সোহাগ কুমার বিশ্বাস ও এম কে মনির, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের রহস্যঘেরা এলাকা জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর। বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট রিংরোড হয়ে ক্যান্টনমেন্ট সীমানার আগ পর্যন্ত পুরোটাই পাহাড়ঘেরা। জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের হিসাবে যার আয়তন প্রায় পাঁচ হাজার একর। এর মধ্যে অন্তত চার হাজার একর জমিই সরকারি খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত।
বিশাল এ পাহাড়ি ভূমি এখন ভূমিদস্যুদের দখলে। চারপাশের পাহাড় অক্ষত রেখে বছরের পর বছর ধরে সমতল করে ফেলা হয়েছে ভেতরের এলাকা। একটি মাত্র প্রবেশপথ রেখে পুরো এলাকাকে দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়েছে।
অপরাধী, খুনি ও দাগি আসামিদের অভয়ারণ্য সেখানে। সার্বক্ষণিক থাকে পাহারা। বিনা অনুমতিতে বহিরাগতদের নেই প্রবেশাধিকার। সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি। ইতোমধ্যে পুলিশ ক্যাম্পও দখল করে নিয়েছে তারা। সেনা অভিযানেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ যেন দেশের ভেতর অন্য এক দেশ।
দখল করা পুরো এলাকায় অন্তত ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। কাঁচা, আধাপাকা এমনকি বহুতল ভবনও গড়ে উঠেছে নিষিদ্ধ এ এলাকায়। সাধারণ মানুষের কাছে এলাকাটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশ জঙ্গল সলিমপুর আর দ্বিতীয় অংশ আলীনগর নামে পরিচিত। আলীনগরের একচ্ছত্র অধিপতি ইয়াছিন বাহিনীর প্রধান ইয়াছিন ও তার সহযোগীরা। তবে জঙ্গল সলিমপুরের দখলদারিত্ব নিয়ে বহু আগে থেকেই সংঘর্ষ চলছে।
কথিত আছে নগরীর সব সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্য এ জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকা। কারণ প্রশাসনের কর্তৃত্ব এখানে নেই বললেই চলে। নিজস্ব বিদ্যুৎব্যবস্থা, পানির সংস্থানÑএমনকি রাস্তাঘাট, মন্দির, মসজিদ, স্কুলও তৈরি করা হয়েছে সরকারের কোনো অনুমতি কিংবা সহযোগিতা ছাড়াই। এককথায় দেশের ভেতর আরেক দেশের পত্তন হয়েছে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকায়।
আওয়ামী লীগ আমলে জঙ্গল সলিমপুরের অধিপতি ছিলেন মশিউর আর গফুর নামের দুই গডফাদার। আর আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করতেন যুবলীগ সন্ত্রাসী ইয়াছিন। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী সরকারের পতন হলে বিতাড়িত হন মশিউর আর গফুরসহ তাদের সহযোগীরা। তবে ইয়াছিন রাতারাতি ভোল পাল্টে পরিচয় দিতে থাকে সীতাকুণ্ড যুবদলের নেতা হিসেবে। তবে দলে কোনো পদ-পদবি এখনো বাগিয়ে নিতে পারেননি তিনি।
মশিউর আর গফুর পালিয়ে যাওয়ার সুযোগে আলীনগরের বাইরে পুরো জঙ্গল সলিমপুরেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ইয়াসিন। কিন্তু নতুন করে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করতে চান উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রোকন উদ্দিন ওরফে রোকন মেম্বার। তার সঙ্গে রয়েছেন যুবদল, ছাত্রদল নামধারী অর্ধশতাধিক অস্ত্রধারী। আধিপত্যের লড়াইয়ে গত এক বছরে একজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
গত ৩ অক্টোবর শুক্রবার রাত ২টা। সীতাকুণ্ডের ফকিরহাট এলাকার ফকিরপাড়া এলাকায় জড়ো থাকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার শেরশাহ, আরেফিন গেট ও সীতাকুণ্ডের সিডিএ ছলিমপুর আবাসিক এবং লিংকরোড ঘিরেও চলে রণপ্রস্তুতি। উদ্দেশ্য শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াছিনের কবল থেকে আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। রাত আড়াইটার দিকে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আলীনগরে ইয়াছিনের ডেরায় হামলা করে। কিন্তু এ খবর আগেই পৌঁছে যায় ইয়াছিন বাহিনীর কাছে। দুর্বোধ্য ডেরায় তারাও রণসাজে সজ্জিত হয়ে থাকে। শুরু হয় দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
রাতভর গোলাগুলি, সংঘর্ষে ৪ অক্টোবর ভোররাতে রোকন গ্রুপের একজন নিহত হয়। উভয়পক্ষের অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অন্তত ২৫ জন। পাঁচজনকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় ইয়াছিন বাহিনী। হতাহতের খবর পেয়ে এলাকায় পুলিশ ঢুকতে পারেনি ওইদিন বিকাল পর্যন্ত। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দেনদরবার করে বিকালে লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে পুলিশ। গত এক বছরে অন্তত ছয়বার এমন বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরে।
পরদিন রোববার ওই সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহে জঙ্গল সলিমপুরে ঢোকার চেষ্টা করেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘এখন’-এর দুই সাংবাদিক। সলিমপুর বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশায় করে ৩০-৩৫ জনের একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এসে তাদের ওপর হামলা করে। অতর্কিত হামলায় গুরুতর আহত হন গণমাধ্যমটির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হোসাইন আহমেদ জিহাদ ও ক্যামেরাপারসন পারভেজ।
অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান
সেনাবাহিনীর সিন্দুকছড়ি জোন গত ২৯ আগস্ট জঙ্গল সলিমপুরের একটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় অভিযান শুরু করে। ৩০ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত দুদিনের অভিযানে কামরুল হাসান রিদোয়ান, রোমান, আশিক ও আমির ইসলাম নামে মোট চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ছয়টি দেশি অস্ত্র, ৩৫ রাউন্ড খালি কাতুর্জ, ২০টি ওয়াকিটকি, চাইনিজ কুড়ালসহ বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তাররা মূলত রোকন বাহিনীর সদস্য বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যারা রোকনের হয়ে জঙ্গল সলিমপুরের একাংশ নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। সেনাবাহিনীর অভিযানের পর ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েকশ সন্ত্রাসী নিয়ে পুরো জঙ্গল সলিমপুরের নিয়ন্ত্রণ নেয় আলীনগরের ত্রাস ইয়াছিন। এলাকা দখলে নিতে কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়ায় সন্ত্রাসীরা।
দুদিন ধরে সলিমপুর এলাকায় তাণ্ডব চালায় ইয়াছিন বাহিনী। রোকনের সহযোগী হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান রাজু, সাইদুল হক সাদু, সার্ভেয়ার মুজিবুর রহমান, বোরহান উদ্দিন জিয়ার অফিস, দোকান ও বাড়িঘরে হামলার পর আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বিতাড়িত হয় রোকনের অনুসারীরা।
অভিযোগ আছে, অস্ত্রের কারখানা, খুন, গুম, ব্ল্যাকমেইলিং, টর্চারসেল, চাঁদাবাজি সবই চলে শহরতলী সীতাকুণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি এ অঞ্চলে। প্রশাসনও যেন অসহায় সেখানে।
স্থানীয়দের ভাষ্যে ওই দুই এলাকায় মানুষ হত্যা করে কয়েকদিন ফেলে রাখলেও কেউ জানে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাগুলি হলেও পুলিশ আসে না। কখনো ইয়াছিন, কখনো রোকন, মশিউর কিংবা গফুরের কথাই সেখানে আইন।
নেপথ্যে রাজনৈতিক শক্তি
আলীনগরের ইয়াছিন নোয়াখালীর বাসিন্দা। জঙ্গল সলিমপুরে তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র, ধর্ষণ, পরিবেশ আইন, প্রশাসনের ওপর হামলাসহ তিন ডজনের বেশি মামলা আছে। পতিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পলাতক সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিল ইয়াছিন।
আরেকজন কাজী মশিউর। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক ও শীর্ষ সন্ত্রাসী। সীতাকুণ্ডের সাবেক এমপি এসএম আল মামুনের অনুসারী। তার সঙ্গে ছিলেন সাবেক ইউপি সদস্য গফুর ও আরিফ হোসেন। তারা সীতাকুণ্ডের সাবেক এমপি দিদারুল ইসলাম দিদারের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। আর হাল আমলে আলোচিত রোকন উদ্দিন প্রকাশ রোকন মেম্বার উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার সঙ্গে আছে বিএনপির আরো অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। আওয়ামী আমলে মশিউর জঙ্গল সলিমপুর নিয়ন্ত্রণ করলেও চব্বিশের ৫ আগস্টের পর শুরু হয় রোকনের শাসন। তিনি বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
আর ইয়াছিন দীর্ঘদিন ধরে আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বর্তমানে টাকা ছিটিয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রামরাজত্ব কায়েম করছেন ওই এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, সলিমপুর ও আলীনগরে কোনো দল নেই। সেখানে যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে, তাদের ব্যানার লাগিয়ে চলে চাঁদাবাজি। ধরে রাখা হয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ।
সন্ত্রাসীদের শাসন
এখানকার বাসিন্দারা জানান, নেতা নামধারী সন্ত্রাসীরা এখানে সর্বেসর্বা। বর্তমানে ইয়াছিন বাহিনীর পক্ষে তার ভাই ফারুক, জামাই ইয়াছিন, নুর ইসলাম, জাহাঙ্গীর, ভাগনে হাসান, ইউসুফ ও আল আমিন তার বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন।
জানা গেছে, জঙ্গল সলিমপুরে সাত-আট বছর আগে পাহাড় কেটে বানানো প্লট চার-পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হলেও বর্তমানে সাত-আট লাখ টাকা প্লট বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে সন্ত্রাসীরা নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে বিক্রি করেন এসব প্লট। অনেককে কিস্তি সুবিধাও দেওয়া হয়। বর্তমানে আলীনগরে প্লটের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে জঙ্গল সলিমপুরে ১৫ হাজারের বেশি প্লট রয়েছে।
ছিন্নমূল মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে নানাসময় বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করেন তারা। এমনকি হাইকোর্টে ৩০০ একর জমির জন্য জঙ্গল সলিমপুরের সন্ত্রাসীরা আর ৪০০ একর জমির জন্য আলীনগরের ইয়াছিন রিট করেছেন বহু আগে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখানে বসবাস করতে হলে মাসে তিন ধরনের বিদ্যুৎ সুবিধা নিতে পারে বাসিন্দারা। প্রথমত, এক হাজার ২০০ টাকায় দিনে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে, দুই হাজার টাকায় ছয়-সাত ঘণ্টা। আর তিন হাজারের বেশি হলে ফুলটাইম বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। বিদ্যুৎসংযোগ পেতে হলে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। সপ্তাহে দুদিনে ১৪ মিনিটের জন্য পানি পেতে গুনতে হয় ৬০০ টাকা করে। নিজেদের লোক ছাড়া কেউ ডিপ টিউবওয়েল বসাতে পারে না সেখানে।
এক হিসাবে দেখা যায়, শুধু ২০ হাজার মিটারে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল তোলা হয়। আর পানিতে তোলা হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে জঙ্গল সলিমপুরে অর্ধলক্ষাধিক মিটার রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও আলীনগরে অন্তত পাঁচ হাজার বৈদ্যুতিক মিটার রয়েছে।
অভিযোগ আছে, বিদ্যুৎ বিভাগের একটি চক্র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে সেখানে।
টোকেন নিয়ে কাটা হয় পাহাড়
আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অভিযান পরিচালনার নজির নেই। সবশেষ ২০২২ সালে জেলা প্রশাসনের বিশাল বহর নিয়ে অভিযানে নামে সংস্থাটি। কিন্তু কয়েকজনকে জরিমানা করলেও তা আদায় করা সম্ভব হয়নি। এরপর আর কখনো তাদের দেখাও যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাহাড় কাটতে হলে লাগে নেতাদের অনুমতি। তারা একটি টোকেন দিলে পাহাড় কাটা যায়। দৈনিক ৮০০ টাকা ভিত্তিতে পাহাড় কাটার অনুমতি মেলে। তাছাড়াও টিউবওয়েল, ঘর মেরামত, দোকান নির্মাণ, ওয়াল, ড্রেন করতে চাইলে চাঁদা দিতে হয়। এসবের বাইরে দুই এলাকাতেই মাঝেমধ্যে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, ড্রেন, কালভার্ট নির্মাণ ও ওরসের কথা বলে টাকা তোলা হয়। কেউ টাকা দিতে গড়িমসি করলে তার স্থাপনা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরিবহন খাতেও চলে চাঁদাবাজি
আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরের রাস্তাগুলোতে বড় গাড়ি সহজে চলতে পারে না। মূলত সিএনজি ও অটোরিকশা এখানকার মূল যানবাহন। নগরের টেক্সটাইল থেকে আলীনগর রুটে তিন শতাধিক সিএনজি অটোরিকশা চলে। এসব অটোরিকশার বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন পড়ে না। আলীনগর আর সলিমপুরের কথিত সমিতির টোকেন প্রয়োজন হয়। শুরুতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। পরে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা করে দিয়ে টোকেন নবায়ন করতে হয়। এ টোকেন সামনের গ্লাসের সঙ্গে লাগিয়ে চলাচল করতে হয়।
পুলিশ ক্যাম্প ও ফাঁড়ি দখল
আলীনগরে কোনো পুলিশ ক্যাম্প না থাকলেও জঙ্গল সলিমপুরের স্কুলমাঠ বাজারে ছিল একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ছিল। ২০২২ সালের পর জঙ্গল সলিমপুরের প্রবেশ মুখে একটি ক্যাম্প বসায় সিএমপি। কিন্তু জুলাই গণঅভুত্থানের পর সেখান থেকে চলে আসে পুলিশ। এরপর আর ঢুকতে পারেনি। প্রবেশমুখে সিএমপির ক্যাম্পটি দখল করে চারপাশে দেওয়াল তুলে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। আর স্কুল মাঠের অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে ছিন্নমূল মানুষের কাছে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে সলিমপুরের অধিপতিরা।
জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরের ইতিহাস
নব্বইয়ের দশকে গোপন আস্তানা তৈরি করে এলাকাটিতে ঘাঁটি গাড়েন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সন্ত্রাসীরা। তার আগে এলাকাটি ছিল নয়নাভিরাম সবুজে আচ্ছাদিত গহিন পাহাড়। ২০০২ সাল থেকে এলাকাটিতে আলী আক্কাস নামে এক ব্যক্তি বসতি গড়ে তোলেন। সরকারি বিভিন্ন সুবিধা আদায় ও বৈধতা দাঁড় করাতে ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হওয়ার পর এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ নেন ঝিনাইদহের মহেশপুর থেকে আসা কাজী মশিউর রহমান। তিন দশকে কাজী মশিউর রহমান, ইয়াছিন, গফুর মেম্বার, রোকন মেম্বার, রিদোয়ান, আলী আক্কাসসহ ২০-২৫ জনের একটি চক্র সেখানকার তিন হাজার ১০০ একর পাহাড় কেটে সমতলে রূপ দিয়েছেন।
বর্তমানে ১১টি সমাজের ৫১ সদস্যবিশিষ্ট নগর কমিটিই এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। যার অধীনে রয়েছে আরো ৭২টি শাখা। এখন প্রায় ৫০ হাজার নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল মানুষের বসবাস শুধু সলিমপুরে। আরো অন্তত ১০ হাজার বাসিন্দা থাকেন আলীনগরে। তবে ২০ হাজারের বেশি প্রভাবশালী মানুষ সেখানে প্লট ক্রয় করে রেখেছেন।
আলীনগর চলে ইয়াছিনের শাসনে। সাংবাদিক, পুলিশ, প্রশাসন, বাইরের কোনো অতিথি কেউই সেখানে প্রবেশ করতে পারেন না। ২০২২ সালে জেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করলে আলীনগরের রাস্তা কেটে ফেলে ইয়াছিনের বাহিনী। পরে আর কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি।
বর্তমান ব্যবস্থা
সংঘর্ষের আগে ছদ্মবেশে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরে প্রবেশ করে আমার দেশ-এর একটি অনুসন্ধানী টিম। দেখা যায়, ভেতরে মূল সড়ক চারলেনের মহাসড়কের সমমানের। লোহা তৈরি কারখানার গাদ দিয়ে পুরো রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সলিমপুর আর আলীনগরের মাঝখানের কয়েকশ মিটার এলাকা সরু রাস্তা। মূলত দুই এলাকা ভাগ করে রাখতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। রাস্তার পাশে বড় বড় ড্রেনে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত তিন দশকে ১২ কিলোমিটারের এ এলাকায় ১২টি মসজিদ, পাঁচটি মন্দির, একটি গির্জা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, ছয়টি কেজি স্কুল, তিনটি এতিমখানা, চারটি মাদরাসা, পাঁচটি কবরস্থান, একটি শ্মশান গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই নিজেদের চাঁদার টাকায় গড়ে তোলা হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দরিদ্র মানুষও বসবাস করেন এখানে। তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় প্রস্থ ২৫ ফুট আর দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুটের একটি করে প্লট কিনে বসবাস করেন তারা। এখানে রয়েছে একটি বাজার। এখানকার বাসিন্দারা বাধ্যতামূলক এ বাজার থেকে চড়ামূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য। বাইরে থেকে কেউ কোনো জিনিস কিনে অনতে চাইলে গেটের পাহারাদাররা তা ছিনিয়ে নেন।
২০২২ সালে প্রশাসনের বড় অভিযানের ফল শূন্য
জেলা প্রশাসন ২০২২ সালে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরে বড় ধরনের অভিযান চালালেও কোনো লাভ হয়নি। র্যাব, পুলিশ, ইউএনও, এসিল্যান্ড হামলার শিকার হয়ে উল্টো চুপসে যান। ওই সময় রাস্তা পর্যন্ত কেটে ফেলে ইয়াছিনের লোকজন। সে সময় আলীনগরের কয়েকশ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও পরে আবারও গড়ে ওঠে। উচ্ছেদ অভিযানের সুবিধার্থে বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ রাখা হয় পুরো এলাকায়। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারা মিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য করে জেলা প্রশাসনকে।
প্রশাসনের বক্তব্য
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু জানান, সলিমপুর ও আলীনগর এলাকাটি সিএমপির বায়েজিদ থানা আর জেলার সীতাকুণ্ড থানার মধ্যে পড়েছে। ফলে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সিএমপি আর জেলা পুলিশ যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা সাজিয়েছে। সবকিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। তবে এতটুকু বলা যায় যে, সেখানে যেসব সন্ত্রাসী অবস্থান করছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান, ভেতরে যারা আছে, তাদের শক্তি-সামর্থ্য সবকিছু পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জনগণকে ভালো একটি সংবাদ দেবে পুলিশ।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের রহস্যঘেরা এলাকা জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর। বায়েজিদ বোস্তামী থেকে ফৌজদারহাট রিংরোড হয়ে ক্যান্টনমেন্ট সীমানার আগ পর্যন্ত পুরোটাই পাহাড়ঘেরা। জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের হিসাবে যার আয়তন প্রায় পাঁচ হাজার একর। এর মধ্যে অন্তত চার হাজার একর জমিই সরকারি খাস খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত।
বিশাল এ পাহাড়ি ভূমি এখন ভূমিদস্যুদের দখলে। চারপাশের পাহাড় অক্ষত রেখে বছরের পর বছর ধরে সমতল করে ফেলা হয়েছে ভেতরের এলাকা। একটি মাত্র প্রবেশপথ রেখে পুরো এলাকাকে দুর্ভেদ্য করে তোলা হয়েছে।
অপরাধী, খুনি ও দাগি আসামিদের অভয়ারণ্য সেখানে। সার্বক্ষণিক থাকে পাহারা। বিনা অনুমতিতে বহিরাগতদের নেই প্রবেশাধিকার। সন্ধ্যা হলেই শুরু হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি। ইতোমধ্যে পুলিশ ক্যাম্পও দখল করে নিয়েছে তারা। সেনা অভিযানেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এ যেন দেশের ভেতর অন্য এক দেশ।
দখল করা পুরো এলাকায় অন্তত ৬০ হাজার মানুষের বসবাস। কাঁচা, আধাপাকা এমনকি বহুতল ভবনও গড়ে উঠেছে নিষিদ্ধ এ এলাকায়। সাধারণ মানুষের কাছে এলাকাটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশ জঙ্গল সলিমপুর আর দ্বিতীয় অংশ আলীনগর নামে পরিচিত। আলীনগরের একচ্ছত্র অধিপতি ইয়াছিন বাহিনীর প্রধান ইয়াছিন ও তার সহযোগীরা। তবে জঙ্গল সলিমপুরের দখলদারিত্ব নিয়ে বহু আগে থেকেই সংঘর্ষ চলছে।
কথিত আছে নগরীর সব সন্ত্রাসীর অভয়ারণ্য এ জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকা। কারণ প্রশাসনের কর্তৃত্ব এখানে নেই বললেই চলে। নিজস্ব বিদ্যুৎব্যবস্থা, পানির সংস্থানÑএমনকি রাস্তাঘাট, মন্দির, মসজিদ, স্কুলও তৈরি করা হয়েছে সরকারের কোনো অনুমতি কিংবা সহযোগিতা ছাড়াই। এককথায় দেশের ভেতর আরেক দেশের পত্তন হয়েছে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকায়।
আওয়ামী লীগ আমলে জঙ্গল সলিমপুরের অধিপতি ছিলেন মশিউর আর গফুর নামের দুই গডফাদার। আর আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করতেন যুবলীগ সন্ত্রাসী ইয়াছিন। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী সরকারের পতন হলে বিতাড়িত হন মশিউর আর গফুরসহ তাদের সহযোগীরা। তবে ইয়াছিন রাতারাতি ভোল পাল্টে পরিচয় দিতে থাকে সীতাকুণ্ড যুবদলের নেতা হিসেবে। তবে দলে কোনো পদ-পদবি এখনো বাগিয়ে নিতে পারেননি তিনি।
মশিউর আর গফুর পালিয়ে যাওয়ার সুযোগে আলীনগরের বাইরে পুরো জঙ্গল সলিমপুরেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ইয়াসিন। কিন্তু নতুন করে সেখানে আধিপত্য বিস্তার করতে চান উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রোকন উদ্দিন ওরফে রোকন মেম্বার। তার সঙ্গে রয়েছেন যুবদল, ছাত্রদল নামধারী অর্ধশতাধিক অস্ত্রধারী। আধিপত্যের লড়াইয়ে গত এক বছরে একজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।
গত ৩ অক্টোবর শুক্রবার রাত ২টা। সীতাকুণ্ডের ফকিরহাট এলাকার ফকিরপাড়া এলাকায় জড়ো থাকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। একই সঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার শেরশাহ, আরেফিন গেট ও সীতাকুণ্ডের সিডিএ ছলিমপুর আবাসিক এবং লিংকরোড ঘিরেও চলে রণপ্রস্তুতি। উদ্দেশ্য শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াছিনের কবল থেকে আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। রাত আড়াইটার দিকে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আলীনগরে ইয়াছিনের ডেরায় হামলা করে। কিন্তু এ খবর আগেই পৌঁছে যায় ইয়াছিন বাহিনীর কাছে। দুর্বোধ্য ডেরায় তারাও রণসাজে সজ্জিত হয়ে থাকে। শুরু হয় দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
রাতভর গোলাগুলি, সংঘর্ষে ৪ অক্টোবর ভোররাতে রোকন গ্রুপের একজন নিহত হয়। উভয়পক্ষের অন্তত ১৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অন্তত ২৫ জন। পাঁচজনকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় ইয়াছিন বাহিনী। হতাহতের খবর পেয়ে এলাকায় পুলিশ ঢুকতে পারেনি ওইদিন বিকাল পর্যন্ত। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে দেনদরবার করে বিকালে লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে আসে পুলিশ। গত এক বছরে অন্তত ছয়বার এমন বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরে।
পরদিন রোববার ওই সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহে জঙ্গল সলিমপুরে ঢোকার চেষ্টা করেন বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘এখন’-এর দুই সাংবাদিক। সলিমপুর বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশায় করে ৩০-৩৫ জনের একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী এসে তাদের ওপর হামলা করে। অতর্কিত হামলায় গুরুতর আহত হন গণমাধ্যমটির চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান হোসাইন আহমেদ জিহাদ ও ক্যামেরাপারসন পারভেজ।
অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান
সেনাবাহিনীর সিন্দুকছড়ি জোন গত ২৯ আগস্ট জঙ্গল সলিমপুরের একটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় অভিযান শুরু করে। ৩০ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত দুদিনের অভিযানে কামরুল হাসান রিদোয়ান, রোমান, আশিক ও আমির ইসলাম নামে মোট চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ছয়টি দেশি অস্ত্র, ৩৫ রাউন্ড খালি কাতুর্জ, ২০টি ওয়াকিটকি, চাইনিজ কুড়ালসহ বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তাররা মূলত রোকন বাহিনীর সদস্য বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যারা রোকনের হয়ে জঙ্গল সলিমপুরের একাংশ নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। সেনাবাহিনীর অভিযানের পর ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় কয়েকশ সন্ত্রাসী নিয়ে পুরো জঙ্গল সলিমপুরের নিয়ন্ত্রণ নেয় আলীনগরের ত্রাস ইয়াছিন। এলাকা দখলে নিতে কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়ায় সন্ত্রাসীরা।
দুদিন ধরে সলিমপুর এলাকায় তাণ্ডব চালায় ইয়াছিন বাহিনী। রোকনের সহযোগী হিসেবে পরিচিত মিজানুর রহমান রাজু, সাইদুল হক সাদু, সার্ভেয়ার মুজিবুর রহমান, বোরহান উদ্দিন জিয়ার অফিস, দোকান ও বাড়িঘরে হামলার পর আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। বিতাড়িত হয় রোকনের অনুসারীরা।
অভিযোগ আছে, অস্ত্রের কারখানা, খুন, গুম, ব্ল্যাকমেইলিং, টর্চারসেল, চাঁদাবাজি সবই চলে শহরতলী সীতাকুণ্ডের দুর্গম পাহাড়ি এ অঞ্চলে। প্রশাসনও যেন অসহায় সেখানে।
স্থানীয়দের ভাষ্যে ওই দুই এলাকায় মানুষ হত্যা করে কয়েকদিন ফেলে রাখলেও কেউ জানে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গোলাগুলি হলেও পুলিশ আসে না। কখনো ইয়াছিন, কখনো রোকন, মশিউর কিংবা গফুরের কথাই সেখানে আইন।
নেপথ্যে রাজনৈতিক শক্তি
আলীনগরের ইয়াছিন নোয়াখালীর বাসিন্দা। জঙ্গল সলিমপুরে তার বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র, ধর্ষণ, পরিবেশ আইন, প্রশাসনের ওপর হামলাসহ তিন ডজনের বেশি মামলা আছে। পতিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পলাতক সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিল ইয়াছিন।
আরেকজন কাজী মশিউর। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক ও শীর্ষ সন্ত্রাসী। সীতাকুণ্ডের সাবেক এমপি এসএম আল মামুনের অনুসারী। তার সঙ্গে ছিলেন সাবেক ইউপি সদস্য গফুর ও আরিফ হোসেন। তারা সীতাকুণ্ডের সাবেক এমপি দিদারুল ইসলাম দিদারের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। আর হাল আমলে আলোচিত রোকন উদ্দিন প্রকাশ রোকন মেম্বার উত্তর জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার সঙ্গে আছে বিএনপির আরো অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। আওয়ামী আমলে মশিউর জঙ্গল সলিমপুর নিয়ন্ত্রণ করলেও চব্বিশের ৫ আগস্টের পর শুরু হয় রোকনের শাসন। তিনি বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
আর ইয়াছিন দীর্ঘদিন ধরে আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বর্তমানে টাকা ছিটিয়ে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রামরাজত্ব কায়েম করছেন ওই এলাকায়। স্থানীয়রা জানান, সলিমপুর ও আলীনগরে কোনো দল নেই। সেখানে যখন যেই দল ক্ষমতায় আসে, তাদের ব্যানার লাগিয়ে চলে চাঁদাবাজি। ধরে রাখা হয় এলাকার নিয়ন্ত্রণ।
সন্ত্রাসীদের শাসন
এখানকার বাসিন্দারা জানান, নেতা নামধারী সন্ত্রাসীরা এখানে সর্বেসর্বা। বর্তমানে ইয়াছিন বাহিনীর পক্ষে তার ভাই ফারুক, জামাই ইয়াছিন, নুর ইসলাম, জাহাঙ্গীর, ভাগনে হাসান, ইউসুফ ও আল আমিন তার বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন।
জানা গেছে, জঙ্গল সলিমপুরে সাত-আট বছর আগে পাহাড় কেটে বানানো প্লট চার-পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করা হলেও বর্তমানে সাত-আট লাখ টাকা প্লট বিক্রি করা হয়। বিশেষ করে সন্ত্রাসীরা নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে বিক্রি করেন এসব প্লট। অনেককে কিস্তি সুবিধাও দেওয়া হয়। বর্তমানে আলীনগরে প্লটের সংখ্যা জানা যায়নি। তবে জঙ্গল সলিমপুরে ১৫ হাজারের বেশি প্লট রয়েছে।
ছিন্নমূল মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার নামে নানাসময় বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করেন তারা। এমনকি হাইকোর্টে ৩০০ একর জমির জন্য জঙ্গল সলিমপুরের সন্ত্রাসীরা আর ৪০০ একর জমির জন্য আলীনগরের ইয়াছিন রিট করেছেন বহু আগে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখানে বসবাস করতে হলে মাসে তিন ধরনের বিদ্যুৎ সুবিধা নিতে পারে বাসিন্দারা। প্রথমত, এক হাজার ২০০ টাকায় দিনে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে, দুই হাজার টাকায় ছয়-সাত ঘণ্টা। আর তিন হাজারের বেশি হলে ফুলটাইম বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। বিদ্যুৎসংযোগ পেতে হলে ২০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। সপ্তাহে দুদিনে ১৪ মিনিটের জন্য পানি পেতে গুনতে হয় ৬০০ টাকা করে। নিজেদের লোক ছাড়া কেউ ডিপ টিউবওয়েল বসাতে পারে না সেখানে।
এক হিসাবে দেখা যায়, শুধু ২০ হাজার মিটারে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল তোলা হয়। আর পানিতে তোলা হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে জঙ্গল সলিমপুরে অর্ধলক্ষাধিক মিটার রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও আলীনগরে অন্তত পাঁচ হাজার বৈদ্যুতিক মিটার রয়েছে।
অভিযোগ আছে, বিদ্যুৎ বিভাগের একটি চক্র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে সেখানে।
টোকেন নিয়ে কাটা হয় পাহাড়
আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অভিযান পরিচালনার নজির নেই। সবশেষ ২০২২ সালে জেলা প্রশাসনের বিশাল বহর নিয়ে অভিযানে নামে সংস্থাটি। কিন্তু কয়েকজনকে জরিমানা করলেও তা আদায় করা সম্ভব হয়নি। এরপর আর কখনো তাদের দেখাও যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পাহাড় কাটতে হলে লাগে নেতাদের অনুমতি। তারা একটি টোকেন দিলে পাহাড় কাটা যায়। দৈনিক ৮০০ টাকা ভিত্তিতে পাহাড় কাটার অনুমতি মেলে। তাছাড়াও টিউবওয়েল, ঘর মেরামত, দোকান নির্মাণ, ওয়াল, ড্রেন করতে চাইলে চাঁদা দিতে হয়। এসবের বাইরে দুই এলাকাতেই মাঝেমধ্যে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, ড্রেন, কালভার্ট নির্মাণ ও ওরসের কথা বলে টাকা তোলা হয়। কেউ টাকা দিতে গড়িমসি করলে তার স্থাপনা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরিবহন খাতেও চলে চাঁদাবাজি
আলীনগর ও জঙ্গল সলিমপুরের রাস্তাগুলোতে বড় গাড়ি সহজে চলতে পারে না। মূলত সিএনজি ও অটোরিকশা এখানকার মূল যানবাহন। নগরের টেক্সটাইল থেকে আলীনগর রুটে তিন শতাধিক সিএনজি অটোরিকশা চলে। এসব অটোরিকশার বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন পড়ে না। আলীনগর আর সলিমপুরের কথিত সমিতির টোকেন প্রয়োজন হয়। শুরুতে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা জমা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। পরে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা করে দিয়ে টোকেন নবায়ন করতে হয়। এ টোকেন সামনের গ্লাসের সঙ্গে লাগিয়ে চলাচল করতে হয়।
পুলিশ ক্যাম্প ও ফাঁড়ি দখল
আলীনগরে কোনো পুলিশ ক্যাম্প না থাকলেও জঙ্গল সলিমপুরের স্কুলমাঠ বাজারে ছিল একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ছিল। ২০২২ সালের পর জঙ্গল সলিমপুরের প্রবেশ মুখে একটি ক্যাম্প বসায় সিএমপি। কিন্তু জুলাই গণঅভুত্থানের পর সেখান থেকে চলে আসে পুলিশ। এরপর আর ঢুকতে পারেনি। প্রবেশমুখে সিএমপির ক্যাম্পটি দখল করে চারপাশে দেওয়াল তুলে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। আর স্কুল মাঠের অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে ছিন্নমূল মানুষের কাছে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে সলিমপুরের অধিপতিরা।
জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরের ইতিহাস
নব্বইয়ের দশকে গোপন আস্তানা তৈরি করে এলাকাটিতে ঘাঁটি গাড়েন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা সন্ত্রাসীরা। তার আগে এলাকাটি ছিল নয়নাভিরাম সবুজে আচ্ছাদিত গহিন পাহাড়। ২০০২ সাল থেকে এলাকাটিতে আলী আক্কাস নামে এক ব্যক্তি বসতি গড়ে তোলেন। সরকারি বিভিন্ন সুবিধা আদায় ও বৈধতা দাঁড় করাতে ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হওয়ার পর এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ নেন ঝিনাইদহের মহেশপুর থেকে আসা কাজী মশিউর রহমান। তিন দশকে কাজী মশিউর রহমান, ইয়াছিন, গফুর মেম্বার, রোকন মেম্বার, রিদোয়ান, আলী আক্কাসসহ ২০-২৫ জনের একটি চক্র সেখানকার তিন হাজার ১০০ একর পাহাড় কেটে সমতলে রূপ দিয়েছেন।
বর্তমানে ১১টি সমাজের ৫১ সদস্যবিশিষ্ট নগর কমিটিই এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। যার অধীনে রয়েছে আরো ৭২টি শাখা। এখন প্রায় ৫০ হাজার নিম্ন আয়ের ছিন্নমূল মানুষের বসবাস শুধু সলিমপুরে। আরো অন্তত ১০ হাজার বাসিন্দা থাকেন আলীনগরে। তবে ২০ হাজারের বেশি প্রভাবশালী মানুষ সেখানে প্লট ক্রয় করে রেখেছেন।
আলীনগর চলে ইয়াছিনের শাসনে। সাংবাদিক, পুলিশ, প্রশাসন, বাইরের কোনো অতিথি কেউই সেখানে প্রবেশ করতে পারেন না। ২০২২ সালে জেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করলে আলীনগরের রাস্তা কেটে ফেলে ইয়াছিনের বাহিনী। পরে আর কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি।
বর্তমান ব্যবস্থা
সংঘর্ষের আগে ছদ্মবেশে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরে প্রবেশ করে আমার দেশ-এর একটি অনুসন্ধানী টিম। দেখা যায়, ভেতরে মূল সড়ক চারলেনের মহাসড়কের সমমানের। লোহা তৈরি কারখানার গাদ দিয়ে পুরো রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সলিমপুর আর আলীনগরের মাঝখানের কয়েকশ মিটার এলাকা সরু রাস্তা। মূলত দুই এলাকা ভাগ করে রাখতেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে। রাস্তার পাশে বড় বড় ড্রেনে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা করা হয়েছে।
গত তিন দশকে ১২ কিলোমিটারের এ এলাকায় ১২টি মসজিদ, পাঁচটি মন্দির, একটি গির্জা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, ছয়টি কেজি স্কুল, তিনটি এতিমখানা, চারটি মাদরাসা, পাঁচটি কবরস্থান, একটি শ্মশান গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই নিজেদের চাঁদার টাকায় গড়ে তোলা হয়েছে।
সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দরিদ্র মানুষও বসবাস করেন এখানে। তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকায় প্রস্থ ২৫ ফুট আর দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুটের একটি করে প্লট কিনে বসবাস করেন তারা। এখানে রয়েছে একটি বাজার। এখানকার বাসিন্দারা বাধ্যতামূলক এ বাজার থেকে চড়ামূল্যে পণ্য কিনতে বাধ্য। বাইরে থেকে কেউ কোনো জিনিস কিনে অনতে চাইলে গেটের পাহারাদাররা তা ছিনিয়ে নেন।
২০২২ সালে প্রশাসনের বড় অভিযানের ফল শূন্য
জেলা প্রশাসন ২০২২ সালে জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগরে বড় ধরনের অভিযান চালালেও কোনো লাভ হয়নি। র্যাব, পুলিশ, ইউএনও, এসিল্যান্ড হামলার শিকার হয়ে উল্টো চুপসে যান। ওই সময় রাস্তা পর্যন্ত কেটে ফেলে ইয়াছিনের লোকজন। সে সময় আলীনগরের কয়েকশ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও পরে আবারও গড়ে ওঠে। উচ্ছেদ অভিযানের সুবিধার্থে বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ রাখা হয় পুরো এলাকায়। কিন্তু সেখানকার বাসিন্দারা মিলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে অভিযান স্থগিত করতে বাধ্য করে জেলা প্রশাসনকে।
প্রশাসনের বক্তব্য
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু জানান, সলিমপুর ও আলীনগর এলাকাটি সিএমপির বায়েজিদ থানা আর জেলার সীতাকুণ্ড থানার মধ্যে পড়েছে। ফলে এখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সিএমপি আর জেলা পুলিশ যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা সাজিয়েছে। সবকিছু গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। তবে এতটুকু বলা যায় যে, সেখানে যেসব সন্ত্রাসী অবস্থান করছে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান, ভেতরে যারা আছে, তাদের শক্তি-সামর্থ্য সবকিছু পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে জনগণকে ভালো একটি সংবাদ দেবে পুলিশ।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় আমির হামজা (১৩) নামের এক মাদ্রাসা ছাত্রের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
১ ঘণ্টা আগেবিকেলে প্রায় ৩০–৪০ যুবক দোস্ত বিল্ডিংয়ে এসে হামলা চালায় ও ভাঙচুর করে। হামলাকারীদের হাতে হকিস্টিক ও লাঠিসোঁটা ছিল। ভাঙচুর শেষে তারা ভবনটির তৃতীয় তলায় থাকা চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং মুজিব সেনা কার্যালয়ে অবস্থান নেয়।
৫ ঘণ্টা আগেসোহাগ হোসাইন বলেন, “গণ-অধিকার পরিষদ একটি গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার ও মর্যাদার নিশ্চয়তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি—জনগণের মতামত, সমস্যার বাস্তব চিত্র এবং ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য সংলাপ, জনসম্পৃক্ততা ও স্বচ্ছতা অপরিহার্য।”
৭ ঘণ্টা আগেবন্দর থানার ওসি আফতাব আহমেদ আমার দেশকে বলেন, আটক দুজনের নাম মো. শাহাদাত ও মো. আকাশ। তারা চট্টগ্রাম শহরের বাসিন্দা। ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল তারা। ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে ওই দুই যুবক।
৭ ঘণ্টা আগে