বিজয় দিবসের রাষ্ট্রীয় আয়োজনে অংশ নেওয়া এক প্যারাট্রুপারকে ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ওই প্যারাট্রুপার হলেন মোহাম্মদ ইবনুল ইসলাম অভি। তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে জুলাই আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ আখ্যা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ধারাবাহিক রাজনৈতিক পোস্ট দেন। সম্প্রতি পোস্টগুলো ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। এসব পোস্টে কোথাও জুলাইয়ের ছাত্র-জনতাকে ‘মৌলবাদী’ বলা হয় আবার কোথাও আক্রমণাত্মক ভাষায় ‘গর্দান নেওয়ার’ ইঙ্গিতও দেখা গেছে, যা নিয়ে জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনী তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।
জানা গেছে, বিজয় দিবসের দিন সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপিং দলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর পাশেই ছিলেন প্যারাট্রুপার অভি। মূলত ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সমালোচনা শুরু হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভি ফেসবুকে ইংরেজিতে ‘ibnulovi ibnulovi’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে ও পরে একাধিক পোস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ হিসেবে আখ্যা দেন। একই সঙ্গে হাসিনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে একাধিক পোস্ট দেন। সর্বশেষ ২ ডিসেম্বর তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুজিববাদী বক্তব্যসংবলিত একটি পোস্ট দেন। এর আগে ১২ নভেম্বরের একটি পোস্টে তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং গাজীপুর চৌরাস্তার মতো স্পর্শকাতর স্থানে সহিংসতার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন। ওই পোস্টে শামীম ওসমান এবং শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের নাম উল্লেখ করে ‘বড়ই অভাব’ কথাটি ব্যবহার করা হয়, যা অনেকের কাছে উসকানিমূলক বলে মনে হয়েছে।
এছাড়া ১৬ আগস্ট শেয়ার করা আরেকটি পোস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি প্রসঙ্গে শরীফ ওসমান হাদির একটি ফটোকার্ডে তিনি লেখেন, পাক বাহিনীর নাপাক পানিতে তোর মতো হাজার হাজার হাদি পয়দা হয়েছে বর্তমান এই বাংলায়। ওই পোস্টের কমেন্ট বক্সে ‘মৌলবাদীদের গর্দান নেওয়া’-সংক্রান্ত মন্তব্যও দেখা যায়, যা ঘৃণা ও সহিংসতা উসকে দেওয়ার শামিল বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকেরা। তার ওই ফেসবুক আইডি গত মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।
এসব পোস্টের স্ক্রিনশট শেয়ার করে যুবাইর মাহমুদ নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, ভয়াবহ অ্যালার্মিং একটি বিষয় শেয়ার করলাম। বিজয় দিবস উপলক্ষে যে প্যারাট্রুপিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে অংশ নেওয়া একজন সেনাসদস্য প্রকাশ্যে জুলাইযোদ্ধাদের নিয়ে নোংরা প্রচারণা চালিয়েছে। এই সৈনিকের অস্ত্রের মুখে বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তিনি আরো লেখেন, আওয়ামী লীগকে যে গোপনে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না—এটা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, সে প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে।
জানা গেছে, প্যারাট্রুপার অভির বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সুন্দরপুর এলাকায়। তার বাবার নাম নজরুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, তার বড় ভাই ইমরুল রাফি ফটিকছড়ি উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলেন এবং পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
এলাকার বাসিন্দা আবদুল হাকিম বলেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার সময় তার ভাই সরাসরি জড়িত ছিল। ওই সময় অভিও ফেসবুকে ছাত্র-জনতাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে একাধিক পোস্ট দেন।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে অংশ নেওয়া একজন সেনাসদস্যের এমন প্রকাশ্য রাজনৈতিক অবস্থান এবং সহিংস বক্তব্য সামাজিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে কতটা উদ্বেগজনক, সে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনীতে কর্মরত কোনো সদস্যের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা দলীয় মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ নেই। সেনাবাহিনীর বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সেনাসদস্যদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বাধ্যতামূলক।
তাদের ভাষায়, কোনো সেনাসদস্য যদি প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা আদর্শের পক্ষে অবস্থান নেন কিংবা বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতামূলক বক্তব্য দেন, তাহলে তা শৃঙ্খলাভঙ্গ হিসেবে গণ্য হয় এবং প্রয়োজন হলে প্রশাসনিক বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, সেনাবাহিনীতে কর্মরত কোনো সদস্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন না। যদি কোনো সেনাসদস্যের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ হয়, তবে প্রচলিত আইন ও সেনাবাহিনীর বিধিমালা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা তার বিষয়টি তদন্তে করে দেখছি।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ চায় দুই মন্ত্রণালয়