রাজধানীতে অনুমোদিত নকশা থেকে বিচ্যুতির (ডেভিয়েশন) অভিযোগে প্রায় ১২০০টি আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্রকল্পের বিদ্যুৎ মিটার বিচ্ছিন্ন করেছে রাজউক। গত কয়েক মাস ধরে চলমান এ অভিযানের ফলে এসব প্রকল্পে গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
হঠাৎ করে নেওয়া এই পদক্ষেপে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ডেভেলপার, শ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী, বিনিয়োগকারী এবং ফ্ল্যাট ক্রেতারা মারাত্মক সংকটে পড়েছেন। রাজউকের এ উদ্যোগের আইনগত অবস্থান নিয়েও তৈরি হয়েছে তীব্র বিতর্ক। রাজউকের এ ধরনের পদক্ষেপের আইনগত বৈধতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বহু প্রকল্পেই ৩–৪ মাস ধরে কাজ প্রায় বন্ধ রয়েছে। রাতে সিসিটিভি, নিরাপত্তা বাতি, গার্ডপোস্ট—কিছুই সচল রাখা যাচ্ছে না। অন্ধকারে বাড়ছে মালামাল চুরির ঘটনা। রড, সিমেন্ট, ইটসহ মূল্যবান নির্মাণসামগ্রী হারিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। নিরাপত্তাকর্মীরাও বিদ্যুৎ ও পানির ঘাটতিতে মানবিক সংকটে পড়ছেন।
একাধিক প্রকল্প ব্যবস্থাপক জানান, রাতের বেলা মালামাল চুরি এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বিদ্যুৎ না থাকায় কিছুই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। এতে ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বিদ্যুৎ না থাকায় প্রকল্প এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিক, মিস্ত্রি, নিরাপত্তাকর্মী—সবার দৈনন্দিন কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রয়োজনীয় পানি না পেয়ে নির্মাণে কিউরিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে, যা ভবনের গুণগত মানকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যথাযথ কিউরিং না হলে ভবনের স্থায়িত্ব কমে যায় এবং ভবিষ্যতে ফাটল বা কাঠামোগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণ সময়সীমা দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে বহু ক্রেতা নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট বুঝে না পাওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন। কেউ কেউ ব্যাংক ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন—প্রকল্প বিলম্বিত হলে তাদের ওপর দ্বিগুণ আর্থিক চাপ পড়বে।
ডেভেলপাররা বলছেন, প্রকল্পের ডিলে মানে ক্রেতা–ডেভেলপার উভয় পক্ষের জন্যই আইনি জটিলতা বাড়বে। এতে পুরো আবাসন খাত অস্থির হয়ে পড়বে।
ডেভেলপার ও নগর বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, রাজউক নিয়মিত মনিটরিংয়ের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। প্রাথমিক পর্যায়ে তদারকি করলে ডেভিয়েশন হলে তা ঠিক করা সম্ভব হতো। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে ভবন যখন ৭–৮ তলা হয়ে যায়, তখনই ডেভিয়েশনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
একজন অভিজ্ঞ ডেভেলপার বলেন, যদি নিয়মিত ইন্সপেকশন করা হতো, তাহলে সমস্যা এমন পর্যায়ে যেত না। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ মিটার কেটে দিলে প্রকল্প যেমন বন্ধ হয়ে যায়, মানুষও মানবিক সংকটে পড়ে।
নির্মাণ খাত দেশের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক সেক্টর। এ খাতে ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, সরবরাহকারী, হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিকসহ ৪০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। প্রায় ১২০০ প্রকল্পে কাজ বন্ধ থাকায়—নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা কমেছে, শ্রমিকরা কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে, ব্যাংক ঋণ খেলাপির আশঙ্কা বেড়েছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্মাণ খাত স্থবির হলে তার প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে, যা বিনিয়োগ বাড়ানোর পথেও বাধা সৃষ্টি করবে।
বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা বিদ্যুৎ আইন ও বিতরণ সংস্থার এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। সাধারণত ডিপিডিসি, ডেসকো বা পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ড এই কাজ করে থাকে। কিন্তু রাজউক নিজ উদ্যোগে মিটার বিচ্ছিন্ন করায় আইনি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, ডেভিয়েশনের জন্য জরিমানা, স্থগিতাদেশ বা অনুমোদিত আইনি ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বিদ্যুৎ কাটা কতটা আইনগতভাবে বৈধ, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
ক্ষতিগ্রস্ত ডেভেলপার, শ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী ও ফ্ল্যাট ক্রেতারা দ্রুত সমস্যার সমাধান চান। রাজউক, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করে মানবিক ও অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

