেজনাকে একটি পুরানো সম্পর্কের অবসানের সূচনা হিসেবে দেখছেন। আর এ জন্য গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে পাকিস্তানের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে।

ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্নের উত্তরটি যদিও আগামী দিনের ঘটনা দ্বারা নির্ধারিত হবে। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা কেন ও কীভাবে হয়েছিল, সেটার উত্তর অবশ্যই রয়েছে।

স্টিভ কোলের একটি বই রয়েছে, নাম ‘ঘোস্ট ওয়ারস’। বইটিতে লেখক ২০০২ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেনজির ভুট্টোর একটি মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন।

লেখক জানান, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী (বেনজির ভুট্টো) তাকে বলেছিলেন, বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ নিজ দেশের জন্য লাভজনক হবে বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ায় তুলা, জ্বালানি পণ্য ও ইলেকট্রনিকস পণ্য পাঠানোর কথা বিবেচনা করছিলেন।

১৯৯৪ সাল, সোভিয়েত বাহিনী সবে আফগানিস্তান ছেড়ে গেছে। ওই পরিস্থিতিতে দেশটি গৃহযুদ্ধের কবলে পড়েছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তখন একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে।

প্রতিটি শহর ও অঞ্চল কোনো এক পক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বেনজির ভুট্টোর সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন করা মোটেও সহজ ছিল না।

স্টিভ কোলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘বেনজির ভুট্টো আফগানিস্তান ইস্যুতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সমন্বয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন। এ দলে সাবেক মেজর জেনারেল ও তার (বেনজির) সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ খান বাবর ছিলেন’।

তবে নাসিরুল্লাহ খান বাবর বিশ্বাস করতেন, কাবুলের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যের প্রয়োজন নেই পাকিস্তানের। এর বদলে তিনি কান্দাহার ও হেরাতের মধ্য দিয়ে একটি দক্ষিণাঞ্চলীয় বাণিজ্য পথের প্রস্তাব করেন। বিকল্প প্রস্তাবটি বেনজির ভুট্টোর বেশ পছন্দ হয়।

নাসিরুল্লাহ বাবর ও হামিদ গুলের সাথে বেনজির ভুট্টো। ছবি : সংগৃহীত

স্টিভ কোল লিখেছেন, ‘বেনজির ভেবেছিলেন, তার সরকার পশতুন সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোয় রাস্তাঘাট বানানো, টেলিফোন লাইন স্থাপন এবং অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। স্থানীয় আফগান কমান্ডারদের অর্থ দিয়ে দক্ষিণ আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়ায় পাকিস্তানের বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত করা যেতে পারে।’

তিনি আরো লিখেন, এ ব্যাপারে আইএসআইয়ের কোনো দ্বিমত ছিল না বলেও বেনজির তাকে জানিয়েছিলেন।

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আগা হুমায়ুন আমিন তার লেখা ‘পাকিস্তান আর্মি থ্রু দি আইস অব পাকিস্তানি জেনারেলস’ বইয়ে নাসিরুল্লাহ খান বাবরের একটি সাক্ষাতকার ছাপেন। বইয়ে তিনি লিখেন, ‘নাসিরুল্লাহ খান বাবর তাকে বলেছিলেন, পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি বাণিজ্য পথ বানানো, যেটা দিয়ে ট্রাক ও ট্রেনে করে পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে।’

পুরো প্রক্রিয়াটিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, মধ্য এশিয়ায় থাকা জ্বালানির মজুত। মেজর আগা হুমায়ুনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাসিরুল্লাহ খান বাবর সেটা নিশ্চিত করেন।

পাকিস্তানি ট্রাকগুলো যখন আফগানিস্তানে থামে

স্টিভ কোলের বইয়ে বলা হয়েছে, এ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন নাসিরুল্লাহ খান বাবর নিজেই। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম বহরটি আফগানিস্তানে যায়। ওই বহরের কয়েকটি ট্রাকে পাকিস্তান থেকে টেক্সটাইল পণ্য নেওয়া হয়। এ নিয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাভেদ আশরাফ কাজী। ছবি : সংগৃহীত

স্টিভ কোল বলেন, পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে যাত্রা করা বহরটি আফগানিস্তানের কান্দাহার হয়ে তুর্কমেনিস্তানে পৌঁছাবে বলে আশা করেন নাসিরুল্লাহ খান।

ওই সময় আইএসআইয়ের প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাভেদ আশরাফ কাজী। ২০২১ সালে পাকিস্তানের একটি বেসরকারি টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক এ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ট্রাকগুলো তুলা নিয়ে পাকিস্তানে ফিরছিল।

তার মতে, পাকিস্তানে তুলার ঘাটতি থাকার কারণে এ বাণিজ্য বহরের উদ্দেশ্য ছিল, সস্তায় সড়কপথে তুলা নিয়ে আসা। এর আগে মধ্য এশিয়া থেকে পাকিস্তানে সমুদ্রপথে তুলা আমদানি করা হতো।

যাই হোক, জাভেদ আশরাফ কাজী বলেন, ‘হেরাত থেকে কান্দাহারের পথে থাকার সময় স্থানীয় একজন কমান্ডার ওই বহর থামান। ট্রাকগুলোয় লুটপাট করেন। তুলাসহ ট্রাকগুলো দখল করে নেন। বহরের লোকজনকে বন্দি করেন।’

তালেবানের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ

জাভেদ আশরাফ কাজী বলছেন, ‘খবরটি যখন পাকিস্তানে এসে পৌঁছায়, নাসিরুল্লাহ খান বাবর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জানান, ওই জায়গার কাছাকাছি তালেবান রয়েছে। তাদের (তালেবান) ব্যবস্থা নিতে এবং অপহৃত ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে কথা বলা উচিত। এরপর আমরা তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। নাসিরুল্লাহ খানও তার নিজস্ব সূত্রে তালেবানের সঙ্গে কথা বলেন।’

তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর। ছবি : সংগৃহীত

উল্লেখ্য, জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে নাসিরুল্লাহ খান বাবর আইজিএফসি ছিলেন। ওই সময়ই কিছু বিদ্রোহী আফগান কমান্ডারকে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আগা হুমায়ুনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাসিরুল্লাহ খান নিজেই এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

জাভেদ আশরাফ কাজী বলেন, ‘তারা (তালেবান) বলল, আচ্ছা, আমরা দেখছি। এরপর তারা ব্যবস্থা নিয়েছিল। অপহরণকারী কমান্ডারের লোকজন দ্রুত পালিয়ে যায়। আর তালেবান তুলাসহ ট্রাকগুলো এবং অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মুক্ত করে দেয়।’

পাকিস্তান ও আফগান তালেবানের মধ্যে সেটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ, বলছেন জাভেদ আশরাফ কাজী। যদিও এ পদক্ষেপের বিনিময়ে তালেবানকে কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হয়নি।

মার্কিন দূতাবাসের গোপন চিঠি

ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাসের লেখা একটি গোপন চিঠি পরে প্রকাশিত হয়েছে। তালেবান ফাইলসের অংশ হিসেবে ওই চিঠি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংরক্ষণাগার প্রকাশ করেছে।

১৯৯৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লেখা ওই চিঠিতে ঘটনাটি সম্পর্কে উল্লেখ আছে। তবে কিছুটা ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

তালেবানের একজন জ্যেষ্ঠ সূত্র আর মার্কিন দূতাবাসের একজন রাজনৈতিক কর্মকর্তার মধ্যে কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘তালেবান মনে করছে, যখন সশস্ত্র যোদ্ধারা মধ্য এশিয়া থেকে আসা একটি পাকিস্তানি বাণিজ্য বহরকে স্পিন বোলদাক এলাকায় কয়েকদিন আটকে রাখে, তখন পাকিস্তান তাদের গুরুত্ব দিতে শুরু করে।’

তালেবানের ওই সূত্রের বরাতে মার্কিন গোপন চিঠিতে বলা হয়, ‘কান্দাহার থেকে পাকিস্তানি বাণিজ্য বহরের রওনা দেওয়ার বিষয়টি নাসিরুল্লাহ খান বাবর তালেবানকে জানাননি। কান্দাহার থেকে অন্য কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।’

যাই হোক, পাকিস্তানের তরফ থেকে যোগাযোগ করার পর, তালেবান ওই বহরকে কান্দাহারের মধ্য দিয়ে যেতে দিতে রাজি হয়। পথে স্থানীয় কমান্ডারদের দ্বারা বসানো অবরোধ ও প্রতিবন্ধকতাগুলো সরাতে শুরু করে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, পথের প্রায় প্রতি কিলোমিটারে অবরোধ ও প্রতিবন্ধকতা বসানো হয়েছিল বলে তালেবানের ওই সূত্রটি মার্কিন কর্মকর্তাদের জানান। তবে যখন তারা অপসারণের কাজ শুরু করেন, কেউই বাধা দেয়নি।

তালেবানের শুরুর গল্পটা

এটাই কি তালেবানের ক্ষমতার সূচনা ছিল? সেটা অবশ্য পাকিস্তান ও তালেবানের মধ্যে প্রথমবার যোগাযোগ হওয়ার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশ করা একটি গোপন নথিতে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালের গ্রীষ্মে কান্দাহারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এরপর মোল্লা ওমর নামে স্থানীয় একজন মাদরাসা শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে কিছু সশস্ত্র তালেবান মাইওয়ান্দ এলাকায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজি বশির নূরজাই।

স্টিভ কোল বলছেন, শুরুর দিকে তালেবানকে যারা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে হামিদ কারজাই ছিলেন। তিনি পরে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ওই সময়ে তার সঙ্গে শ দুয়েক লোক ছিল। মনে রাখা দরকার, হাজি বশির নূরজাই দুই বছর আগেই কারাগার থেকে বের হয়েছেন। একজন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ারের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা হয়েছিল।

চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, তালেবানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে যাওয়া দ্বিতীয় এলাকাটি ছিল স্পিন বোলদাক। এখানেই তালেবানেরা মাটির নিচের সূড়ঙ্গ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিল। এটা তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

যদিও এই অস্ত্রের বিপুল মজুত খুঁজে পেতে তালেবানকে কে সহায়তা করেছিল, সেটা নিয়ে মতভেদ রয়ে গেছে। কোনো কোনো সূত্র আইএসআইএর নাম বলে থাকে।

তবে স্টিভ কোলের মতে, তালেবানই সম্ভবত এটা খুঁজে পেয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শেষে স্থানীয় কমান্ডারদের সহায়তায় এই মজুত গড়ে তোলা হয়েছিল, যা ১৭টি সুড়ঙ্গে লুকানো ছিল।

স্টিভ কোল আরো বলেন, তাকে এক সাক্ষাৎকারে জাভেদ আশরাফ কাজী বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর অর্ধেককে সরবরাহ করার মতো ওই সুড়ঙ্গগুলোয় পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল’।

আহমেদ রশিদের বই ‘পাকিস্তান অ্যান্ড দ্য তালেবান’-এ দাবি করা হয়েছে, সুড়ঙ্গগুলোয় ১৮ হাজার কালাশনিকভ ছিল।

জাভেদ আশরাফ কাজী এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, পাকিস্তান ওই সুড়ঙ্গগুলোর কথা জানত। এটাও জানত যে, সেখানে রাশিয়ার অস্ত্র লুকানো আছে। আরো জানা ছিল, ‘সেগুলো মোল্লা আব্দুল সালাম রক্তি নামে একজন আফগান কমান্ডারের প্রভাবে ছিল। তিনিই পরে লুকানো সেসব অস্ত্র তালেবানের হাতে তুলে দেন’।

অন্যদিকে মার্কিন প্রতিবেদন বলছে, লুকানো অস্ত্রভাণ্ডারটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পাকিস্তানের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার কথা তালেবানের একজন সূত্র অস্বীকার করেছেন।

মোল্লা ওমরের সহযোগী বশির নূরজাই। ছবি : সংগৃহীত

তবে এটা স্পষ্ট যে, লুকানো অস্ত্র ভাণ্ডার খুঁজে পাওয়া আর দখলে নেওয়ার ঘটনায় তালেবানের অভিযানগুলো গতি পায়। ওই বছরের নভেম্বরে তারা কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়। সেখানকার বিমানবন্দরে তালেবান ছয়টি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ও চারটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টারের সন্ধান পায়।

আইএসআই প্রধানের সতর্কবার্তা

স্টিভ কোল বলছিলেন, বেনজির ভুট্টো হঠাৎ করে আফগানিস্তানে একটি নতুন শক্তির উত্থান দেখতে পান। আর এ শক্তি নিরাপদ ও টেকসই বাণিজ্যের জন্য মধ্য এশিয়ার পথ খুলে দিতে পারে। একই সময়ে, জাভেদ আশরাফ কাজীও প্রথমবারের মতো তালেবানের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেন।

এ বৈঠক সম্পর্কে জাভেদ আশরাফ কাজী পাকিস্তানের একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘মোল্লা ওমর ওই প্রতিনিধি দলে ছিলেন না। তার সহকারী মোল্লা রব্বানী প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আরো তিন-চারজন ছিলেন। আমি লক্ষ করেছি, প্রত্যেকেরই কিছু শারীরিক অক্ষমতা ছিল। কারও হাত নেই, কারও-বা পা নেই।’

‘তারা আফগানিস্তানকে পরিচ্ছন্ন করতে চেয়েছিলেন। তারা আমাকে নিরপেক্ষ থাকার অনুরোধ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, তাদের টাকাপয়সা আর অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। বরং তারা খাবার আর জ্বালানি চেয়েছিলেন,’ বলেন জাভেদ আশরাফ কাজী।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ‘তালেবানের তখনকার অভিযানে পাকিস্তানের অন্য কোনো ভূমিকা ছিল না। আমরা কী ঘটছে, তা পর্যবেক্ষণ করছিলাম।’

বিবিসির সঙ্গে কথা বলার সময়ও জাভেদ আশরাফ কাজী ওই বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানের সংঘাতে পাকিস্তানকে মূলত নিরপেক্ষ থাকতে অনুরোধ করেছিল তালেবান। সেই সঙ্গে তারা পাকিস্তান সরকারের কাছে তাদের জন্য দরকারি রেশন আর জ্বালানির জন্য বলেছিল। কারণ, এ দুটোই পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে পৌঁছায়। তাই এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত হবে না।’

স্টিভ কোলের মতে, ওই সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আফগানিস্তানে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের দলকে সমর্থন ও সহায়তা করছিল।

১৯৯৪ সালের ৬ ডিসেম্বর ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস একটি গোপন চিঠিতে জানায়, আইএসআই তালেবানকে সহায়তা করছে না বলে একজনকে বলেছেন জাভেদ আশরাফ কাজী। তবে তিনি তালেবানকে সমর্থন না করার বিষয়ে তার দেশের সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন।

কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘তারা (তালেবান) একটি বিপজ্জনক ও অনিয়ন্ত্রিত শক্তিতে পরিণত হতে পারে, যা আফগানিস্তান এমনকি পাকিস্তানের জন্যও ক্ষতির কারণ হতে পারে।’

ওই চিঠির শেষে লেখা হয়, ‘যে ব্যক্তি জাভেদ আশরাফ কাজীর কথোপকথন সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন, তিনি একজন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র। তিনি কথোপকথন ঠিকঠাকভাবে আমাদের কাছে জানাননি, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।’

মার্কিন দূতাবাসের চিঠিতে উল্লেখ থাকা কথোপকথনের বিষয়ে জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে জাভেদ আশরাফ কাজীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তার জবাব ছিল, ‘ওই সময়ে এমন কোনো আলাপের কথা আমি মনে করতে পারছি না।’

জ্বালানি, যন্ত্রপাতি ও অর্থ

এর পরও আমেরিকার গোপন চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সন্দেহ নেই যে, তালেবানরা কোনো না কোনো উৎস থেকে সমর্থন পাচ্ছে।’

‘ঘোস্ট ওয়ারস’ বইয়ে বেনজির ভুট্টোকে উদ্ধৃত করে স্টিভ কোল লিখেছেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মতে, প্রথম বৈঠকের পর পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের কাছ থেকে গোপনে সহায়তা করার অনুরোধ আসতে থাকে। জ্বালানি দিয়ে এটা শুরু হয়। ধীরে ধীরে তা যন্ত্রপাতির দিকে এগিয়ে যায়। তারপর পাকিস্তান অর্থ দিতে শুরু করে।’

এই অর্থ, প্রশিক্ষণ আর যন্ত্রপাতি তালেবানকে পাকিস্তানের পক্ষে রাখতে সহায়তা করবে বলে আইএসআই কর্তারা বেনজির ভুট্টোকে বলেছিলেন। আর বেনজির ভুট্টো নিজে তাকে এ কথা বলেন বলে লিখেছেন স্টিভ কোল।

বেনজির ভুট্টোর বয়ান দিয়ে স্টিভ কোল লিখেছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন, ‘আমি অর্থ ছাড়তে শুরু করেছি। কিন্তু একবার অনুমতি দেওয়ার পরও আমি জানি না যে তাদের কত দেওয়া হয়েছিল। শুধু জানি যে, পরিমাণটা অনেক ছিল।’

বিবিসির পক্ষ থেকে যখন তৎকালীন আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাভেদ আশরাফ কাজীর কাছে বেনজির ভুট্টোর ওই কথোপকথন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি সুস্পষ্ট জবাব দেন, তার আমলে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর কাছে তালেবানকে সহায়তা করার জন্য অর্থ বা অন্য কিছু চেয়ে কোনো অনুরোধ করা হয়নি।

জাভেদ আশরাফ কাজী বলেন, ‘তালেবানদের অভিযানে পাকিস্তানের অন্য কোনো ভূমিকা ছিল না। আমরা কী ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করছিলাম।’

জাভেদ আশরাফ কাজীর মতে, শুরুতে কান্দাহার ও পরে হেরত দখল করার মধ্য দিয়ে তালেবান সরকারি কোষাগারে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়।

১৯৯৫ সালের অক্টোবরে আইএসআই প্রধান হিসেবে জাভেদ আশরাফ কাজী তার মেয়াদ শেষ করেন। এ পদে তার স্থলাভিষিক্ত হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসিম রানা। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেনজির ভুট্টো নিজেও একই অবস্থান নিয়েছিলেন।

এর মানে হলো, আফগান সংঘাতে পাকিস্তান মোটাদাগে নিরপেক্ষ ছিল। ১৯৯৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে ভাষণ দিতে গিয়ে বেনজির ভুট্টো বলেছিলেন, ‘আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমরা কখনোই আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। দেশটিতে আমাদের কোনো পছন্দ নেই।’

পরের বছর, ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন সফরকালে বেনজির ভুট্টোর কাছে তালেবানকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমরা তালেবানদের সমর্থন করছি না। আমি এমন অভিযোগ অস্বীকার করছি।’

এর মাত্র তিন দিন আগে, তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

বেনজির ভুট্টো আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘অতীতে পশ্চিমা বিশ্ব পাকিস্তানের মাধ্যমে আফগানিস্তানে অর্থ ও অস্ত্র পাঠাত। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা এমন নয় যে, আমরা তালেবান কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠীকে অর্থ, অস্ত্র বা যেকোনো ধরনের সহায়তা দিতে পারব।’ সূত্র : বিবিসি বাংলা

ভারতে মারা গেলেন ‘হাসিনা’

ভারতে ট্রাক চাপায় নিহত ১৩

নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচন: জরিপে এগিয়ে মামদানি

যেভাবে আগামী বছর নোবেল পেতে পারেন ট্রাম্প

বিশ্বের প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকায় আবারো ড. ইউনূস

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক আগাম ভোট

ইসরাইলি হামলায় পশ্চিম তীরে দুই ফিলিস্তিনি নিহত

তেহরানের খেলনা জাদুঘর, শৈশবের স্মৃতিময় ভুবন

রাশিয়ার সহযোগিতায় ৮ পরমাণু বিদ্যৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে ইরান

ইরানে ভয়াবহ খরা, তেহরানে তীব্র পানি সংকটের আশঙ্কা