চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের রাজস্থানের বিকার শহরের একটি গির্জায় প্রায় ২০০ জন উগ্রবাদী জনতা অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় প্রার্থনাকারীদেরকে তারা লোহার রড দিয়ে মারধর করে। হামলায় ভীত যাজকের পরিবারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ তোলা হয়েছে। এদিকে, ভারতের পুলিশও কোনো কিছু যাচাই না করেই ভুক্তভোগীদেরকেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে গির্জার সদস্যরা জানিয়েছিলেন, পুনরায় প্রতিশোধমূলক হামলার ভয়ে তারা কোনো অভিযোগ দায়ের করতে চাননি।
ভারতের মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কাশ্মীরিদের জন্য এমন ভয়, এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
ভারতের মুসলিম এলাকাগুলোতে প্রায়ই ভাঙচুর, পুলিশি অভিযান, আটক এবং ক্রমবর্ধমান হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর পাশাপাশি খ্রিস্টানদের গির্জাগুলোতেও হামলা এবং প্রার্থনা সমাবেশগুলোতে আক্রমণের খবর এসেছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক সংহতি ঘটেছে ভারতে, যা এখন হিন্দুত্ববাদ নামেও পরিচিত। এখানে ধর্মান্ধতার এখন প্রতিদিনের স্বাভাবিক বিষয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠায় প্রতিনিয়তই রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষ করে গত দুই বছরে, চরমপন্থা, জনবিদ্বেষ এবং বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে।
এমন অবরোধের অনুভূতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ভারতের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, মুসলিমরা ১৪ শতাংশ নিয়ে বৃহত্তম সংখ্যালঘু আর খ্রিস্টানদের সংখ্যা ২ শতাংশেরও বেশি।
ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের ক্ষমতায় রয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে সংখ্যালঘুদের এত সংকটাপন্ন অবস্থা কেন? সংখ্যালঘুদের এই পরিস্থিতির জন্য কোন রাজনৈতিক ও আদর্শিক শক্তি কাজ করছে?
নিয়মতান্ত্রিক ঘৃণা এবং গোঁড়ামি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চরমপন্থার এমন উত্থান, নতুন করে বৃদ্ধি পেয়েছে এমনটি নয় বরং এটিকে আরো সংহত করা হয়েছে।
সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ অর্গানাইজড হেট (সিএসওএইচ) এর নির্বাহী পরিচালক রাকিব নায়েক টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ‘আজ আমরা যা দেখছি তা ঘৃণামূলক বক্তব্যের কোনও ঘটনাগত বৃদ্ধি নয়, বরং তা একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়ার পূর্ণতা, যা এখন প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সাথে কাজ করে।’
তিনি ভারতের আজকের ঘৃণ্য পরিবেশকে গত দশকের সঙ্গে ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্যের তুলনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম-বিরোধিতার ঘৃণা এবং গোঁড়ামি এখন উগ্র ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।’
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা গোষ্ঠী ইন্ডিয়া হেট ল্যাব (আইএইচএল) এর ট্র্যাকিং অনুসারে, ২০২৩ থেকে ২০২৫ সালে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের লক্ষ্য করে সহিংসতার জন্য সরাসরি প্রকাশ্য ঘোষণা বা আহ্বান করার পাশাপাশি সমন্বিত ডিজিটাল প্রচারণা করা হয়েছে। এছাড়াও দলীয় মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুর ভাষা ব্যবহার করেছেন বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতারা। এর মাধ্যমে মূলত রাষ্ট্র-সমর্থিত এমন ধ্বংসযজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের আগ্রাসনকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে।
আইএইচএলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালে ভারতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বক্তব্য ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত বিগত বছরের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ঘটনাগুলো আরও বেড়ে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্বেগজনক এই বৃদ্ধি মূলত ক্ষমতাশালী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং বৃহত্তর হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আদর্শের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।
তাদের এই দলটি নরেন্দ্র মোদির সমাবেশে করা সেই ঘৃণ্য মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়, যেখানে তিনি মুসলিমদের ‘অধিক সন্তানধারী অনুপ্রবেশকারী বলে উল্লেখ করেছিলেন। মোদি দাবি করেছিলেন, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস জয়ী হলে, ভারতের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করবে।
জুন মাসে মোদি টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় জোট সরকারে যোগ দিতে বাধ্য হন। এক দশকের মধ্যে এবারই প্রথমবারের মতো বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
আইএইচএল জানিয়েছে, গত বছর ঘৃণামূলক বক্তব্যের ৮০ শতাংশ ঘটনা ঘটেছে বিজেপি এবং তার মিত্রদের দ্বারা শাসিত রাজ্যগুলোতে। এর উদাগরণ- উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং মধ্য প্রদেশ।
ভয়ের পরিবেশ
নয়াদিল্লি-ভিত্তিক ইউনাইটেড ক্রিশ্চিয়ান ফোরাম (ইউসিএফ) মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা, ভারতে প্রতিদিন দুইজনেরও বেশি খ্রিস্টানের উপর আক্রমণের ঘটনা রেকর্ডে করেছে। সংস্থাটি বলেছে, গত দশকে এই গোষ্ঠীটি আক্রমণের ঘটনা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি হয়েছে। যেখানে ২০২৪ সালে ৮৩৪টি ঘটনা রেকর্ড করার বিপরীতে ২০১৪ সালে ছিল মাত্র ১২৭টি আক্রমণের ঘটনা। আর এগুলো শুধু ওই ধরনের আক্রমণ যা সরকারি রেকর্ডে স্থান পেয়েছে, তার মানে অনেক ঘটনাই খুব সম্ভবত রেকর্ডে আসেনি। যার পিছনে রয়েছে অপরাধীদের জন্য দায়মুক্তির পাশাপাশি রাজনৈতিক সুরক্ষার পরিবেশে এবং প্রতিশোধের ভয়ে ভুক্তভোগীদের নিশ্চুপ থাকা।
ইউসিএফের জাতীয় আহ্বায়ক এসি মাইকেল বলেছেন, ‘যদি এই প্রবণতা অবিলম্বে বন্ধ না করা হয়, তাহলে এটি ভারতের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মাতৃভূমির পরিচয় এবং অস্তিত্বকে হুমকিতে ফেলবে।
তিনি উত্তর ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং মধ্য ভারতের ছত্তিশগড়কে ঘৃণা ও নৃশংস সহিংসতার আতুড় ঘরের পাশাপাশি ব্যাপক সামাজিক অবক্ষয়ের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
হিন্দু থেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়াদের হিন্দু ধর্মে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়ার পাশাপাশি শারীরিকভাবে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়।
অনেক নিম্ন বর্ণের হিন্দু বা দলিত, যারা অস্পৃশ্য নামেও পরিচিত। তারা হিন্দু ধর্মের বৈষম্যমূলক নিম্ন সামাজিক মর্যাদা থেকে মুক্তি পেতে অনেক ক্ষেত্রেই খ্রিস্টধর্মে বা ইসলাম ধর্মান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করে।
এর বিপরীতে উদাহরণস্বরূপ, সেপ্টেম্বরে ছত্তিশগড়ের বিলাসপুরে, একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে খ্রিস্টানদের প্রার্থনা সভায় মব আক্রমণ করে উগ্রপন্থি জনতা। সেখানে প্রার্থনাকারীদের বিরুদ্ধে ‘জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ’ এর অভিযোগ তোলে। এসময় কমপক্ষে ১৩ জন আহত হয় এবং অন্যদিকে রাজ্যের ধর্মান্তর বিরোধী আইনের অধীনে একাধিক এফআইআর দায়ের করা হয়।
আইনি কাঠামো
ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়েকটি ধর্মান্তর বিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে, যাদের বেশিরভাগই বিজেপি শাসিত। তবে, খ্রিস্টানদের মতে তাদেরকে লক্ষ্যবস্তু করার হিন্দু গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আইনগুলোতে বলা হয়েছে, কেউ জোর করে, প্রতারণা করে বা প্রলোভনের মাধ্যমে, অন্য কাউকে তাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম থেকে ভিন্ন ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারবে না।
এই আইনগুলোর মধ্যে কিছু আইন অনুসারে, অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো নিয়মিতভাবেই এই আইনগুলির অধীনে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করে। অন্যদিকে, পুলিশ প্রায়ই প্রাথমিক কোনো প্রমাণ ছাড়াই এই অভিযোগগুলি নথিভুক্ত করে এবং তার বিপরীতে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারও করে থাকে।
একই সাথে, অন্যান্য অনেক আইনও শুধু মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে: এর মধ্যে একটি হল ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। যেখানে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে আসা অনথিভুক্ত অমুসলিম অভিবাসীদের দ্রুত নাগরিকত্ব প্রদান করে । কিন্তু যদি তারা মুসলিম হন তাহলে তারা এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস এটিকে ‘মৌলিক বৈষম্য’ বলে অভিহিত করেছে এবং তবে সুপ্রিম কোর্টে এর সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে, ২০১৯ সালে ৩৭০ ধারা বাতিল করেছে ভারতের সরকার। ধারাটি মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরকে যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিল। বাতিলের ফলে রাজ্যগুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এর বিপরীতে সরকার রাজনৈতিক অবরোধ দেয় রাজ্য দুটিতে, যেখানে হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন হয়। এর পুরোটাই ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে সুরক্ষার নামে নাটকীয়ভাবে সংবিধান পরিবর্তনের স্পষ্ট উদাহরণ।
রাকিব নায়েক সতর্ক করে বলেছেন,‘রাষ্ট্রীয় নীতি, ঘৃণ্য গোঁড়ামি এবং উগ্রবাদীদের সহিংসতার মধ্যে সীমানা প্রায় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।’
হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মুহূর্ত
নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক অজয় গুদাভার্তি- ২০২৪ সালকে, ইতিহাস নির্ণয়ের এক বাঁক হিসেবে চিহ্নিত।
যদিও নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির টানা তৃতীয় মেয়াদে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতির মধ্যপন্থী হওয়ার আশা করা হয়েছিল, কেননা দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস পেয়েছে এবং এখন জোটের মিত্রদের উপর নির্ভরশীল। তবে এর পরিবর্তে, গুদাভার্তি উল্লেখ করেছেন যে, অন্য কিছু ঘটেছে:
তিনি জানিয়েছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও মিঃ মোদী এবং তার দল তাদের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। যা প্রমাণ করে নির্বাচনী ফলাফল যাইহোক না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির সামাজিক সম্মতি থেকে বিচ্ছিন্ন।’
অন্য কথায় বলা যায়, হিন্দু জাতীয়তাবাদ এখন কাঠামোগত পর্যায়ে চলে এসেছে, এর ফলে বৈষম্যমূলক নীতি বা লক্ষ্যবস্তু করার বিষয়গুলো এখন আর নির্বাচনি বৈধতার উপর নির্ভর করে না।
‘গুদাভার্তি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ চিন্তাভাবনা এখন প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে এবং তাদের কার্যকারিতায় প্রবেশ করেছে।’
বুলডোজার বিচার
একাধিক বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন যে, পরিবর্তনগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
সাউথ এশিয়া জাস্টিস ক্যাম্পেইন (এসএজেসি) এর ২০২৫ সালের পর্যালোচনায় এসেছে, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, বেশ কয়েকটি রাজ্য এবং তাদের পৌর কর্তৃপক্ষ; সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকায় ‘পুনর্উন্নয়ন’ বা ‘দখলবিরোধী’ নামে ঘরবাড়ি, দোকান, মসজিদ এবং কবরস্থান ভেঙে ফেলেছে। যাকে প্রায়শই ‘বুলডোজার জাস্টিস’ বলা হয়ে থাকে।
শুধুমাত্র ২০২৫ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ মাসের মধ্যে, ভারত জুড়ে ৭,৪০০ টিরও বেশি বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে। এর ফলে ৪১,০০০ এরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে; আর এই ভাঙনের প্রায় ৩৭ শতাংশই মুসলিমদের লক্ষ্য করে করা হয়েছিল।
দিল্লির মেহেরৌলি জেলায়, সরকার গত বছর ৬০০ বছরের পুরনো আখন্দজি মসজিদটি ভেঙে ফেলে। এর সাথে তারা একটি ইসলামিক স্কুলও ভেঙে দেয়, যেখানে শুধু এতিম শিশুরা থাকত।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে, মিরাটের দিল্লি রোডে অবস্থিত ১৬৮ বছরের পুরনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়, অথচ মসজিদটির ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক নথি রয়েছে। গভীর রাতে যাতে পুলিশ এবং পৌরসভার তত্ত্বাবধানে দ্রুত রেল করিডোরের জন্য পথ তৈরির কথা বলে, মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয়। স্থানীয়রা বলছেন রেল পথ নেওয়ার বিপরীতে কোনো বিকল্প স্থানও দেওয়া হয়নি।
প্রশাসনিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ধ্বংসের নোটিশ, অঞ্চলের প্রবিধান, ধর্মান্তর বিরোধী আইন এবং নজরদারি ক্ষমতা। আর এগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরই ব্যবহৃত হচ্ছে।
উত্তর ও মধ্য রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসন জমি অপসারণ অভিযানের অংশ হিসাবে বেশ কিছু ছোট ছোট মসজিদ এবং সুফি মাজার ভেঙে দিয়েছে।
এই মামলাগুলিতে কাজ করা আইনজীবীরা বলছেন যে প্রায়শই নোটিশ দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায়। যার ফলে প্রতিক্রিয়া জানানোরও সময় থাকে না।
ঘৃণার স্বাভাবিকিরণ
অধিকার সংস্থাগুলির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দুদের ব্যাপক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন মুসলমানরা। কখনো কখনো গরুর মাংস খাওয়া বা গবাদি পশু পরিবহনের সন্দেহে বিনা বিচারে মেরে ফেলা হচ্ছে অথচ কর্তৃপক্ষ তখন প্রায়শই চোখ বন্ধ করে থাকে। তখন তাদের কাছে থাকা সন্ত্রাসবিরোধী এবং রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের নির্বাচনি প্রয়োগের থাকে।
গবাদি পশু সম্পর্কিত অভিযোগের সাথে জড়িত গণপিটুনির ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে সামনে আসতে থাকে, বিশেষত কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। অধিকার গোষ্ঠীগুলি বলছে, এই ধরনটি এমন একটি পরিবেশের প্রকাশ করে, যেখানে গো-পাহারাদাররা রাজনৈতিক সুরক্ষায় আত্মবিশ্বাসের সাথে এমন কাজ করে।
মূলধারার সংবাদ চ্যানেলগুলো রাজনৈতিক বক্তব্যকে আরো জোরদার করে প্রচার করে, এর পাশাপাশি ডিজিটাল ঘৃণা প্রচারণা বাকি শূন্যস্থান পূরণ করে। রাকিব নায়েক এমন পরিস্থিতিকে ‘অমানবিকীকরণের সমন্বিত পরিবেশ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদকে সাধারণ জ্ঞান বলে মনে করে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আরএফ নরিমান সম্প্রতি ভারতীয়দের মনে করিয়ে দিয়েছেন, সংবিধান- ‘স্পষ্টতই ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক’ - ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো কাঠামোগত গ্যারান্টি হিসাবে এখানে অন্তর্ভুক্ত, কোনো রাজনৈতিক খেয়ালখুশি হিসাবে নয়।
কিন্তু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চুক্তি এখন ভঙ্গুর ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে হিন্দুত্ব মিশে যাওয়ার কারণে ভারতের সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতিকে নায়েক "অত্যন্ত উদ্বেগজনক" বলে মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি চিন্তিত যে এটি ইতোমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে সম্প্রদায়গুলোর জন্য আরো ক্ষতির কারণ হবে।’
টিআরটি ওয়ার্ল্ড থেকে অনুবাদ করেছেন মো. মাহফুজুর রহমান