ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সরকারের দেওয়া দরিদ্র মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের নামে লাখ লাখ টাকা লুটপাট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। একটি ইউনিয়নেই ৮১ জন মা মাতৃত্বকালীন ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। উপজেলার বোকাইনগর ইউনিয়নের মাতৃত্বকালীন ভাতার আওতায় তালিকাভুক্ত সুবিধাবঞ্চিত অর্ধশতাধিক নারী গতকাল রোববার উপজেলা নারীবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে অভিযোগের পর বিক্ষোভ করেন ।
জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ ও ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এ ইউনিয়নের শতাধিক গর্ভবতী নারী তাদের নিজ নিজ ব্যাংক হিসাব নাম্বার লিখে মাসিক ভাতার টাকা উত্তোলনের আবেদন করেন। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের প্রতারকচক্র ওই হিসাব নাম্বার পরিবর্তন করে একাধিক মোবাইল নাম্বর ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং নগদের মাধ্যমে অর্ধশতাধিক নারীর প্রায় ১৭ মাসের মাতৃত্বকালীন ভাতার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
উপজেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শূন্য থেকে চার বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর পুষ্টির চাহিদা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ২০১০ সালে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচি চালু করে সরকার। এতে বর্তমানে তালিকাভুক্ত একজন দরিদ্র গর্ভবতী মা প্রথম অথবা দ্বিতীয় গর্ভধারণের পাঁচ মাস বয়স থেকে পরবর্তী ৩৬ মাস পর্যন্ত মাতৃত্বকালীন ৮০০ টাকা মাসিক ভাতা পান। জানা যায়, বোকাইনগর ইউনিয়নে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে তালিকাভুক্ত ১০০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে প্রায় ৫৯ জন এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ২২ জন গর্ভবতী নারী বিগত প্রায় ১৭ মাস ধরে মাতৃত্বকালীন ভাতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
অভিযোগকারীরা জানান, ইউপির অপসারিত চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ নেতা আল-মুক্তাদির শাহীনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মো. হুমায়ুন কবির, মো. খলিলুর রহমান এবং রেজাউল হক বাবু নামের তিন ব্যক্তির মাধ্যমে তারা প্রায় ২০-২২ মাস আগে মাতৃত্বকালীন ভাতার জন্য আবেদন করেছিলেন। পরে মাসের পর মাস তাদের কাছে ধরনা দিলেও সংশ্লিষ্টরা জানায় কাগজপত্র পাঠিয়েছি, ভাতা বরাদ্দ হলে খবর পাবেন। কিন্তু ভুক্তভোগী নারীরা ইদানীং জানতে পারেন বিগত প্রায় ১৭ মাস ধরে তাদের নামে ভাতার টাকা একাধিক মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে নগদে এ টাকা উঠানো হচ্ছে। সুবিধাভোগী ভাতাবঞ্চিতদের মধ্যে রামজীবনপুর গ্রামের হোসনে আরা ১৭ মাস (ব্যবহৃত অ্যাকাউন্ট নং-০১৬১৮-১৪৬৪০৬), বেতান্দর গ্রামের অঞ্জনা বেগম ১৫ মাস (ব্যবহৃত নগদ অ্যাকাউন্ট নং-০১৬১৮-১৪৬৪৭৩), শিলা আক্তার ১৫ মাস (ব্যবহৃত নগদ অ্যাকাউন্ট নং-০১৬১৮-১৪৬৩৮৭), মাহমুদা আক্তার ১৫ মাস (ব্যবহৃত নগদ অ্যাকাউন্ট নং-০১৬১৮-১৪৬৩৭৩), ঝিনুক আক্তার ১৫ মাস (ব্যবহৃত নগদ অ্যাকাউন্ট নং-০১৬১৮-১৪৬৯০১)। এ রকম প্রায় অর্ধশতাধিক মায়ের নামে মাতৃত্বকালীন মাসিক ভাতার টাকা উত্তোলন করা হলেও তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগী মায়েরা আজ পর্যন্ত কোনো টাকা পাননি। ভাতা বঞ্চিতদের শিলা আক্তার, মাহমুদা আক্তার ও তানিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, চেয়ারম্যান আর তার ঘনিষ্ঠ লোকজন আমাদের অ্যাকাউন্ট নাম্বার বদল করে তাদের নাম্বার দিয়া আমাদের গর্ভকালীন মাতৃত্ব ভাতা খাইয়া ফালাইছে। আমরা এর বিচার চাই।’
এ বিষয়ে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত ইউপি উদ্যোক্ততা মো. হোসাইন আহম্মেদ বলেন, মাতৃত্বকালীন ভাতার এ প্রতারণার সময় আমি কর্মরত ছিলাম না। কোনো কারণ না জানিয়েই ২০২২ সালে তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে পরিষদ থেকে বের করে দেন। পরে উদ্যোক্তা হিসেবে ডিজিটাল সেন্টারে তার ঘনিষ্ঠজনদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পর ওই চেয়ারম্যান অপসারিত হলে গত জুন-জুলাই ২০২৫ আমি পুনরায় কাজে যোগদান করি। আর এ সময়ে বিষয়টি জনসম্মুখে আসে। অপসারিত চেয়ারম্যান মো. আল মুক্তাদির শাহীন এ বিষয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, মাতৃত্বকালীন ভাতার অনিয়মে যারাই জড়িত থাকুক এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
উপজেলা নারীবিষয়ক কর্মকর্তা রেহানা আক্তার খাতুন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, অভিযোগকারী মায়েদের নামে আগস্ট-২০২৫ পর্যন্ত মোট ১৭ মাস মোবাইল ব্যাংকিং নগদে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে যেসব ফোন নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে তার সবগুলোই এখন বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক ইতোমধ্যেই অভিযোগকারী সুবিধাভোগী মায়েদের নামে নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংযুক্ত করে আগে মোবাইল নাম্বার বাতিলের ব্যবস্থা নিয়েছি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আছে। এর সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।

