শিল্পের কাঁচামালের ঘোষণা দিয়ে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ‘ঘনচিনি’ বা সোডিয়াম সাইক্লোমেট আমদানির প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। সাধারণ চিনির তুলনায় ৩০-৫০ গুণ বেশি মিষ্টি এই রাসায়নিকটি চকোলেট, আইসক্রিম, বেভারেজসহ বিভিন্ন শিশুখাদ্যে দেদার ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা তিনটি চালানে ১০৭ টনের বেশি ঘনচিনি জব্দ করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। পাশাপাশি সন্দেহভাজন আরো কয়েকটি চালান পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব পণ্য আমদানি হওয়ায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সেগুলো শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। তাই বন্দরের ভেতরে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
ঘনচিনি দেখতে অনেকটাই চিনির মতো। তবে মিষ্টতার মাত্রা চিনির চেয়ে ৩০ থেকে ৫০ গুণ পর্যন্ত বেশি। প্রকৃত অর্থে এগুলো চিনি নয়, প্রাকৃতিক উপাদান থেকেও এগুলো তৈরি করা হয়নি। রাসায়নিক এ পদার্থটির নাম সোডিয়াম সাইক্লোমেট। এটি বহু বছর ধরে চীনের বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত হয়। আমদানি নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা শিল্পের কাঁচামালের আড়ালে এগুলো এনে খাদ্যপণ্যে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাস্টমস সূত্র জানায়, দেশে প্রতি কেজি সাধারণ চিনি বিক্রি হয় ১১০-১১৫ টাকায়। কিন্তু চীনে সোডিয়াম সাইক্লোমেটের দাম প্রতি কেজি প্রায় ৩৬৫ টাকা। যদিও দাম বেশি, কিন্তু একই পরিমাণ মিষ্টতা পেতে সাধারণ চিনির তুলনায় কয়েকগুণ কম পরিমাণ ঘনচিনি প্রয়োজন। এ কারণে মিষ্টিজাত পণ্য উৎপাদনে এটি অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি লাভজনক হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পলি অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড ঘোষণায় আসা এক কনটেইনার সন্দেহের ভিত্তিতে পরীক্ষা করা হয়। এতে সাড়ে সাত টন ঘনচিনি শনাক্ত হয়। এর আগে গত ২৮ অক্টোবর একই ঘোষণায় চীন থেকে আসা আরেক চালানে ৩৯ টন ঘনচিনি ধরা পড়ে। তারও আগে ১৬ সেপ্টেম্বর একটি বেসরকারি অফডক থেকে সোডা অ্যাশের নামে আমদানি করা তিন কনটেইনারে প্রায় ৬০ টন ঘনচিনি জব্দ করা হয়। মূলত ১৬ সেপ্টেম্বরের চালান আটক হওয়ার পর থেকেই কাস্টমস গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়, যার ফলে পরবর্তী দুই মাসে আরো দুটি বড় চালান ধরা সম্ভব হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার তারেক মাহমুদ জানান, প্রথমবার ২০১৬ সালে বন্দরে সোডিয়াম সাইক্লোমেটের চালান আটক করা হয়। পরবর্তীতে আমদানি নীতিতে এ পণ্যটি আমদানি নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত করা হয়। বর্তমানে আটক চালানগুলো ওই নীতি অনুযায়ীই জব্দ করা হচ্ছে। আরো কয়েকটি চালানে ঘনচিনি থাকতে পারে বলে তথ্য রয়েছে।
তিনি বলেন, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনায় সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া চালান শনাক্ত করা কঠিন। তবে সম্প্রতি পরপর কয়েকটি চালান ধরা পড়ায় বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে নতুন কিছু কৌশল প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ঘনচিনি আমদানির বিরুদ্ধে কাস্টমস কঠোর অবস্থানে আছে।
আরেক উপকমিশনার এইচএম কবির জানান, বৈধ পথে আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ায় শিল্পের কাঁচামালের আড়ালেই ঘনচিনি আমদানির চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে জব্দ করা তিনটি চালানের আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে কাস্টম হাউসের অনুসন্ধানী দল। প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. মোহাম্মদ মুসা বলেন, ঘনচিনিতে অতিরিক্ত মিষ্টি থাকায় এটি মিষ্টান্ন, আইসক্রিম, বেভারেজ, জুস, চকোলেট ও কনডেন্সড মিল্কে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার বেশিরভাগই শিশুখাদ্য। এ রাসায়নিকটি শিশুদের ক্যানসার, কিডনি ও লিভার রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে নতুন প্রজন্ম ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে।

