শতাধিক দেশে যাচ্ছে কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই

এম হাসান, কুমিল্লা
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫৮

কুমিল্লার রসমালাইয়ের ঐতিহ্য শত বছরের। দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এর সুনাম। ক্রেতাদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মাতৃভাণ্ডার কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে রসমালাই নিয়ে বাড়ি ফিরছেন ভোজনরসিকরা।

সরকার মাতৃভাণ্ডারের জন্য রসমালাইয়ের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নিবন্ধন পেতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পর মাতৃভাণ্ডার ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি জিআই স্বীকৃতি পায়।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাণ্ডার মিষ্টান্ন দোকানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই ভাই খনিন্দ্র সেন এবং মণীন্দ্র সেন। তারা কৈলাশ ভবনের মালিক ইন্দুভূষণ দত্তের কাছ থেকে জমি কিনে ১৯৩০ সালে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে মিষ্টির দোকান শুরু করেন। তারা তাদের বাণিজ্যিক নামে রসমালাই বিক্রি করতে শুরু করেন এবং এটি কুমিল্লা ও সারা বাংলায় বিখ্যাত হয়ে ওঠে। মণীন্দ্র সেন অবিবাহিত ছিলেন। খনিন্দ্রের ছেলে শঙ্কর সেন ১৯৪০ সালে খনিন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর দোকানের দায়িত্ব নেন। ২০১৮ সালে শঙ্কর সেনের মৃত্যুর পর মাতৃভান্ডারের বর্তমান মালিক হন অনির্বাণ সেন গুপ্ত; যিনি খনিন্দ্র সেনের নাতি। বর্তমানে মাতৃভান্ডারের রসমালাই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি।

কুমিল্লায় কোনো পর্যটক বা অতিথি এলে রসমালাইয়ের স্বাদ নেননিÑএমন ঘটনা বিরল। কুমিল্লার খাদি বস্ত্রের পাশাপাশি চলে আসে রসমালাইয়ের নামও। বাণিজ্যিকভাবে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও কুমিল্লার রসমালাইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে ।

২০২২ সালে কুমিল্লা সফরে আসেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার। টুইটে তিনি লেখেন, ‘কুমিল্লা ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না, যদি না সেখানে গিয়ে রসমালাই খাওয়া হয়। কুমিল্লার প্রাচীনতম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় রসমালাইয়ের দোকান মাতৃভান্ডারের মিষ্টির স্বাদ গ্রহণ করে আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি।’

জানা গেছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গভবনে বিদেশি অতিথিদের আতিথেয়তায়ও মাতৃভান্ডারের রসমালাই সরবরাহ করা হতো। তাছাড়া একসময় তারা ব্র্যান্ড হয়ে যায়। অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পেছনে পড়ে যায়। সার্ক সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে এই দোকানের রসমালাই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল।

২০২১ সালে রসমালাইয়ের দাম প্রতি কেজি ছিল ২৮০ টাকা। সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি পর্যন্ত ক্রয়ের সীমা রয়েছে। মাতৃভান্ডার প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার কেজি রসমালাই বিক্রি করে থাকে। ২০২৪ সালে রসমালাইয়ের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৩৫০ টাকায় পৌঁছায়।

দুবাই প্রবাসী ভাগিনাকে নিয়ে রসমালাই কিনতে এসেছেন কামরুজ্জামান । তিনি আমার দেশকে বলেন, ভাগিনা ১২ কেজি রসমালাই নিয়ে দুবাই যাবে । দুবাইয়ে তার মালিক ও বন্ধুরা রসমালাই খাওয়ার আবদার করেছিল। কুমিল্লার মাতৃভান্ডার রসমালাইয়ের কদর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ।

ওমান প্রবাসী মোহাম্মদ জহির উদ্দিন তিন মাসের ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছেন । তিনি জানান, এর আগে একবার মাতৃভান্ডার রসমালাই আমার মালিককে দিয়েছিলাম । সে খেয়ে খুব প্রশংসা করেছে। এবার ছুটিতে আসার পর রসমালাই খাওয়ার খুব ইচ্ছা পোষণ করেছে আমার কোম্পানির মালিক। এজন্যই রসমালাই নিতে এলাম। খুব ভালো লাগছে আমাদের কুমিল্লার রসমালাই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ।

চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থেকে রসমালাই কিনতে এসেছেন সজীব ভূঁইয়া। তিনি জানান, খুবই নামকরা কুমিল্লার রসমালাই। এমনিতেই সবাই কুমিল্লাকে রসমালাই নামেই চেনে। পরিবারের সবাই রসমালাই খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। তাই সকাল সকাল এসে রসমালাই কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছি ।‌

কুমিল্লা শহর ঘুরে দেখার জন্য ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে এসেছেন ব্যবসায়ী শামীমুল ইসলাম। তিনি জানান, কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাতৃভান্ডারের রসমালাই।‌ ঘুরে দেখে গেলাম মাতৃভান্ডারের আসল দোকান এবং পরিবারের সবার জন্য রসমালাই নিয়ে নিলাম‌। অনেকেই না বুঝেই সাইনবোর্ড দেখেই মাতৃভান্ডার রসমালাই কিনে খাচ্ছেন। এজন্য যাচাই করে এখানে এসে মাতৃভান্ডারের অরিজিনাল রসমালাই কিনলাম ।

চাঁদপুর থেকে এসেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি। তিনি জানান, আমি উত্তরবঙ্গে ছিলাম। সেখানে দেখেছি মানুষ কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের প্রশংসা করছে ।

দীর্ঘ এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর রসমালাই পেয়েছেন ঢাকা থেকে আসা শামীম আহমেদ। তিনি আমার দেশকে বলেন, দীর্ঘ লাইন দেখেই বোঝা যায় কুমিল্লার রসমালাই কতটা জনপ্রিয় ।‌ কুমিল্লার রসমালাই জগৎবিখ্যাত ।

ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন নেয়ামত উল্লাহ । ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন । তিনি জানান, ছুটিতে বাড়ি এলেই অফিস কলিগদের একটা দাবি থাকে মাতৃভান্ডারের রসমালাই নিয়ে আসতে হবে । কলিগদের কথা তো আর ফেলতে পারি না‌ । এজন্য সকাল সকাল এসে পাঁচ কেজি রসমালাই কিনে নিলাম ।

২০ বছর ধরে কারিগরের কাজ করেন বিমল চন্দ্র। তিনি আমার দেশকে বলেন, রসমালাইয়ের ক্ষীর তৈরির জন্য দুধ ভালো করে জ্বাল দিতে হয় । দুধ জ্বাল দেওয়ার পর ক্ষীর হয়। তারপর গুটি মিশিয়েই বক্সে ঢোকানো হয় ।

৪০ বছর ধরে মাতৃভান্ডার রসমালাইয়ের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন তপন দে । তিনি জানান , কাস্টমারদের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারি না। ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রসমালাইয়ের। বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশে আমাদের রসমালাই যায় । গ্রাম থেকে যে পরিমাণ দুধ আসে, সে পরিমাণ দুধ দিয়ে আমরা প্রতিদিন রসমালাই বানাই। শুক্র ও শনিবার ব্যাপক চাহিদা থাকে । খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে রসমালাই বানানোর কারণেই আমাদের মান ও স্বাদ এখনো মানুষের মুখে মুখে।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার আমার দেশকে বলেন, রসমালাই জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেÑএটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয় । কুমিল্লাকে মানুষ নানাভাবে চেনে; তার মধ্যে রসমালাই একটি বিষয়। কুমিল্লার ঐতিহ্যের সঙ্গে রসমালাই জড়িত। কুমিল্লায় মাতৃভান্ডারের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ী রসমালাই গুণগত মান বজায় না রেখেই বিক্রি করছেন। যেভাবেই বিক্রি হোক, সবাই যেন এটার কোয়ালিটি ঠিক রাখেন ।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত